ঘড়ির কাঁটায় সকাল ৮টা। পাঠদান শুরু হতে তখনও বাকি প্রায় এক ঘণ্টা। এরই মধ্যে আসতে শুরু করেছে ছাত্রছাত্রীরা। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এসে হাতে তুলে নিলেন ঝাড়ু। আশপাশ পরিষ্কার করছেন তিনি। একটু দূরে দেখা গেলো শিক্ষার্থীরা দল বেঁধে বিদ্যালয়ের এসে আঙিনা পরিষ্কারে ব্যস্ত। আনন্দঘন পরিবেশে চলছে সমন্বিত উদ্যোগ। পতাকা বাঁধা থেকে ঘণ্টা-বেল বাঁধা সব কাজই নিজ হাতে করছেন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক।

অথচ একসময় বিদ্যালয়টি ছিল অবহেলিত। ভবন ছিল জীর্ণশীর্ণ, পড়াশোনার মান ছিল নিম্নমুখী। শিক্ষার্থীরাও একে একে বিদ্যালয় ছেড়ে যাচ্ছিল। সবাই যখন মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল, তখন হাল ধরেন প্রধান শিক্ষক মো. শহিদুল ইসলাম (৫৩)। তার হাত ধরেই বদলে যেতে থাকে বিদ্যালয়। বছর তিনেকের মধ্যেই শতভাগ পাসের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের মাঝে শৃঙ্খলা ও আগ্রহ ফিরে আসে।

বলছিলাম রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি উপজেলার বহরপুর ইউনিয়নের স্বাবলম্বী ইসলামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কথা। এ বছর প্রাথমিক শিক্ষা পদক এর শ্রেষ্ঠ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ক্যাটাগরিতে জাতীয় পর্যায়ের প্রতিযোগিতায় বিদ্যালয়টি দ্বিতীয় স্থান অর্জনের কৃতিত্ব অর্জন করেছে।

শিক্ষার্থীদের সততার শিক্ষা দিতে ২০১৫ সালে শিক্ষক শহিদুল ইসলাম চালু করেন ‘সততা স্টোর’।

দোকানদার ছাড়াই শিক্ষার্থীরা খাতা, কলম ও শিক্ষা উপকরণ কিনতে পারে এখান থেকে। আবার ঝরে পড়া ঠেকাতে ২০২৪ সালে গড়ে তোলেন ‘বন্ধু টিম’। শিক্ষার্থীরা দলবদ্ধ হয়ে বিদ্যালয়ে আসে ও ফেরে, একে অপরকে পড়াশোনায় সহায়তা করে। এছাড়াও পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার মানোন্নয়নে রাতের বেলাতেও চালু করেন পাঠদান।

বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে তৈরি হয়েছে শিশুবান্ধব মীনা ও রাজু পার্ক, ফুলের বাগান, শহীদ মিনার, পশুপাখির ম্যুরাল, শাপলা স্কয়ার ও ছাদবাগান। সুসজ্জিত পরিবেশে বিদ্যালয়টি এখন শিশুদের কাছে এক স্বর্গরাজ্য।

জানা গেছে, ১৯৬৮ সালে মাত্র ২০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু করা বিদ্যালয় আজ দেশের সেরা প্রতিষ্ঠানের কাতারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী শহিদুল ইসলাম ২০০৩ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি যোগ দেন স্বাবলম্বী ইসলামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এরপর থেকে তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় সাফল্যের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রয়েছে। শহিদুল ইসলামের অর্জনের তালিকায় রয়েছে একের পর এক স্বীকৃতি।

