রাজধানীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে যত্রতত্র পাকিং এখন নিত্যদিনের চিত্র। এসব অবৈধ পাকিং এবং ফ্লাইওভার ও মেট্রোরেলে নিচে মাদকাসক্ত ও অপরাধীরা নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে নিচ্ছেন। সড়কে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ির ফাঁকে পথ শিশুরা দীর্ঘ সময় জটলা ধরে অবস্থান করে। তারা অবস্থান করে ফ্লাইওভার ও মেট্রোরেলের নিচে। সুযোগ বুঝে পথচারী নারী-পুরুষের ব্যাগ টেনে নেওয়ার ঘটনা ঘটছে, তবে ভুক্তভোগীরা অনেকেই ঝামেলার ভয়ে থানায় যাচ্ছেন না। আর এই সুযোগ নিচ্ছে ছিনতাইকারীরা।
সম্প্রতি নর্দান ইউনিভার্সিটির এক শিক্ষার্থী তুবা এয়ারপোর্ট এলাকায় বাজার করতে গিয়ে ছিনতাইয়ের শিকার হন। পায়ে হেঁটে যাওয়ার সময় পেছন থেকে তার ব্যাগ টেনে নেয় এক দুর্বৃত্ত। এ সময় পড়ে গিয়ে হাতে-পায়ে আঘাত পান তিনি। ব্যাগে ছিল ২,৫০০ টাকা ও কিছু ব্যক্তিগত জিনিসপত্র। কিন্তু অল্প টাকার জন্য এবং অপ্রয়োজনীয় ঝামেলা এড়াতে তিনি স্থানীয় পুলিশকে কিছু জানাননি।
মিরপুর-১০ এ একই চিত্র। আল হেলাল হাসপাতালে মেয়েকে ডাক্তার দেখাতে এসে ছিনতাইয়ের শিকার হন আয়শা আক্তার। ডাক্তার দেখানো শেষে গাবতলী যাওয়ার জন্য সিএনজি ধরতে রাস্তা পার হচ্ছিলেন তিনি ও তার অসুস্থ মেয়ে। হঠাৎ মেয়ের হাতে থাকা ব্যাগ ছিনিয়ে নেয় দুর্বৃত্ত। অপরিচিত ঢাকায় কাউকে চিনতেন না, আশেপাশের কারো সহযোগিতা পাননি। মেয়ের ব্যাগে ছিল মাত্র ৫০০ টাকা, তবুও অসহায় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে মা-মেয়েকে।

এমন অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছেন রাজধানীর আরো অনেক মানুষ। শান্ত নামের এক যুবক বলেন, ৩ মাস আগে পল্টন মেট্রোরেলের নিচ থেকে আমার ব্যাগ টেনে নিয়ে যায়। কারো সহযোগিতা পাইনি। সেই থেকে চেষ্টা করি অপ্রয়োজনীয় কারণে হেঁটে না চলতে, বিশেষ করে অবৈধ পার্কিং আর ফ্লাইওভার ও মেট্রোরেলের নিচ দিয়ে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর মেট্রোরেল, ফ্লাইওভার ও অবৈধ পার্কিং এলাকায় ছিনতাইকারীদের সক্রিয়তা সবচেয়ে বেশি। এসব জায়গায় রাতদিন সরগরম থাকে পথশিশু ও মাদকসেবীদের আনাগোনায়। ৭-৮ বছর বয়স থেকে শুরু করে ১৪-১৫ বছর বয়সী কিশোরদের হাতে দেখা যায় পলিথিনের ভেতরে আঠা, যা তারা নিঃশ্বাসের সঙ্গে গ্রহণ করে। অধিকাংশ সময় এই শিশু-কিশোররা অবৈধ পার্কিং করা গাড়ির চিপা বা ফ্লাইওভারের নিচে আশ্রয় নেয়। থাকে জটলা ধরে। সুযোগ পেলেই ব্যাগ টেনে নিয়ে পালায়।
সাইফুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি বলেন, অনেক সময় ইচ্ছা না থাকার পরও অনেক পথ হেঁটে চলতে হয়। কিন্তু মেট্র্রোরেলের নিচে এবং অনেক জায়গায় অবৈধ পাকিং এবং ভাসমান দোকান। সেই জায়গাগুলো দিয়ে ৭-৮ জন, কখনো এর চেয়ে বেশি ছেলে-মেয়েরা একসাথে জটলা ধরে থাকে। অধিকাংশ সময় এই সকল শিশুরা নেশাগ্রস্ত অবস্থায় থাকে। তাদের সামনে দিয়ে যেতে ভয় করে। কারণ যেকোন সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
আরিফ নামের এক ব্যক্তি বলেন, অবৈধ পার্কিং আর আইনশৃঙ্খলার দুর্বলতা ছিনতাইয়ের পরিবেশ তৈরি করছে। আর ভুক্তভোগীরা অভিযোগ না করায় আরো বেপরোয়া হয়ে উঠছে দুর্বৃত্তরা।

নজরুল ইসলাম বাকা নামের এক ব্যক্তি বলেন, ২৫ বছরের বেশি সময় ঢাকায় বসবাস করি। বিভিন্ন এলাকায় আর্ট করি। ফাঁকা জায়গা হলিই অনেকে গাড়ি পাকিং করে রাখে। আবার ফ্লাইওভার ও মেট্রোরেলের নিচ দিয়ে কিছু পথ শিশু আড্ডা করে। যাদের হাতে থাকে পলিথিন। পলিথিনে থাকে আঠা। এই জিনিসগুলো তারা মুখে নিয়ে শ্বাস নিতে থাকে। এসব শিশুরা অপরাধে জড়িয়ে যাচ্ছে।
বিশ্লেষকদের মতে, শুধু অবৈধ পার্কিং উচ্ছেদ করলেই হবে না, মাদকাসক্ত পথশিশুদের পুনর্বাসন এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে জোরদার করতে হবে। না হলে রাজধানীর ব্যস্ততম সড়কগুলোতে ছিনতাই এখনকার মতো চলতেই থাকবে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ এসএম শফিকুর রহমান বলেন, রাজধানীতে যত্রতত্র পাকিং এবং মেট্রোরেল ও ফ্লাইওভারের নিচে ভাসমান দোকানগুলো সৌন্দর্য নষ্ট করছে। এ ব্যাপারে আমরা ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।

তবে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, আমরা অনেকবার অভিযান চালিয়েছি। কিন্ত কাউন্টার, পাকিং, ভাসমান দোকানগুলো পুনরায় ফিরে আসে। দীর্ঘমেয়াদী সমাধানের জন্য একটি সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। যেখানে বিআরটিএ, পুলিশ, সিটি করপোরেশন ও পরিবহন মালিক সমিতির মধ্যে সমন্বয় থাকতে হবে।

ঢাকা মেট্রোপলিটন (ডিএমপি) পুলিশ কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাদ আলী বলেন, কোন ছিনতাইয়ের অভিযোগ পেলে অবশ্যই আমরা ব্যবস্থা নিয়ে থাকি। কিন্ত অভিযোগ না পেলে কীভাবে ব্যবস্থা নেব? এমন ঘটনায় একটি অভিযোগ নিয়ে আসেন। আমরা তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা নিব। ঢালাওভাবে অনেক অভিযোগ থাকতে পারে।
