নতুন উৎসে করের অসংগতি ও জটিলতার কারণে নোয়াখালীর হাতিয়া পৌরসভা এলাকায় জমি ক্রয়-বিক্রয়ে নানান সমস্যার মুখে পড়েছে সাধারণ মানুষ। ফলে অনেকেই দান কবলার মাধ্যমে জমি হস্তান্তরের পথে হাঁটছেন। এতে সরকার যেমন বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে, তেমনি অনিয়ম ও হয়রানির অভিযোগও বাড়ছে।
২০২৫ সালের ২৪ জুন জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) কর্তৃক প্রকাশিত এস.আর.ও নং ২৬৯-আইন/আয়কর-১৪/২০২৫ অনুযায়ী, নতুন উৎসে কর বিধিমালা কার্যকর হয় ১ জুলাই থেকে। গেজেটে উৎসে কর বিধিমালা, ২০২৪ সংশোধন করে বিধি ৬ এর উপ-বিধি (১) অনুযায়ী সারণী-২ তে বলা হয়, যেকোনো পৌরসভার অন্তর্গত মৌজার ভূমির মূল্যের ২ শতাংশ বা শতকপ্রতি ১০ হাজার টাকা, যাহা অধিক, তাহা প্রযোজ্য হবে। এই ‘বা’ শব্দটি সংযোজনের ফলে ২ শতাংশ ও শতকপ্রতি ১০ হাজার টাকার মধ্যে অসংগতি সৃষ্টি হয়েছে বলে দাবি করছেন ক্রেতা-বিক্রেতা ও দলিল লেখকরা।
নতুন বিধির আগে হাতিয়া পৌরসভায় জমি বিক্রয়ের সময় বিক্রেতারা ভূমির মূল্যের ওপর ৪ শতাংশ হারে উৎসে কর দিতেন। এখন শতকপ্রতি ১০ হাজার টাকা নির্ধারণ করায় অনেক ক্ষেত্রেই করের পরিমাণ জমির প্রকৃত মূল্যের চেয়েও বেশি হয়ে যাচ্ছে। ফলে অনেকে ক্রয়-বিক্রয়ের বায়না বাতিল করছেন, কেউ কেউ দলিলে কম মূল্য দেখাচ্ছেন, আবার অনেকেই দান কবলার পথ বেছে নিচ্ছেন।
স্থানীয় দলিল লেখকরা বলছেন, নতুন কর নীতির কারণে জমি রেজিস্ট্রির কাজ প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছে। তাদের পেশাগত কার্যক্রমও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও একই সমস্যায় ভুগছে সাধারণ ক্রেতা-বিক্রেতারা।
উৎসে করের নানা সমস্যা-
অতিরিক্ত ফি আদায়
শুন্যরচর গ্রামের দিনমজুর গোলাম কিবরিয়ার স্ত্রী জরিনা বেগম জানান, গত মাসে তিনি ও তার স্বামী ২৬ শতক জমি দান কবলায় গ্রহণ করেন। চৌমুহনী এলাকার দলিল লেখক রেজিস্ট্রি ফি ও অফিস খরচ বাবদ ৬২ হাজার টাকা নেন, অথচ সরকারি ফি সাড়ে ৭ শতাংশসহ অন্যান্য মিলিয়ে সর্বোচ্চ ২০ হাজার টাকার মধ্যে শেষ হওয়ার কথা ছিল।
একই ওয়ার্ডের বাবর ও জহির নামের দুই ভাই ১২ শতক জমি দান কবলায় নিলে তারাও অতিরিক্ত টাকা আদায়ের অভিযোগ করেন।
দলিলে কম মূল্য দেখানোর প্রবণতা
৫নং ওয়ার্ডের এক বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, তিনি ৪৭ লাখ টাকায় ৫ শতক জমি ক্রয় করলেও দলিলে মাত্র ১৩ লাখ টাকা মূল্য উল্লেখ করেছেন, যাতে করের চাপ কম পড়ে।
একই ওয়ার্ডের উত্তম সাহা জানান, উৎসে করের উচ্চহারজনিত কারণে তিনি ৮০ শতক জমি বিক্রয়ের চুক্তি বাতিল করতে বাধ্য হয়েছেন।
সাধারণ মানুষের ক্ষোভ
স্থানীয় শিক্ষক আলী আশরাফ শাহীন বলেন, জমির মূল্যের তুলনায় উৎসে কর অনেক বেশি। ফলে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষ এখন জমি কিনতে ভয় পাচ্ছে। এতে জমি পতিত থাকছে, বাজারও স্থবির হয়ে পড়েছে।
৯নং ওয়ার্ডের আবুল বাসার বলেন, হাতিয়া পৌরসভা গঠনের ২০ বছর পেরিয়ে গেলেও এখানে উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন হয়নি। অথচ কর বাড়ানো হয়েছে বহুগুণ। রাস্তা-ঘাট ও নাগরিক সুবিধা বাড়েনি, বরং মানুষ প্রতিটি ধাপে হয়রানির শিকার হচ্ছে।
হাতিয়া উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রার নুরুল ইসলাম বলেন, সরকার যখন যে আইন করে, আমরা তা বাস্তবায়নে বাধ্য। তবে নতুন কর কাঠামোর কারণে কিছু জটিলতা দেখা দিয়েছে, তা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে।
সামাজিক সংগঠন ‘সচেতন নাগরিক সমাজ-হাতিয়া’-এর সাধারণ সম্পাদক মহিব্বুল মাওলা বলেন, উৎসে করের সামঞ্জস্যতা ও সংগতিপূর্ণ হার নির্ধারণ এখন সময়ের দাবি। নতুবা জমি ক্রয়-বিক্রয় পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে, রাজস্বও কমবে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের আয়কর বিভাগের প্রথম সচিব (কর পরিবীক্ষণ ও প্রশিক্ষণ) মো. মোসাদ্দেক হুসেন বলেন, মাঠ পর্যায়ের সমস্যা অফিসিয়ালি জানালে রাজস্ব বোর্ড তা পর্যালোচনা করে যথাযথ ব্যবস্থা নেবে।
উৎসে করের উচ্চহারে দিশেহারা জমির ক্রেতা
আয়কর আইন ও উৎসে কর বিধিমালা-২০২৩ পরিপালনের নির্দেশ