ঢাকা
মঙ্গলবার, ১৮ নভেম্বর ২০২৫, ২ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
ই-পেপার

লোডশেডিংয়ে অতিষ্ঠ রংপুরের জনজীবন

আপডেট : ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৯:৪৬ এএম

চলমান পরিস্থিতিতে সারাদেশের মধ্যে রংপুর বিভাগে সবচেয়ে বেশি লোডশেডিং দেওয়া হচ্ছে বলে দাবি করছেন সাধারণ মানুষসহ সচেতন মহল। যা একেবারে অসহনীয় পর্যায়ে ঠেকেছে। শুধু জীবনই অতিষ্ঠ নয়। প্রভাবে বিলাস বহুল শপিংমল, বিপণী বিতানে মন্দাভাব হতে চলেছে। 

তীব্র গরমে অসুস্থ হয়ে রমেক হাসপাতালসহ বিভাগের বিভিন্ন হাসপাতাল, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোতে অন্তত হাজারও শিশুসহ নারী-পুরুষ ভর্তি হয়েছেন। স্থবির হয়ে পড়েছে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ ছোট বড় শত শত কলকারখানা। ব্যঘাত ঘটছে উৎপাদন কার্যক্রমে। 

গ্যাস ও ডিজেল সংকটসহ বিদ্যুৎ উৎপাদনে কিছু জায়গায় ব্যাঘাত ঘটায় চাহিদার তুলনায় কম বিদ্যুৎ মিলছে রংপুরে। এ কারণে রংপুর বিভাগে ঘন ঘন লোডশেডিং হচ্ছে বলে দাবি করছেন সংশ্লিষ্টরা। 

সংশ্লিষ্ট বিদ্যুৎ অফিস তথ্য সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে রংপুর ও রাজশাহী বিভাগের ১৬ জেলায় নেসকো ও পল্লী বিদ্যুতের চাহিদা ২ হাজার ৬০০ থেকে ২ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট। তবে সরবরাহ মিলেছে এক হাজার ৭০০ থেকে এক হাজার ৮০০ মেগাওয়াট। যা চাহিদার তুলনায় ঘাটতি প্রায় ৯০০ মেগাওয়াটের ঊর্ধ্বে। অন্যদিকে রংপুর বিভাগের ৮ জেলায় পল্লী বিদ্যুৎ ও নেসকো মিলে চাহিদা এক হাজার ২০০ মেগাওয়াট। সেখানে মিলেছে ৮০০ মেগাওয়াটেরও কম। যা চাহিদার তুলনায় ঘটতি ৪০০ মেগাওয়াটের বেশি।

হঠাৎ করে কোনো ঘোষণা ছাড়াই চলছে ঘন ঘন লোডশেডিং। টানা এক সপ্তাহেরও বেশিদিন ধরে এ অবস্থা চলছে রংপুর বিভাগে। শহরে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১২-১৪ ঘণ্টা বিদ্যুৎ মিললেও গ্রামে দিনরাত মিলে ৮-১০ ঘণ্টারও কম সময় বিদ্যুৎসেবা পাচ্ছেন গ্রাহকরা। বাকি সময়টা অস্বাভাবিক লোডশেডিংয়ে হাঁপিয়ে উঠছে জনজীবন। রংপুরসহ বিভাগের পুরো আট জেলার নগর-বন্দর, হাট-বাজার ও গ্রামে বিদ্যুতের এমন ভেলকিবাজিতে নাভিশ্বাস ওঠেছে সব বয়সী মানুষের মাঝে।

ঘণ্টায় ঘণ্টায় বিদ্যুতের যাওয়া-আসার কারণে গ্রাহকের মাঝে চরম ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। অব্যাহত এই লোডশেডিংয়ে রংপুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির ১ ও ২ এর গ্রাহকসহ রংপুর বিভাগের প্রায় ১ কোটি গ্রাহকের দুর্ভোগ চরমে। এদিকে কয়েকদিনের বৃষ্টির পর ভাদ্রের ক্রান্তিলগ্নে মৃদু তাপদাহ চলছে এ অঞ্চলে। এ অবস্থায় তাপপ্রবাহের ধকলের সঙ্গে অসহনীয় লোডশেডিংয়ে অস্বস্তি আরও বেড়েছে। সবচেয়ে বেশি সমস্যা হচ্ছে বয়স্ক ও শিশুদের। বাড়ছে মৌসুমজনিত জ্বর, সর্দি ও অসুস্থতা। তারা দ্রত সময়ের মধ্যে লোডশেডিং বন্ধ করাসহ সুষ্ঠু সমাধান চেয়ে সংশ্লিষ্টদের জরুরি হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। লোডশেডিংয়ের সঙ্গে যোগ হওয়া প্রচণ্ড গরমে হাপিতাস করছে পুরো বিভাগ।

লোডশেডিংয়ের প্রভাবে বিলাস বহুল শপিংমল, বিপণী বিতানসহ ছোট-বড় মার্কেটগুলোতে বেচাকেনায় মন্দাভাব দেখা গেছে। অভিযোগ রয়েছে, লোডশেডিং হয়ে তা কখনো কখনো এক থেকে দেড় বা দুই ঘণ্টা পর্যন্ত স্থায়ী হচ্ছে। অব্যাহত লোডশেডিংয়ের কারণে বাড়ছে হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনাও। গেল কয়েকদিনে রংপুর মেডিকেল কলেজ (রমেক) হাসপাতালসহ বিভাগের বিভিন্ন হাসপাতাল, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিভিন্ন জেলার অন্তত ২০০ শতাধিকেরও বেশি শিশুসহ নারী-পুরুষ ভর্তি হয়েছেন। যাদের বেশির ভাগই আবহাওয়া পরিবর্তনজনিত জ্বর, সর্দি ও হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত। 

