খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী ও সাতক্ষীরার সন্তান আজমাইন ইনকিয়াদ হকের নেতৃত্বে উদ্ভাবিত ‘পালসি ড্রাইভ’ জয় করেছে জাতীয় উদ্ভাবনী প্রতিযোগিতার প্রথম পুরস্কার।
হুইলচেয়ারটি পেশির সংকেত ব্যবহার করে চলাচলের সক্ষমতা এনে দিয়েছে পক্ষাঘাতগ্রস্ত মানুষের জীবনেও। এই উদ্ভাবনটি বিশেষভাবে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জীবনমান উন্নয়নে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে, যা তাদের স্বাধীনভাবে চলাচলের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেবে।
আজমাইন ইনকিয়াদ হক সাতক্ষীরা শহররে মুনজিতপুর এলাকার মৃত এ. কে. এম মইনুল হক ও রেহানা তাসলিম দম্পত্তির ছেলে।
জানা যায়, ‘পালসি ড্রাইভ’ হলো একটি অত্যাধুনিক হুইলচেয়ার, যা শরীরের যেকোনো পেশীর ক্ষুদ্রতম সংকেত ব্যবহার করে চালানো যায়। এর প্রযুক্তি মূলত সেন্সর-ভিত্তিক। এটি ব্যবহারকারীর পেশির নড়াচড়া থেকে উৎপন্ন বায়ো-ইলেকট্রিক সিগন্যাল (ঊগএ) সংগ্রহ করে। এরপর একটি মাইক্রো-কন্ট্রোলারের (অৎফঁরহড়) মাধ্যমে সেই সিগন্যালকে প্রসেস করে হুইলচেয়ারের মোটরে চলার নির্দেশ পাঠানো হয়।
এর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো- সম্পূর্ণ প্যারালাইজড বা আংশিকভাবে পক্ষাঘাতগ্রস্ত ব্যক্তিরাও এটি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন। চোখের পলক, আঙুলের সামান্য নড়াচড়া, কণ্ঠস্বর, মুখের অভিব্যক্তি, এমনকি ঘাড়ের নড়াচড়ার মতো সূক্ষ্ম শারীরিক সংকেত ব্যবহার করেই হুইলচেয়ারটি চালানো সম্ভব।
উদ্ভাবক দলের মতে, ‘পালসি ড্রাইভ’-এর প্রধান অনন্যতা হলো এটি গ্রাহকের প্রয়োজন অনুযায়ী সম্পূর্ণরূপে কাস্টমাইজযোগ্য। এটি সৌরশক্তি চালিত হওয়ায় দীর্ঘ সময় ব্যবহারের উপযোগী এবং সহজে ভাঁজযোগ্য হওয়ায় বহন ও স্থানান্তর করা সুবিধাজনক।
এই প্রযুক্তি কেবল শুরু। দলটি ভবিষ্যতে এতে ‘স্টেয়ার হুইল’ যুক্ত করার পরিকল্পনা করছে, যার ফলে ব্যবহারকারী অন্যের সাহায্য ছাড়াই সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করতে পারবেন। এছাড়া, সহজে বিচ্ছিন্ন ও সংযুক্ত করা যায় এমন কমোড (জব-ধঃঃধপযধনষব ঈড়সসড়ফব) যুক্ত করার ভাবনাও রয়েছে, যা ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত স্বাবলম্বিতা আরও বাড়াবে।
মূল্য এবং বাজারজাতকরণ পরিকল্পনা
সাধারণ মানুষের কথা ভেবেই এই হুইলচেয়ারের মূল্য নির্ধারণের পরিকল্পনা করা হয়েছে। সম্পূর্ণ নতুন একটি ‘পালসি ড্রাইভ’ হুইলচেয়ারের উৎপাদন ব্যয় পড়বে ৩০ হাজার থেকে ৮০ হাজার টাকা পর্যন্ত, যা কাস্টমাইজেশনের ওপর নির্ভর করবে।
যাদের ইতোমধ্যে হুইলচেয়ার আছে, তাদের জন্য রয়েছে আরও সাশ্রয়ী সমাধান। সেক্ষেত্রে মাত্র ১৫ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা খরচে বিদ্যমান হুইলচেয়ারে এই প্রযুক্তি যুক্ত করে নেওয়া যাবে।
দলটি জানিয়েছে, প্রকল্পের গবেষণা ও উন্নয়ন (জ্উ) পর্ব প্রায় শেষ। খুব শীঘ্রই এর টেস্ট মার্কেট শুরু হবে এবং ২০২৭-২০২৮ সালের মধ্যে এটি বাণিজ্যিকভাবে বাজারে আনার পরিকল্পনা রয়েছে। বর্তমানে দলটি টওঐচ (ইউনিভার্সিটি ইনোভেশন হাব প্রোগ্রাম।) এর সাথে কাজ করছে।
প্রকল্পের দলনেতা আজমাইন ইনকিয়াদ হক দৈনিক খবর সংযোগকে বলেন, “পালসি ড্রাইভের মাধ্যমে আমরা শুধু প্রযুক্তির উন্নয়ন নিয়ে কাজ করিনি, বরং মানুষের জীবনমান উন্নত করতে এমন এক উদ্ভাবন উপস্থাপন করেছি, যা সকল প্রতিবন্ধী ব্যক্তির জন্য একটি নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে। এই উদ্ভাবনটি মানুষের জন্য এক নতুন আশার আলো, যা তাদের স্বাধীনভাবে চলাচলের ক্ষমতা ফিরিয়ে দেবে, এমনকি যদি পুরো শরীর প্যারালাইজড থাকে।”
‘পালসি ড্রাইভ’-এর এই অভাবনীয় সাফল্য প্রমাণ করে যে, সৃজনশীলতা এবং উদ্ভাবনী চিন্তাভাবনা দেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এই প্রকল্পটি শুধুমাত্র প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতাই নয়, বরং সমাজের অন্তর্ভুক্তির দিকেও একটি বড় পদক্ষেপ।
