ঢাকা
মঙ্গলবার, ১৮ নভেম্বর ২০২৫, ২ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
ই-পেপার

রাজশাহীতে নির্বাচনী ব্যয়

কেউই পরিষ্কার কিছু বলছেন না

আপডেট : ১৩ জানুয়ারি ২০২৪, ০৬:১৭ পিএম

সদ্য সমাপ্ত দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে রাজশাহীর ৬টি সংসদীয় আসনে প্রচার প্রচারণাসহ ভোট ব্যবস্থাপনায় কেমন অর্থ খরচ হয়েছে। খরচের বিষয়টি সবার মুখে মুখে ঘুরছে। কিন্তু এ নিয়ে কেউই পরিষ্কার কিছু বলছেন না। নির্বাচনে বিজয়ী ও পরাজিত প্রার্থীরা খরচ নিয়ে সরাসরি কথা বলতে নারাজ। তবে প্রচারণায় টাকা যে উড়েছে তা ওপেন-সিক্রেট।

জেলার ৬টি আসনের বিজয়ী প্রার্থীদের দুই একজন প্রচারণায় খরচের বিষয়ে কথা বলেছেন। তারা নিজের অর্থ ব্যয়ের প্রসঙ্গ এড়িয়ে পরাজিত প্রার্থীদের বক্তব্যের বিরোধিতা করেছেন। বাড়তি ব্যয়ের বিষয়ে দ্বিমত না করে তারা বলেছেন, শুধুমাত্র মাইকিং আর পোস্টার খরচ ও নির্বাচনী আইনে বেধে দেওয়া ব্যয় সীমা ছাড়িয়ে গেছে অনেকের। এর বাইরে সভা-সমাবেশ, মিছিল, আপ্যায়ন, ওয়ার্ড-ইউনিটে কর্মী-সমর্থকদের ‘নির্বাচন পরিচালনা’ খরচ ছাড়াও অদৃশ্য অনেক বড় খরচ করতে হয়। আর তা নির্বাচনী মাঠে এখন ‘ওপেন-সিক্রেট’ বিষয়।

নির্বাচনী ব্যয় সম্পর্কে রাজশাহী-২ (সদর) আসনে জাতীয় পার্টির (জাপা) প্রার্থী  সাইফুল ইসলাম স্বপন বলেন, নির্বাচনী ব্যয় ২৫ লাখ টাকার মধ্যে কেউ রাখে না। এখন ২৫ লাখ টাকায় কিছুই হয় না। ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের কারো কারো ব্যয় ইসি ঘোষিত অংকের শতগুণ ছাড়িয়ে গেছে। যিনি সব চেয়ে কম খরচ করেছেন তারও পোস্টার, ব্যানার, মাইকিংয়েই গেছে ২৫ লাখ টাকা। আর একেকটি সমাবেশের জন্য ন্যুনতম ১০ থেকে ২৫ লাখ টাকা ব্যয় করেছেন অনেকেই। এর বাইরে এলাকাভিত্তিক নেতাদের ‘ম্যানেজ’ করা, মিছিল-সমাবেশে লোক আনা, খাবার সরবরাহ এবং ভোটের দিন কেন্দ্র খরচের নামে ব্যয় করা হয়েছে প্রার্থী প্রতি মোটা অংক।

রাজশাহী-৪ (বাগমারা) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার এনামুল হক বলেন, এবার নির্বাচনের নামে কালো টাকা আর পেশি শক্তি প্রদর্শনের প্রতিযোগিতা হয়েছে। ইসির নির্বাচনী ব্যয়সীমা একটি কাগুজে অংক মাত্র। এর কোনো দাম নেই। নির্বাচনী মাঠে প্রার্থীদের ব্যয়ের হিসাব নির্দিষ্ট সীমার শতগুণ করলেও তা বাস্তবের সাথে মিলবে না।

রাজশাহী-৫ (পুঠিয়া-দুর্গাপুর) আসনে বিজয়ী আব্দুল ওয়াদুদ দারার বিরুদ্ধে সরাসরি ব্যয় সীমা লঙ্ঘনের অভিযোগ করে স্বতন্ত্র প্রার্থী ওবায়দুর রহমান। তিনি বলেছেন, মাঠের ব্যয়ের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি খরচ করেছেন নির্বাচন সংশ্লিস্টদের ‘ম্যানেজ’ করতে। তবে বিজয়ী প্রার্থী নিজের খরচ সম্পর্কে কিছু না বললেও তার বিরুদ্ধে ৩৫ কোটি টাকা ব্যয়ের তথ্য জানিয়েছেন পরাজিত প্রার্থী। তবে এমন অভিযোগ অস্বীকার করেছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও নব নির্বাচিত সংসদ সদস্য আব্দুল ওয়াদুদ দারা। তিনি এর বাইরে আর কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। ব্যয়ের সীমা যারা নির্ধারণ করেছেন তাদের কাছেই হিসাব দেওয়া হবে বলে জানান তিনি। 

