ঢাকা
শুক্রবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
ই-পেপার

মিথ সংহিতা দাসের মানবিক উদ্যোগে বেইলী রোডের পথশিশুরা আলোর পথে

আপডেট : ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৩:২২ এএম

মিথ সংহিতা দাস সিদ্ধেশ্বরী গার্লস কলেজের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। ক্লাস শেষে শিক্ষার্থীরা সাধারণত বাড়ি ফেরার বা অবসর বিনোদনের প্রস্তুতি নেয়। কিন্তু, তিনি বেছে নিয়েছেন এক ভিন্ন পথ—সেবা ও শিক্ষার পথ। 

ক্লাস শেষে ব্যস্ততম বেইলী রোডের ফুটপাতে দাঁড়িয়ে প্রায় প্রতিদিন নিজ উদ্যোগে শিক্ষা দিচ্ছেন সমাজের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া শিশুদের, যাদের কাছে স্কুল কেবলই একটি স্বপ্ন।

সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মিথ সংহিতার এই মহৎ উদ্যোগটি ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। দেখা যায়, কলেজ ব্যাগটি পাশে রেখে হাসিমুখে তিনি অক্ষর জ্ঞান থেকে শুরু করে জীবনমুখী শিক্ষা দিচ্ছেন পথের ধারে বসে থাকা একদল পথশিশুকে। তার এই নিঃস্বার্থ প্রচেষ্টা শুধু বেইলী রোডের পথশিশুদের মধ্যেই নয়, সকল মানুষের মনেই আশা জাগিয়েছে।

মিথ সংহিতা দাস জানান, ‘কলেজে আসা-যাওয়ার পথে প্রায়ই দেখতাম এই শিশুরা ছেঁড়া জামা আর কৌতূহলী চোখ নিয়ে ফুটপাতে ঘোরাঘুরি করছে। ওদের মধ্যে শেখার একটা তীব্র আগ্রহ দেখেছি। প্রথম দিকে দু-একজনকে নিয়ে শুরু করি। এখন নিয়মিতভাবে ১০ থেকে ১২ জন পথশিশু পড়তে আসে। ওদের জন্য কিছু করার তাগিদ থেকেই এই কাজ শুরু করি। আমি শুধু ওদের অক্ষর জ্ঞান দিচ্ছি না, বরং ভালো মানুষ হয়ে ওঠার অনুপ্রেরণা দিচ্ছি।’

তিনি জানান, কলেজের ক্লাস শেষ হওয়ার পর প্রতিদিন বিকেল ৪টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত তিনি এই শিশুদের পড়ান। এই সময়টা পথশিশুদের জন্য খুবই উপযোগী।

Mith7 - Copy

এখানে পড়াশুনা করা শিশুদের মধ্যে রয়েছে- ইসমাঈল, আমেনা, সুহানা, সুমাইয়া, সুহান ও মিরাজুল। আরও অনেকেই আসেন পড়তে।

এই শিশুরা জানায় তাদের মা-বাবারা ফুল বিক্রি করেন, অন্যের বাসায় কাজ করেন, রিকশা চালান, গ্যারেজে কাজ করেন।

পড়তে আসা সাত বছর বয়সী আকাশ জানায়, ‘আগে সারাদিন শুধু এখানে-ওখানে ঘুরতাম, ময়লা কুড়াতাম। এখন ম্যাডামের (মিথ সংহিতা দাস) কাছে পড়তে আসি। ম্যাডাম খুব ভালো। এখন আমি 'ক' লিখতে পারি, 'খ' লিখতে পারি। বড় হয়ে আমি পুলিশ হবো, যাতে কেউ আর আমাদের মতো বাচ্চাদের কষ্ট দিতে না পারে।’

তিনি আরো জানান, ‘যখন দেখি একটা শিশু প্রথমবার নিজের নাম লিখতে পারছে বা একটা নতুন গল্প মনোযোগ দিয়ে শুনছে, সেই আনন্দটা বলে বোঝানো যায় না। আমাদের সমাজ হয়তো ওদের ভুলে গেছে, কিন্তু ওরা ভুলে যাওয়ার মতো নয়। আমি মনে করি, একটা দিনের সামান্য দু'ঘণ্টা সময় এদের ভবিষ্যৎ বদলে দিতে পারে। এই কাজটা আমার দায়িত্ব, এটা আমার গর্বের জায়গা।’

এদিকে মিথ সংহিতার এই ‘স্বপ্ন স্কুল’এর খবর পেয়ে দ্রুত এগিয়ে এসেছে ‘পথশিশু ফাউন্ডেশন’।

Mith13 - Copy

পথশিশু ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা নুরুল আলম নয়ন জানান, ‘মিথ সংহিতা দাসের মতো তরুণ শিক্ষার্থীরা যখন সমাজের প্রতি এমন দায়বদ্ধতা দেখায়, তখন আমাদের দায়িত্ব সেই উদ্যোগকে আরও মজবুত করা। আমরা তার স্বপ্নের স্কুলের জন্য প্রয়োজনীয় সকল বই, খাতা, পেন্সিল, এবং ভবিষ্যতে একটি স্থায়ী শিক্ষার স্থান তৈরির ব্যাপারে সাহায্য করার পরিকল্পনা করছি। এটি একটি অত্যন্ত মহৎ কাজ, যা সমাজের অন্যদেরও এগিয়ে আসতে উৎসাহিত করবে।’

ফাউন্ডেশনটির পক্ষ থেকে আরো জানানো হয়, তারা শিক্ষা সরঞ্জাম ছাড়াও শিশুদের জন্য স্বাস্থ্য ও পুষ্টির দিকটিও দেখবে।

মিথ সংহিতা দাসের এই ‘স্বপ্ন স্কুল’নিয়ে ‘পথশিশু ফাউন্ডেশন’সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে তাদের নিজস্ব পেইজে পোস্ট দিয়েছে।

সাংস্কৃতিক উপদেষ্টা মোস্তফা সরোয়ার ফারুকী পথশিশু ফাউন্ডেশনের ওই পোস্ট নিজে শেয়ার করে লিখেছেন ‘বিউটিফুল’।

জানা যায়, বেইলী রোডের স্থানীয় দোকানদার ও পথচারীরা এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছেন। অনেকে আবার স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাদের জন্য খাবার ও পানীয়ের ব্যবস্থা করছেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ধরনের ব্যক্তিগত উদ্যোগ সরকারের পাশাপাশি সামাজিক দায়বদ্ধতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে।


মিথ সংহিতা দাসের এই উদ্যোগ প্রমাণ করে, সমাজের পরিবর্তন আনতে বড় কোনো প্রতিষ্ঠানের দরকার নেই, দরকার শুধু একটি উদ্যোগী মন এবং ভালোবাসা। এই তরুণীর হাত ধরে বেইলী রোডের এই পথশিশুদের জীবনে যেন শিক্ষার এক নতুন অধ্যায় শুরু হলো।

HN
আরও পড়ুন