আজ ৭ ডিসেম্বর, গৌরবোজ্জ্বল সাতক্ষীরা মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তানি বাহিনীর হাত থেকে মুক্ত হয় সাতক্ষীরা জেলা। যথাযোগ্য মর্যাদায় ও নানা আয়োজনে ঐতিহাসিক এ দিনটি উদযাপন করেছে জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ইউনিট।
দিবসটি স্মরণে আজ রোববার (৭ ডিসেম্বর) সকালে জাতীয় পতাকা উত্তোলন, জাতীয় সংগীত পরিবেশন ও শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে নীরবতা পালন করা হয়। কর্মসূচির মধ্যে আরও ছিলো-বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা ও আলোচনা সভা। এর পাশাপাশি সাতক্ষীরা সামাজিক সংগঠনগুলোর উদ্যোগে সন্ধ্যায় শহীদ আব্দুর রাজ্জাক পার্কের শহীদ মিনারে মোমবাতি প্রজ্জ্বলন অনুষ্ঠিত হয়, যাতে শহীদদের আত্মত্যাগ ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়।
সাতক্ষীরা জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের জেলা ইউনিট আহ্বায়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা স.ম. শহিদুল ইসলাম বলেন, সাতক্ষীরায় দুটি সেক্টর ছিল-৮ ও ৯। দুই সেক্টরের যৌথ লড়াইয়েই সাতক্ষীরা মুক্ত হয়েছিল। মুক্ত দিবসে যেমন আনন্দ আছে, তেমনই আছে দুঃখ। আমাদের অনেক সহযোদ্ধা শহীদ হয়েছেন।
তিনি আরও বলেন, স্বাধীনতার পর সাতক্ষীরায় ২,৩০০–২,৪০০ মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। এখন বেঁচে আছেন মাত্র ৮০০–৮৫০ জন। তাই শহীদদের স্মৃতি ধরে রাখাটা অত্যন্ত জরুরি। নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানাতে আমাদের দায়িত্ব। এ জন্যই প্রতিবছর আমরা মুক্ত দিবস পালন করি।
সাতক্ষীরাবাসী এবং স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা বলেছেন, শহীদদের আত্মত্যাগের চিহ্ন ধরে রাখতে শহীদ স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা সময়ের দাবি। তারা মনে করেন, এটি শুধু স্থাপনা নয়, বরং গৌরব, ইতিহাস এবং প্রতিরোধের প্রতীক, যা নতুন প্রজন্মকে দেশপ্রেম ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা শেখাবে।
দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমের সীমান্তবর্তী জেলা সাতক্ষীরা পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের দেশীয় দোসরদের সাথে সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। সাতক্ষীরা শহরের পাকাপোলের মোড়ে অবস্থিত তৎকালীন বিদ্যুৎ অফিসটি বোমা মেরে উড়িয়ে দিয়েছিল। এবং তৎকালীন পাকসেনারা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল। বিনেরপোতা হয়ে খুলনা অভিমুখে পালিয়ে গিয়েছিল পাক সেনারা। এবং ৭ ডিসেম্বর সাতক্ষীরা মুক্ত হয়। সেই দিন সাতক্ষীরার প্রতিটি রাস্তাঘাট, গ্রাম-বাজার ও সীমান্ত এলাকা আনন্দমুখর হয়ে উঠেছিল। ফাঁকা গুলি ছুঁড়ে মুক্তিযোদ্ধারা শহরে প্রবেশ করেন এবং স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়িয়ে দেন। সন্তান হারানোর বেদনা ভুলে মানুষ রাস্তায় নেমে বিজয়ের উল্লাসে মেতে ওঠে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় সাতক্ষীরার মাটিতে অন্তত ৫০টির বেশি সম্মুখযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। বহু বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছেন, বহু সাধারণ মানুষ জীবন দিয়েছেন। ২ মার্চ পাকিস্তানবিরোধী মিছিলে রাজাকারদের গুলিতে শহীদ হন আব্দুর রাজ্জাক। এরপর সাতক্ষীরার তরুণেরা সংগঠিত হয়ে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নেয়। ব্যাংক থেকে অর্থ, অলংকার ও অস্ত্র সংগ্রহ করে তারা যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধে। অষ্টম ও নবম সেক্টরের অধীনে ভারতের বিভিন্ন এলাকায় প্রশিক্ষণ নেয়ার পর ২৭ মে ভোমরা সীমান্তে প্রথম সম্মুখযুদ্ধ শুরু হয়।
সাতক্ষীরার টাউন শ্রীপুর, বৈকারী, খানজিয়া এবং বিভিন্ন এলাকায় শহীদ হন ৩৩ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা। ২৯ নভেম্বর পাক বাহিনীকে অন্ধকারে ঠেলে দিতে কেন্দ্রীয় পাওয়ার হাউসে টাইম বোমা বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। এতে আতঙ্কিত হয়ে হানাদার বাহিনী পালিয়ে যায়। ৬ ডিসেম্বর রাতে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে বাঁকাল, কদমতলা ও বেনেরপোতা ব্রিজ ধ্বংস হয়। ৭ ডিসেম্বর সাতক্ষীরা পুরোপুরি শত্রুমুক্ত হয়, শহরের প্রতিটি প্রান্তে উদযাপন হয় মুক্তির উল্লাস।