এ ব্যাপারে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) রাজশাহী জেলা শাখার সভাপতি আহমেদ শফিউদ্দিন বলেন, নির্বাচনী ব্যয় নির্ণয়ে কোনো পদ্ধতি গড়ে ওঠেনি। প্রার্থীরা যতোই ব্যয় করেন, কম দেখিয়ে সীমার মধ্যেই রাখেন। নির্বাচনে কালো টাকা ও পেশিশক্তির প্রভাব সবসময়ই থাকে। মাত্রাতিরিক্ত অর্থ ব্যয় নিয়ে যেন কারোরই কোনো মাথাব্যথা নেই। যে পরিস্থিতি চলছে তাতে ভবিষ্যতে দেশের সর্বোচ্চ আইন সভায় এলাকার জনগণের প্রতিনিধিত্ব করার মতো সুশিক্ষিত, মেধাবী ও যোগ্যতা সম্পন্ন লোক থাকলেও কেবল বিপুল অংকের টাকা না থাকায় নির্বাচনে আসতে পারবেন না।

সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) রাজশাহী জেলা সভাপতি প্রফেসর ড. দীপকেন্দ্র নাথ দাস বলেন, ৯০% এরও বেশি প্রার্থী নির্বাচনী ব্যয়সীমা মানেন না। ব্যয়সীমা লঙ্ঘনের জন্য কোনো জবাবদিহিতা না থাকায় ক্রমেই এক শ্রেণীর প্রার্থীর আস্ফলন বাড়ছে। সাধারণত প্রচারণা ও প্রচারের কাজে যারা নিয়োজিত থাকে তাদের পেছনেই ব্যয়টা বেশি হয়। এছাড়াও ভোট আনার জন্য দলীয় লোকদেরও নগদ অর্থ দিতে হয়। এসব বন্ধে নির্বাচন কমিশনের সেরকম কোনো নজরদারিও নেই। যতদূর জানি তাদের জনবলও অত্যন্ত কম।

তবে নির্বাচনী ব্যয়ের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. ফরিদ উদ্দিন খান। তার মতে, ২৫ লাখ টাকার যে নির্বাচনী ব্যয় সেটা আরও কম হওয়া দরকার। কারণ একজন প্রার্থীর যদি নির্বাচনে ২৫ লাখ টাকা ব্যয় করার মতো যথেষ্ট টাকা থাকতে হলে তাকে উচ্চবিত্ত হতে হবে। বাস্তবের নির্বাচনী ব্যয়ের চেয়ে টাকার লেনদেন হয় প্রচুর, যেটা চরম অনৈতিক কাজ। প্রচারণার সময় হিসেবে ইসি নির্ধারিত ব্যয় সীমা অনেক বেশি। তার পরও কেউ কিছু মানছেন না। নির্বাচন কমিশনও ততোটা যাচাই-বাছাই করছে না। এটা একটা রুটিনের মতো, কোনো মনিটরিংও নেই।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও রাবি অধ্যাপক মলয় কুমার ভৌমিক বলেন, আইন ফাঁকি দিয়ে তো অনেক কিছুই ব্যয় করা যায়। প্রার্থীকে ২৫ লাখ টাকা ব্যয়ের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু তার ব্যয়টা কিসে হবে? পোস্টার আর মাইকিং এর বাইরে তো ব্যয় হওয়ার কোনো কারণ নেই। কাউকে চা খাওয়ানো যাবে না, টাকা দেওয়া যাবে না। তাহলে ব্যয়টা কোথায় হচ্ছে? পৃথিবীর বহু দেশ আছে প্রার্থীদের একটা পয়সাও খরচ করতে হয় না। বিভিন্ন জায়গায় দেখা যায়, ১৫ হাজার টাকা দিয়ে বলা হয় কিছু মানুষ নিয়ে প্রচার-প্রচারণা চালাবে। সেটা তো আইনের মধ্যে পড়ে না। সে যদি দলীয় কর্মী হয় তবে স্বেচ্ছায় করবে। 

রাজশাহী বিভাগীয় নির্বাচন কর্মকর্তা দেলোয়ার হোসেন বলেন, এটা দেখার দায়িত্ব আদালতের। কিন্তু আমাদের কাছে উনারা (প্রার্থী) খরচ সীমার মধ্যেই দাখিল করেন। ২০ থেকে ২৫ লাখের মধ্যেই রাখেন। এর বেশি কেউ দাখিল করেন না। বেশি পাওয়া গেলে আমরা তখন ব্যবস্থা নেব। এ রকম কেউ কোনো অভিযোগও দেননি। আর অভিযোগ দিলেও তো তথ্য-প্রমাণসহ দিতে হবে।

 

 

 

 

SA
আরও পড়ুন