ঢাকা
সোমবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৫, ২ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
ই-পেপার

স্ত্রীর গর্ভে সন্তান রেখে শহীদ মিনারুল, সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে হাজারো চিন্তা

আপডেট : ২৩ জুলাই ২০২৫, ০৭:২১ পিএম

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারান মিনারুল ইসলাম (২৭)। গত বছরের ২০ জুলাই গুলিবিদ্ধ হলে সহযোদ্ধারা তাকে হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান এই পোশাক শ্রমিক। পরদিন মরদেহ নেওয়া হয় রাজশাহী নগরীর গুড়িপাড়া-পুরাপাড়া মহল্লায় নিজ বাড়িতে।

সে সময় তার স্ত্রী নূরেসান খাতুন ছিলেন ৭ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। বিয়ের দীর্ঘ ৮ বছর পর বাবা হওয়ার সুখবর পেলেও সন্তানের মুখ দেখা হয়নি তার। মৃত্যুর ২ মাস ৯ দিন পর স্ত্রী নূরেসান খাতুন জন্ম দেন ফুটফুটে এক পুত্রসন্তান। বাবার নামের সঙ্গে মিলিয়ে নাম রাখা হয়েছে মিনহাজুল ইসলাম সাইফান। বয়স এখন ৯ মাস। তবে ভবিষ্যতের ভয় আর শূন্যতা বয়ে বেড়াচ্ছেন মা নূরেসান খাতুন।

এদিকে মিনারুলের মা ডলি বেগম এখনও ছেলের পোশাক হাতে নিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন, কথা আটকে আসে গলায়। দুই ভাই মো. সোহেল ও নাজমুল হক অটোরিকশা চালান। মিনারুল ছিলেন পরিবারের প্রধান ভরসা। কিন্তু তার মৃত্যু নিয়েও চলে নানা নাটকীয়তা।

ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারালেও তার মৃত্যুকে সড়ক দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দিতে দেওয়া হয়। এভাবে তড়িঘড়ি করে দাফন সম্পন্ন হয়।

মিনারুল হকের ভাই মো. সোহেল জানান, ৫ আগস্টের আগে আন্দোলনে নিহতের সংখ্যা কম দেখাতে কাউন্সিলর রজব আলী ও তার ভাই রাজশাহী মহানগর যুবলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক নাহিদ আক্তার নাহান তাদের বলতেই দেননি যে মিনারুল পুলিশের গুলিতে মারা গেছেন। নানামুখী চাপে রেখেছিলেন তারা।

পরিবারের সদস্যরা জানায়, মরদেহ বাড়িতে আনার পর তৎকালীন স্থানীয় কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নেতা রজব আলী তাদের বলেন, ‘মিনারুল গুলিতে মারা গেছেন বলা যাবে না, সড়ক দুর্ঘটনা বলে দাফন করতে হবে।’ ভাই নাজমুল তখন কিছু বলার সাহস পাননি। ফলে সড়ক দুর্ঘটনা হিসেবেই দেওয়া হয় মৃত্যু সনদ।

তবে সরকার পরিবর্তনের পর নাজমুল হক ৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪ সালে সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় হত্যা মামলা করেন। মামলায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সাবেক সংসদ সদস্য শামিম ওসমান, নজরুল ইসলাম বাবু, গোলাম দস্তগীর গাজী, আব্দুল্লাহ আল কায়সার, নারায়ণগঞ্জের সাবেক মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভীসহ ১৩০ জনকে আসামি করা হয়েছে। রজব আলী, তার ভাই নাহান ও স্থানীয় যুবলীগ নেতা জাকির হোসেনকেও আসামি করা হয়। 

ওই মামলায় চলতি বছরের ৮ মে গ্রেপ্তার হন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী। এর আগে, গত বছরের ৭ আগস্ট চুয়াডাঙ্গার দর্শনা সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালাতে গিয়ে বিজিবির হাতে গ্রেপ্তার হন রজব আলী।

মামলার এজাহারে বলা হয়, ২০ জুলাই সিদ্ধিরগঞ্জের আদমজী রোডের আল আমিন নগরে আন্দোলনকারীদের ওপর আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে হামলা চালানো হয়। এ সময় মিনারুলের পেটের নিচে গুলি লাগে। আশপাশের লোকজন তাকে উদ্ধার করে শহরের খানপুরে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

স্বামী মিনারুল ইসলামের মৃত্যুর পর স্ত্রী নূরেসান খাতুন এখন গোদাগাড়ীর ফরাদপুর গ্রামে বাবার বাড়িতে থাকেন। বাবা সাইদুল ইসলাম দিনমজুর, সংসার চলে কষ্টে। তবে তিনি তারা কারও সহানুভূতি চান না, চান রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও দায়িত্ব পালন। সন্তানের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ আর বিচারহীনতার দীর্ঘসূত্রতা নিয়ে এখন নীরবে রাষ্ট্রের কাছে জবাব চাইছেন তিনি।

শহীদ মিনারুলের স্ত্রী নূরেসান বলেন, ‘স্বামী বেঁচে থাকলে ছেলেটার ভবিষ্যৎ হয়তো আলাদা হতো। এখন শুধু তাকেই আঁকড়ে ধরে আছি। সরকারের কাছে অনুরোধ-আমার ছেলেটা যেন অন্ধকারে না হারিয়ে যায়।’

নূরেসানের মা নূরমহল বেগম বলেন, ‘জামাইয়ের গুলিটা যেন আমার বুকেও লেগেছে। বিনা দোষে গুলি করে কেড়ে নিল আমাদের ছেলের জীবন। এখনো কোনো বিচার হয়নি। শেখ হাসিনার বিচার চাই আমরা।’

‘সরকার থেকে পাওয়া ৫ লাখ টাকার একাংশ মিনারুলের মাকে দেওয়া হয়েছে, বাকিটা রাখা হয়েছে সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য’, জানান নূরেসানের বাবা সাইদুল ইসলাম।

NJ/FJ
আরও পড়ুন