২০০৬, ২০১২ ও ২০১৬ সালে জেলার শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক নির্বাচিত হন শহিদুল। ২০১৯ সালে ঢাকা বিভাগে ও সারাদেশে সেরা প্রধান শিক্ষক হন তিনি। তার ঐকান্তিক চেষ্টায় ২০১৮, ২০২১ ও ২০২৪ সালে জেলার শ্রেষ্ঠ প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্বাচিত হয় স্বাবলম্বী ইসলামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এছাড়াও ২০২৪ সালে ঢাকা বিভাগের শ্রেষ্ঠ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের স্বীকৃতি এবং ২০২৪ সালে প্রাথমিক শিক্ষা পদক এর 'শ্রেষ্ঠ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়' ক্যাটাগরিতে জাতীয় পর্যায়ের প্রতিযোগিতায় বিদ্যালয়টি দ্বিতীয় স্থান অর্জন করার কৃতিত্ব অর্জন করে বিদ্যালয়টি। এ বছর শিক্ষক শহিদুল রাজবাড়ীর শ্রেষ্ঠ গুণী শিক্ষক ও নির্বাচিত হয়েছেন।

উদ্ভাবন ও বিদ্যায়তনে আদর্শিক চর্চার জন্য স্বাবলম্বী ইসলামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও শিক্ষক শহিদুলকে সম্মাননা জানানো হয়। গত বছরের ২৪ অক্টোবর ন্যাশনাল একাডেমি ফর এডুকেশনাল ম্যানেজমেন্ট ও ইউনেসকো যৌথভাবে এই সম্মাননা দেয়।
শিক্ষার্থীদের মানোন্নয়ন ও বিদ্যালয়ের উন্নয়নে নিজের বেতনের টাকাও খরচ করেছেন তিনি। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের মাঝে সময় দেন। অভিভাবকের মতো তিনি আগলে রেখেছেন বিদ্যালয়কে।

এভাবেই বালিয়াকান্দির স্বাবলম্বী ইসলামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে দেশসেরা পর্যায়ে পৌঁছে দিয়েছেন। তিনি প্রমাণ করেছেন—একজন সৎ, আদর্শবান ও নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক চাইলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে যেমন বদলে দিতে পারেন, তেমনি বদলে দিতে পারেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জীবনও।

স্বাবলম্বী ইসলামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, প্রতিষ্ঠার পর থেকে অত্র এলাকায় বিদ্যালয়টি শিক্ষার আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে। যে বিদ্যালয়টি একসময় শিশুদের কাছে আকর্ষণীয় ছিল না সেখানে আজকে এই বিদ্যালয়টি অত্যন্ত শিশুবান্ধব ও শিশুদের স্বর্গ হিসেবে রুপ নিয়েছে। যার ফলে এই বিদ্যালয়ের বিভিন্ন কার্যক্রম দেখার জন্য সারাদেশ থেকে অনেকেই এই বিদ্যালয়ে পরিদর্শনে আসেন। আমাদের কার্যক্রমের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২৪ সালে সারাদেশের মধ্যে শ্রেষ্ঠ প্রাথমিক বিদ্যালয় ক্যাটাগরিতে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেছে।

তিনি আরও বলেন, এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মানোন্নয়নে আমরা বিদ্যালয় ছুটির পরে বিশেষ ক্লাস, ছুটির দিনে 'ছুটির ট্রেন' নামে একটি বিশেষ ক্লাস এবং প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষার্থীদের জন্য নৈশকালীন ক্লাস নিয়ে থাকি। যেগুলো সম্পূর্ণ অবৈতনিক। এছাড়াও পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের জন্য আমরা কাজ করে থাকি। আমার সকল কার্যক্রমে আমার প্রধান শক্তি হচ্ছে আমার শিক্ষকেরা। তারা এই বিদ্যালয়টিকে অনেক ভালোবাসেন। আমার প্রত্যেকটি কাজে তারা সহযোগিতা করেন।

জেলা প্রশাসক সুলতানা আক্তার বলেন, স্বাবলম্বী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আমি পরিদর্শন করেছি। বিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস, ডিসিপ্লিন অসাধারণ। সারাদেশের মধ্যে বিদ্যালয়টি অনুকরণীয়। আমি মনে করি দেশের প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকরা স্বাবলম্বী স্কুলকে অনুকরণ করে তাদের নিজেদের বিদ্যালয়ে শিক্ষা ব্যবস্থাপনার মানোন্নয়ন করতে পারে।
