ঢাকা
সোমবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৫, ২ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
ই-পেপার

চলনবিলে বিলুপ্তি প্রায় ৯০ প্রজাতির মাছ 

আপডেট : ১২ আগস্ট ২০২৫, ০৬:৩৩ পিএম

মিঠাপানির ২৬০ প্রজাতির মাছের মধ্যে চলনবিলেই পাওয়া যেত ১৩০ প্রজাতি। গত তিন দশকে তা কমে ৪০ প্রজাতিতে নেমে এসেছে। স্থায়ীভাবে বিলুপ্ত হয়েছে ধোঁদা, গুড়পুঁই, বাছা, ব্যাইটকা, গজার, শিলং, ট্যাংড়া, ভেদা, শংকর, ফাঁদা, টিপপুঁটি ও পানি রুইয়ের মতো ১১ প্রজাতির মাছ।

চলনবিল সংশ্লিষ্ট মৎস্য অফিসগুলোর দেওয়া তথ্যমতে, চলনবিল অঞ্চলে ১৭৫৭ হেক্টর আয়তনের ৩৯টি বিল, ৪২৮৬ হেক্টর আয়তন বিশিষ্ট ১৬টি নদী এবং ১২০ বর্গ কিলোমিটার আয়তন বিশিষ্ট ২২টি খালের মিঠাপানিতে ১৩০ প্রজাতির মাছের বংশবিস্তার ছিল।

নদীনালা, খালবিল দখল-দূষণ করায় মাছ কমছে আশঙ্কাজনক হারে। বিশেষ করে প্রজনন মওসুমে প্রজনন বাধাগ্রস্থকরে নিষিদ্ধ পন্থায় মা মাছ শিকার এবং পোনা নিধন অব্যহত রাখায় ৯০ প্রজাতির মাছ বিলুপ্তপ্রায়।

খুব কম দেখা মিলছে মেনি, পুঁইয়া, চিতল, ফোলি, চিংড়ি, ভেদা, বেলে, পাবদা, কাঁচকি, চাঁদা, মলা-ঢেলা, দাঁড়কিনা, বৌমা, ঘাড়ুয়া, ভাঙ্গন, কালিবাউশ, বাঁশপাতা, পাঙাসসহ অন্তত ৪০ প্রজাতির মাছের।

চলনবিল নিয়ে লেখা বিভিন্ন প্রবন্ধে আত্রাই, নন্দকুঁজা, গুমানী, গুড়, করতোয়া, বড়াল, তুলসি চেঁচিয়া, ভাদাই, চিকনাই, বানগঙ্গা, নবীরহাজির জোলা, হকসাহেবের খাল, নিমাইচড়া খাল, বেশানীর খাল, গুমানী খাল, উলিপুর খাল, সাঙ্গুয়া খাল, দোবিলা খাল, কিশোরখালির খাল, বেহুলারখাড়ি, বাকইখাড়া, গোহালখাড়া, গাড়াবাড়ি খাল, কুমারভাঙ্গা খাল, জানিগাছার জোলা, সাত্তার সাহেবের খাল, কিনু সরকারের ধরসহ অসংখ্য নদী-নালা, খাল ও পানির আধারের হদিস মেলে। তবে বর্তমানে এসব খালবিল জলাশয়ের কোনো অস্তিত্ব নেই। এসব উৎসেই প্রচুর পরিমাণে দেশীয় মাছের আনাগোনা ছিল।

চলনবিল এলাকার বাসিন্দারা জানান, একসময় বিলের উন্মুক্ত জলরাশিতে মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করতেন জেলেরা। তবে সময়ের বিবর্তনে মাছের সাথে বিলুপ্ত হয়েছে জেলেদের পেশাও। এখন বানের পানি এলেই শুরু হয় নিষিদ্ধ সব উপকরণ দিয়ে মাছ শিকার। মাছের পোনা থেকে শুরু করে কাঁকড়া, শামুক-ঝিনুক পর্যন্ত নিধন করা হয়। অথচ স্থানীয় প্রশাসন মাছ রক্ষায় কার্যত তেমন কোনো ব্যবস্থা নেয় না। এইকারনে চলনবিল এখন মাছ শূন্যের পথে।