গ্রাহকরা অভিযোগ করে বলেন, পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি গ্রাহকের কাছে ইচ্ছেমত বিল আদায় করছে। মিটার ভাড়া ও ডিমান্ড চার্জ নিচ্ছে। যা একেবারেই অযৌক্তিক। অথচ সেবার মান নেই। ঘন ঘন বিদ্যুৎ যাওয়া-আসা করে। এতে গ্রাহকরা নানা সমস্যায় পড়েছেন।

কয়েকদিনের গরমের সঙ্গে অব্যাহত লোডশেডিংয়ের কারণে অনেকের ফ্রিজ, টিভিসহ অন্যান্য বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিটি সমিতির আওতায় গড়ে ৫ থেকে ৭ লাখ গ্রাহক এবং ৮ থেকে ১০ হাজার কিলোমিটারের বেশি বৈদ্যুতিক লাইন রয়েছে। প্রতিটি সমিতিতে বিদ্যুতের চাহিদা গড়ে ৭০ থেকে ১২০ মেগাওয়াট পর্যন্ত। কিন্তু চাহিদার অনেক কম বিদ্যুৎ পাচ্ছে সমিতিগুলো। ঘাটতি থেকে যাচ্ছে ৩০-৪০ মেগাওয়াট। একই অবস্থা রংপুরসহ বিভাগের আট জেলার পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির।

রংপুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১ এর গ্রাহক পীরগাছা উপজেলা কান্দি বাজার এলাকার রবিউল আলম বিপ্লব বলেন, একদিকে গরম আর অন্যদিকে পল্লী বিদ্যুতের ঘনঘন যাওয়া-আসা। প্রতিদিন-রাত মিলে ৮ ঘণ্টাও বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক থাকছে না। এতে আমরা অতিষ্ঠ। বার বার বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে জানানো হলেও কোনো প্রতিকার পাইনি। 

রংপুর নগরীর নজিরেরহাট এলাকার গ্রাহক ফিরোজ মিয়া বলেন, প্রতিদিন গড়ে ১০-১২ বার লোডশেডিং হচ্ছে। বিদ্যুৎ না থাকায় ফ্রিজসহ বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ফ্রিজে রাখা খাবার নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। 

নগরীর হাজীপাড়া শাপলা চত্বর এলাকার ব্যবসায়ী মফিজাল হোসেন বলেন, গত ১৫ বছর ধরে শুধু বিদ্যুতের উন্নতি কথা শুনেছি। এখন হাসিনার পতনের পর তা বাস্তবে দেখছি। গত ১০-১২ বছরে এভাবে কখনো বিদ্যুৎ যাওয়া-আসা করেনি। বিদ্যুৎ কখন যাবে আর কখন আসবে তাও বলা মুশকিল। প্রচণ্ড গরম আর লোডশেডিংয়ে জীবন শেষ। দোকানে বসে থাকাও সম্ভব হচ্ছে না। অসহ্য লোডশেডিংয়ের কারণে ব্যবসার অবস্থাও খারাপ।

রংপুর বিদ্যুৎ বিভাগের নর্দার্ন ইলেক্ট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি (নেসকো) সূত্র বলছে, জাতীয় গ্রিড থেকে চাহিদার তুলনায় অনেক কম বিদ্যুৎ পাওয়ায় ঘন ঘন লোডশেডিং দিতে হচ্ছে। অবস্থা স্বাভাবিক হতে কত দিন সময় লাগবে তা জানাতে পারেননি কোনো কর্মকর্তা। এদিকে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিগুলো জানিয়েছে, চাহিদার তুলনায় বরাদ্দ কম পাওয়ায় লোডশেডিং করতে হচ্ছে। এ ছাড়া প্রায়ই বৈদ্যুতিক লাইনে ত্রুটি দেখা দিচ্ছে। এসব কারণে ঠিকমতো বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যাচ্ছে না। গড়ে ৭০ থেকে ১২০ মেগাওয়াট পর্যন্ত চাহিদার অনেক কম বিদ্যুৎ পাচ্ছে সমিতিগুলো।

রংপুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২ এর জিএম মো. খুরশীদ আলমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, চাহিদার তুলনায় বরাদ্দ কিছুটা কম পাওয়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। বরাদ্দ ঠিকমতো পেলে গ্রাহকের আর সমস্যা থাকবে না।

রংপুর বিদ্যুৎ বিতরণ বিভাগের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী ইকবাল হোসেন জানান, চাহিদার তুলনায় বরাদ্দ কম পাওয়ায় লোডশেডিং হচ্ছে। অবস্থা উত্তরণের জন্য চেষ্টা চলছে। বৈরি ওয়েদারের কারনে লাইন ফল্ট হচ্ছে, ভোগান্তি বাড়ছে। খুব দ্রুত সম্ভবত সবকিছু টিক হয়ে যাবে।

এদিকে রংপুর আবহাওয়া অফিসের ইনচার্জ আবহাওয়াবিদ মোস্তাফিজার রহমান জানান, বিগত ৩ দিন হতে (সোমবার ৯ সেপ্টেম্বর) রংপুরে সরর্বাচ্চে ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। কয়েকদিন ধরে রংপুর অঞ্চলে তাপমাত্রা ৩২-৩৬ ডিগ্রিতে ওঠা-নামা করছে। ফলে মৃদু দাবদাহ অনুভূত হচ্ছে। আপাতত বৃষ্টির সম্ভাবনা নেই। তবে আগামী সপ্তাহের শুরুর দিকে বৃষ্টি হতে পারে। 

AHA/FI
আরও পড়ুন