নড়াইলের মধুমতি রুদ্ররূপ ধারণ করেছে। জেলার লোহাগড়া উপজেলার শিয়েরবর ও তেলকাড়া এলাকায় ভাঙন দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে লোহাগড়া উপজেলার কোটাকোল ইউনিয়নের তেলকাড়া গ্রামে ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করেছে। সর্বগ্রাসী মধুমতির ভাঙনে বিগত ৫০ বছরে তেলকাড়া এলাকার নদী পাড়ের কয়েক হাজার মানুষ গ্রাম ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। সর্বস্ব হারিয়ে তারা পার্শ্ববর্তী এলাকায় ঠাঁই নিয়েছে। আবার অনেকে ভিটা ছেড়ে চলে গিয়েছে বহুদূরে।
বর্ষা মৌসুম শুরু হওয়ার সাথে সাথে মধুমতী নদীতে ভাঙন শুরু হয়েছে। গত কয়েকদিনে ভাঙনের তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এ এলাকার নদীপাড়ের মানুষেরা চরম আতঙ্কে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন। দুশ্চিন্তার যেন শেষ নেই তাদের। কখন যেন তাদের বসতভিটা নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। পরিবার-পরিজন নিয়ে কোথায় যাবেন? তাও জানা নেই।
বিগত ৫০ বছরে সর্বনাশা মধুমতি গ্রাস করেছে হাজার হাজার একর আবাদি জমি। হাজার হাজার পরিবারের ভিটেমাটি, রাস্তা, স্কুল, মসজিদ, মাদ্রাসাসহ সহায়-সম্পদ। বারবার ভাঙনের মুখে পড়ে অনেক পরিবার নি:স্ব হয়েছে। ওই এলাকার পাকা রাস্তাসহ বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইনের খুঁটি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।
শুক্রবার (১২ জুলাই) সরেজমিনে তেলকাড়া গ্রামে মধুমতি পাড়ে গিয়ে দেখা যায় ভাঙনের ভয়াবহতা চরম আকার ধারণ করেছে। নদীপাড়ের মানুষের দুঃখ-দুর্দশার যেন শেষ নেই! বারবার ভাঙনের মুখে পড়ে অধিকাংশ পরিবার নি:স্ব ও সর্বস্বান্ত। এ দুর্যোগ মোকাবেলা করার ক্ষমতা হারিয়েছে অনেক পরিবার।
তেলকাড়া গ্রামের হাসমত সিকদার (৭০) বলেন, বারবার প্রশাসনের কর্মকর্তারা ভাঙন রোধের আশ্বাস দিয়েছেন। কিন্তু কোন প্রতিকার হয়নি। বর্ষার শুরুতে এবারও ওই এলাকায় ভাঙনের তীব্রতা বেড়ে গেছে।
তেলকাড়া গ্রামের শরিফা বেগম (৫০) বলেন, তাদের পূর্বপুরুষের ১শ বিঘা জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। অন্যের জমি বর্গা চাষ করে তাদের পরিবারের সকলের জীবন-জীবিকা নির্বাহ করতে হয়। এ পর্যন্ত তিন বার ভাঙনের শিকার হয়েছেন তাদের পরিবার। এবারও ভাঙনের মুখে পড়েছেন। কি করব ভেবে কুল পাচ্ছেন না।
তেলকাড়া গ্রামের মিজানুর রহমান বলেন, ভাঙনের কবলে পড়ে স্বাধীনতার পর থেকে শতশত পরিবার গ্রাম ছেড়ে চলে অন্যত্র চলে গেছে। অনেক আপনজন গ্রাম ছেড়ে কোথায় যে চলে গেছেন তাদের খোঁজ জানা নেই। তাদের কারো সাথে দেখা হয়েছে। কারো কারো সাথে দীর্ঘকালে আর দেখা হয়নি। সেসব আপনজনেরা কোথায়? কেমন আছে জানা নেই। আর হয়তো এ জীবনে তাদের দেখা মিলবে না।
স্থানীয় ইউপি সদস্য নান্টু সিকদার জানান, মধুমতী নদীর ভাঙনে অসংখ্য বসতবাড়ি, আবাদি জমি, স্কুল, মাদ্রাসা, মসজিদ নদীতে বিলীন হয়েছে। তিনি জানান, কয়েক বছর আগে এ ওয়ার্ডে ১ হাজার ৭শ ভোটার ছিল। জনবসতি কমে যাওয়ায় এখন মাত্র ১ হাজার ভোটার আছে। ভাঙন রোধে সরকারের পক্ষ থেকে যদি কোন ধরনের পদক্ষেপ না নেয়া হয়, কয়েক বছরের মধ্যে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যেতে পারে পুরো গ্রাম-জনপদ।
নড়াইল জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. নিজাম উদ্দিন খান নিলু বলেন, ভাঙন কবলিত এলাকার মানুষ তার সাথে একাধিকবার যোগাযোগ করেছেন। ভাঙন কবলিত এলাকা পরিদর্শন করে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তাদের এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন। সেই সাথে ওই এলাকার দলীয় নেতা-কর্মীদের সাধারণ জনগণের পাশে থাকার জন্য নির্দেশনা দিয়েছেন।
এ বিষয়ে নড়াইল পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মো. শফি উল্লাহ বলেন, নড়াইল সীমানায় মধুমতী নদী ভাঙন কবলিত যে পয়েন্টগুলো রয়েছে, সবগুলো পয়েন্টের ভাঙন রোধে সংসদের হুইপ ও নড়াইল-২ আসনের সংসদ সদস্য মাশরাফী বিন মোর্ত্তজা নিরলস ভাবে কাজ করছেন। ইতোমধ্যে প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরে আবেদন পাঠানো হয়েছে। প্রকল্প অনুমোদন হলে ভাঙন রোধে ওইসব এলাকায় কাজ করা হবে।
নড়াইল পানি উন্নয়ন বোর্ডেও নির্বাহী প্রকৌশলী উজ্জ্বল কুমার সেন বলেন, সংসদ সদস্য মাশরাফী বিন মোর্তজার প্রচেষ্টায় ইতোমধ্যে লোহাগড়া উপজেলার শালনগর ইউনিয়নের রামকান্তপুর এলাকায় ভাঙন রোধে সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে প্রকল্প অনুমোদন হয়েছে। অল্প সময়ের মধ্যে ওই এলাকায় কাজ শুরু হবে। তেলকাড়া গ্রামের মধুমতী নদী ভাঙন রোধে আপাতত কোনো বরাদ্দ নেই। এ কারণে কোনো ধরনের কাজ করা যাচ্ছে না। প্রকল্প অনুমোদনের জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরে আবেদন করা হয়েছে। প্রকল্প অনুমোদন হলে এবং বরাদ্দ পেলে আগামীতে ওই এলাকায় ভাঙন রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
