রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের প্রথম ধাপে এক লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গাকে ফেরত নিতে মিয়ানমার রাজি হয়েছে বলে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। তবে রাখাইন রাজ্যের বেশিরভাগ অঞ্চল এখন মিয়ানমারের সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে। এ কারণে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন এত সহজ নয় বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
শুক্রবার (৪ এপ্রিল) প্রধান উপদেষ্টা তার ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্টে এক পোস্টের মাধ্যমে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়ে জানানোর পর থেকে বিষয়টি নানা আলোচনা ও সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। ক্যাম্পে বসবাসরত রোহিঙ্গারাও এ বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত দিচ্ছেন।
ক্যাম্প-১ এ বসবাসরত রোহিঙ্গা মোহাম্মদ হোসেন জানান, তারা রোহিঙ্গা হিসেবে স্বীকৃতি ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন চান। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে যখন তাদের দেশে ভয়াবহ সংঘর্ষ চলছে, তাদের আত্মীয়স্বজন, সহকর্মী ভাই-বোনরা কঠিন বিপদে রয়েছেন, তখন তিনি নিশ্চিত নন কীভাবে তাদের দেশে পাঠানো হবে।
আরেক রোহিঙ্গা মাওলানা আবদুল হামিদ বলেন, আমরা অনেক খুশি যে বাংলাদেশ সরকার আমাদের নিরাপদ আশ্রয় দিয়েছে। তবে আমরা বাংলাদেশ সরকারের দয়ায় বেঁচে থাকতে চাই না, আমরা মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন চাই। কারণ আমাদের জীবন এই ঘনবসতিপূর্ণ শিবিরে আটকে আছে। বর্তমানে জান্তা সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই রাখাইন রাজ্যে, তাহলে প্রত্যাবাসন কীভাবে সম্ভব?
দীর্ঘদিন ধরে রোহিঙ্গা ও মিয়ানমারের সংঘর্ষ নিয়ে কাজ করা সাংবাদিক তানভীরুল মিরাজ রিপন বলেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন এত সহজ বিষয় নয়। ২০২৩ সালে, যখন মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর আমন্ত্রণে একদল রোহিঙ্গাকে রাখাইন পর্যবেক্ষণের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তখন তারা টেকনাফ জেটিতে ফিরে এসে বলেছিলেন যে সেখানে তাদের জন্য নিরাপত্তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তারা সেখানে যেতে রাজি নন। এই কারণে আমি বলছি, এটি বাংলাদেশকে বিভ্রান্ত করার একটি কৌশল মাত্র।
রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করা আরেক সাংবাদিক সৌরভ দেব বলেন, আরাকান অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ কার্যত মিয়ানমারের জান্তার হাতে নেই। ওই ভূখণ্ডের ৯০ শতাংশ এখন আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে। এমন পরিস্থিতিতে জান্তা কীভাবে এক লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গাকে প্রত্যাবাসন করবে? কোথায় করবে? আরাকান আর্মি কী বসে বসে দেখবে? সব বাদ দিলেও, জাতিসংঘের প্রত্যাবাসন নীতি কী বলে? এমন যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলে ‘প্রত্যাবাসন’ করা যায়? জাতিসংঘ কী এটি অনুমোদন দেবে? আইন বিষয়ে আমার ক্ষুদ্র জ্ঞান অনুযায়ী বলছি এটি সম্ভব নয়, সম্ভব নয় এবং সম্ভব নয়।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর (অব.) এমদাদুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সম্ভব নয়। রাখাইনের পরিস্থিতি অত্যন্ত অস্থিতিশীল, যেখানে নিরাপত্তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। সম্প্রতি জাতিসংঘের মহাসচিবও বলেছেন, রাখাইনে স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত হলেই প্রত্যাবাসনের কথা বিবেচনা করা হবে। এখন সেখানে রোহিঙ্গাদের বসবাসের জন্য বাড়িঘর নেই। দ্বিতীয়ত যেসব এলাকায় রোহিঙ্গাদের বসতি ছিল, সেসব এখন আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে। এমন পরিস্থিতিতে কীভাবে প্রত্যাবাসন সম্ভব হবে? কখন, কীভাবে, কার ক্লিয়ারেন্সে তা সম্ভব হবে এসবই অনিশ্চিত।
২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের সেনাবাহিনী উত্তর রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে দমনপীড়ন শুরু করে। সেই দিন থেকে বাংলাদেশের উখিয়া এবং টেকনাফের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে থাকে রোহিঙ্গারা। জাতিসংঘের হিসেব মতে সে সময় বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিল সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা।
