নরসিংদীর রায়পুরার দুই তরুণ লিবিয়া থেকে ইতালি যাওয়ার পথে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে নৌকা ডুবে প্রাণ হারিয়েছেন। হতভাগ্য তরুণেরা হলেন- রায়পুরা উপজেলার মুছাপুর ইউনিয়নের বীর শ্রেষ্ঠ মতিউর নগর গ্রামের ইদ্রিস মিয়ার ছেলে ইসতিয়াক হাসান ইমরান (৩২) ও ফয়সাল আবেদিন (২৩)।
ইমরান ওই ইউনিয়নের ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ফয়সাল উপজেলার চান্দেরকান্দি পশ্চিমপাড়া এলাকার বাসিন্দা সৌদি প্রবাসী ওসমান মিয়ার ছেলে।
গত মঙ্গলবার (১৮ জুন) ইতালির দক্ষিণ উপকূলে অভিবাসন প্রত্যাশীদের বহনকারী দুটি নৌকা ডুবে যায়। এর একটিতে ছিলেন ইমরান। এতে তিনিসহ ১১ জনের মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় শিশুসহ ৬০ জন নিখোঁজ আছেন।
ইমরানের মৃত্যুর সংবাদটি তার ভাই আরমান আহমেদকে মোবাইলে ফোনে জানান দালাল রাজিব মিয়া।
দালালের বরাত দিয়ে আরমান বলেন, ডুবে যাওয়া নৌকার পাটাতনের নিচে ইমরানসহ ১২ জন ছিলেন। ইতালির উপকূলে প্রবেশের পর তেলের ট্যাংঙ্ক বিস্ফোরণ হলে নৌকার ভেতরে পানি ঢুকে যায়। ওই সময় বাইরে থেকে পাটাতন আটকানো ছিলেন। সেখানেই ইমরানের মৃত্যু হয়। নৌকাটিতে তখন ৬২ অভিবাসন প্রত্যাশী ছিলেন।
আরমান আরও জানান, লিবিয়া প্রবাসী দালাল রাজিব মিয়ার সাথে ইমরানের ১৫ লাখ টাকায় ইতালি যাওয়ার চুক্তি হয়েছিল। সাগর পথে বিদেশ যাত্রায় বিরোধী ছিল তার পরিবার। কিন্ত ইমরানের জেদ ছিল ইতালি যাবে।
অপরদিকে উপজেলার চান্দেরকান্দি গ্রামে নিহত ফয়সালের বাড়িতে গিয়ে জানা যায়, গত ১৮ দিন আগে সাগর পথে ইতালি রওনা দেন ফয়সাল আবেদিন। এরপর থেকে তিনি নিখোঁজ ছিলেন।
স্বজনেরা জানান, ফয়সাল আবেদিন রায়পুরা সরকারি কলেজে পড়াশোনা করতেন। স্বপ্ন ছিল ইতালি যাবেন। গত বছর উপজেলার বেগমাবাদ এলাকার লিবিয়া প্রবাসী রাকিব মিয়া নামে এক দালালের মাধ্যমে লিবিয়ায় পাড়ি জমান। চুক্তি অনুযায়ী লিবিয়া পৌঁছে দালালকে ছয় লাখ টাকা দেন ফয়সালের পরিবার। বাকি চার লাখ টাকা ইতালি পৌঁছানোর পর দেওয়ার কথা ছিল।
গত বুধবার (১৯ জুন) ফয়সাল আবেদিনের মৃত্যুর সংবাদটি ফোনে পরিবারকে জানান সৌদি প্রবাসী তার নিকট এক আত্মীয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফেসবুকে তিনি এই সংবাদটি জানান। সেই ফেসবুক পোস্ট থেকে জানা যায়, লিবিয়ার বেনগাজী শহরের তলময়দা সাগর তীরে দুটি মরদেহ ভেসে আসে। এর মধ্যে একজনের পাসপোর্ট উদ্ধার করে স্থানীয় কোস্টগার্ড। উদ্ধার হওয়া ওই পাসপোর্টটি ছিল ফয়সাল আবেদিনের। তার মরদেহ বর্তমানে স্থানীয় আল মারজা হাসপাতাল মর্গে আছে।
ফয়সাল আবেদিনের মা শিল্পী বেগম বলেন, ঢাকা যাওয়ার কথা বলে দালালের মাধ্যমে দুবাই গিয়ে আমাকে ফোন দেয় ফয়সাল। ইতালি নেওয়ার ব্যাপারে দালাল রাকিব আমাদের সাথে কোনো আলাপ করেনি। গত ১৮ দিন আগে ফয়সাল ফোনে জানায় সে ইতালি রওয়া দিচ্ছে। এরপর থেকে ছেলের মোবাইল বন্ধ।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজিব মিয়া ও রাকিব মিয়া নামে দুই দালাল দীর্ঘদিন ধরে লিবিয়ায় বসবাস করছেন। সাগর পথে ইতালি পাঠাতে অভিবাসন প্রত্যাশী ব্যক্তিদের কাছ থেকে ১২ থেকে ১৫ লাখ টাকা নিতেন দালাল চক্রটি। অভিবাসন প্রত্যাশীদের ইতালি পাঠানো আগে লিবিয়ার 'গেম ঘরে' বন্দি করে রাখা হয়। সেখানে তাদের দেওয়া হতো না পর্যাপ্ত খাবার ও পানি। টাকা আদায় শেষ হলে নৌকায় করে সাগর পথে পাঠানো হতো ইতালি। অনিরাপদ যাত্রায় সাগরে ডুবে অনেক মারা গেলেও থামেনি তাদের কার্যক্রম।
মুছাপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মো. হোসেন ভূঁইয়া বলেন, ইসতিয়াক হাসান ইমরান মুছাপুর ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তার মৃত্যুতে গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি। এমন মৃত্যু কাম্য নয়। অবৈধ পথে ইতালি যাওয়ার ব্যাপারে সকলকে আরও সচেতন হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
রায়পুরা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সাফায়েত হোসেন পলাশ জানান, এ ব্যাপারে নিহত দুজনের পরিবারের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত কোনো অভিযোগ পাইনি। অভিযোগ পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
রায়পুরা উপজেলা নিবার্হী কর্মকর্তা মো. ইকবাল হাসান জানান, সাগর পথে ইতালি যাওয়ার পথে মৃত্যু হয়েছে এমন তথ্য জানা নেই। তবে তাদের পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
নিহত ইসতিয়াক হাসান ইমরান ও ফয়সাল আবেদিনের মরদেহ দ্রুত দেশে ফিরিয়ে আনতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট জোর দাবি জানান দুই ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্য ও স্বজনসহ স্থানীয়রা।