চলনবিল যে সত্যি মাছ শূন্যের পথে তা বোঝা গেল সম্প্রতি পলো উৎসবে। রংপুর-গাইবান্ধা থেকে শৌখিন শিকারি মাছ শিকারে চলনবিলে এসে উল্লেখযোগ্য কোনো মাছ পাননি। তবে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত প্রাণপণ চেষ্টায় ৩টি ছোট বোয়াল নিয়ে ফিরেছেন প্রায় দেড় হাজার শিকারি।

মাছ ধরতে আসা ব্যক্তিরা জানান, বর্ষায় কানায় কানায় পূর্ণ থাকে চলনবিল। প্রচুর পরিমাণে দেশীয় মাছের দেখা মেলে। স্বাদেও অনন্য এই মাছ। এমন সব গল্প শুনে আসছেন ছোটবেলা থেকে। দেশের বৃহৎ সেই বিলে মাছ শিকার করতে এসে হতাশ হয়েছেন তারা। দু-একজন ছোট বোয়াল, টাকি পেলেও বেশির ভাগ শিকারি মাছ পাননি। এতে তারা রীতিমতো বিস্মিত।

বাংলাদেশ সরকারের চলনবিল মৎস্য প্রকল্প থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী এক সমীক্ষায় দেখা যায়, ১৯৮২ সালে মোট ১ লাখ ৭৭ হাজার ৬১ জেলে চলনবিলের নদ-নদী ও খাল-জলাশয়ে মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। মাছ কমায় পর্যায়ক্রমে জেলের সংখ্যা কমতে কমতে ২০০৬ সালে ৭৫ হাজারে দাঁড়ায়।

তবে মিঠাপানির দেশীয় মাছ সংরক্ষণে আশার কথা শোনালেন সিরাজগঞ্জের জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. শাহিনূর রহমান।

তিনি বলেন, চলনবিলে অন্তত ১৪৭টির বেশি মৎস্যঘের রয়েছে। সময়মতো বানের পানি না আসায় এসব ঘেরেও সুবিধা মিলছে না। তাছাড়া প্রজনন বাধাগ্রস্থ করে মাছ শিকার, খালবিল দখল-দূষণ, ভরাট, অতিরিক্ত রাসায়নিক প্রয়োগ- এমন নানা কারণে চলনবিল থেকে দেশীয় প্রজাতির বহু মাছ বিলুপ্তপ্রায়।

দেশীয় এসব মাছ রক্ষায় সিরাজগঞ্জ, পাবনা ও নাটোর অঞ্চল নিয়ে একটি বিশেষ প্রকল্প গ্রহণ করতে যাচ্ছেন তারা। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা গেলে চলনবিলের বিলুপ্তপ্রায় মাছগুলো আবার ফিরিয়ে আনা সম্ভব। তবে মাছ রক্ষায় মৎস্য প্রাণিসম্পদ ও কৃষি বিভাগের সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন।

এ প্রসঙ্গে অতিরিক্ত মৎস্য কর্মকর্তা মো. শরিফুল ইসলাম বলেন, তাড়াশ উপজেলার চলনবিলের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালানো হচ্ছে। এই অভিযান অব্যাহত থাকবে। তাছাড়া বিভিন্ন বাজারে জনসাধারণকে সচেতন করতে লিফলেট বিতরণ, পথসভা সহ বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে।

এ বিষয়ে তাড়াশ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নুসরাত জাহান বলেন, চলনবিলে পানি আসার সাথে সাথেই ডিমওয়ালা বিভিন্ন প্রজাতির দেশীয় মাছ দেখা যাচ্ছে। কিছু অসাধু ব্যক্তি সেই মাছগুলো নিধন করছে। মাছের প্রজনন মৌসুমে নিয়মিত প্রশাসনের অভিযান চালানো হচ্ছে। প্রাকৃতিক মাছের প্রজনন ক্ষেত্র সংরক্ষণ করতে না পারলে চলনবিলে মাছ সংকট দেখা দিবে।

NJ
আরও পড়ুন