জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ভালোই চলছিল সাত কলেজের খেতাব পাওয়া ঢাকার ঐতিহ্যবাহী কলেজগুলো। হঠাৎ করেই প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বতন্ত্র পরিচয় দেওয়ার ভুত চাপে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের করে আনা হয় সাত কলেজকে। করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাধীন। কলেজগুলো এখন সবার গলার কাঁটা। কোনোভাবে ছন্দ ফিরিয়ে আনা যাচ্ছে না সাত কলেজে। কীভাবে ছুটবে এই গেরো জানে না কেউ।
কেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে অধিভুক্তি?
এক সময় দেশের সব ডিগ্রি কলেজ পরিচালিত হতো ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে। ১৯৯২ সালে সরকারি কলেজগুলোকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রণ থেকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করে তখনকার বিএনপি সরকার।
কিন্তু বিপুল সংখ্যক কলেজ সামলাতে গিয়ে হিমশিম দশা হয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের। সময়মতো পরীক্ষা নেওয়া বা ফল প্রকাশ করতে না পারায় দেখা দেয় দীর্ঘ সেশনজট। অ্যাকাডেমিক কার্যক্রমে দেখা দেয় স্থবিরতা। সনদের মান নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। চাকরির ক্ষেত্রে বৈষম্যের অভিযোগ তুলে শিক্ষার্থীরা তখনো রাস্তায় নেমেছিলেন।
২০১৪ সালের শেষ দিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় পরিদর্শনে গিয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ২৭৯টি সরকারি কলেজকে বিভাগীয় পর্যায়ের পুরনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করার নির্দেশ দেন তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরের বছর তিনি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সঙ্গে এক বৈঠকে সরকারি কলেজগুলোকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আনার প্রক্রিয়া ত্বরাণ্বিত করার তাগিদ দেন।
এর ধারাবাহিতায় ২০১৭ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নেওয়া হয় রাজধানীর ঐতিহ্যবাহী ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, কবি নজরুল কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ, মিরপুর সরকারি বাঙলা কলেজ ও সরকারি তিতুমীর কলেজকে।
সিদ্ধান্ত হয়, এসব কলেজে ভর্তি পরীক্ষা, পাঠ্যসূচি ও পরীক্ষা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরিচালিত হবে। সে সময় দেশের অন্য সরকারি কলেজগুলোকেও ধারাবাহিকভাবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করার সিদ্ধান্ত ছিল। কিন্তু সাত কলেজের পর সেই উদ্যোগ আর এগোয়নি।

সাত কলেজের অধিভুক্তির ফলাফল শূন্য
সাত কলেজকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করার পর শিক্ষার্থীদের মধ্যে শুরুতে বেশ উচ্ছ্বাস দেখা গিয়েছিল। তবে কিছুদিন না যেতেই তারা নানা সমস্যা তুলে ধরতে শুরু করেন। সেগুলোর সমাধান চেয়ে রাজপথে শুরু হয় আন্দোলন।
সে সময় দীর্ঘমেয়াদী কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই সাত কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নেওয়ায় প্রশাসনিক ও অ্যাকাডেমিক বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিতে থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ভবনে হয়রানি, অ্যাকাডেমিক ক্যালেন্ডার প্রকাশ না করা, সেশনজট, ফল প্রকাশে দীর্ঘসূত্রতা, ত্রুটিপূর্ণ ফলাফল প্রকাশ, রেকর্ড সংখ্যক শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হওয়া– ইত্যাদি সমস্যা নিয়ে আন্দোলন করতে দেখা যায় শিক্ষার্থীদের।
তাদের শিক্ষাঙ্গনে ফেরাতে বিভিন্ন সময়ে নানা পদক্ষেপ ঘোষণা করা হলেও কিছু সমস্যা এতটাই জটিল রূপ পায় যে অধিভুক্তির পর সাত বছরেও কলেজগুলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থিতু হতে পারেনি। জুলাই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সরকার পরিবর্তন হওয়ার পর অধিভুক্তি বাতিলের দাবিতে আন্দোলন জোরালো হয়েছে।

সবশেষ গত রোববার দিনভর রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে আন্দোলনে নামে সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা। ভর্তি পরীক্ষায় কোটা পদ্ধতি বাতিলসহ বিভিন্ন দাবিতে রাজধানীর শাহবাগ, সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড় ও মিরপুর সড়কের টেকনিক্যাল মোড় অবরোধ করতে শুরু করেন তারা।এর ফলে আশপাশের সড়কগুলোয় তীব্র যানজট তৈরি হয়েছে, ভোগান্তিতে পড়ে মানুষ। রাতে তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায়।
সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের ভাষ্য, দাবি-দাওয়া জানাতে তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক মামুন আহমেদের কাছে গিয়েছিলেন। কিন্তু উপউপাচার্য তাদের অপমান করেছেন। তার প্রতিবাদ জানাতেই সড়কে নেমেছেন তারা। সাত কলেজের এসব আন্দোলন কবে থামবে তা বলতে পারছে না কেউই।
সরকার কী করছে?
গত ২৪ অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সাতটি কলেজের অ্যাকাডেমিক ও প্রশাসনিক সমস্যা নিরসনকল্পে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবকে সভাপতি করে ১৩ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। তবে ওই কমিটি শিক্ষার্থীরা প্রত্যাখ্যান করে, ‘বিশ্ববিদ্যালয় রূপান্তর কমিশন’ গঠনের দাবি জানায়।
পরে সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের দাবি পর্যালোচনা ও সুপারিশ সংক্রান্ত কমিটি করা হয়। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনা করেই সমাধান খোঁজার চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছেন কমিটি সংশ্লিষ্টরা।

সাত কলেজ নিয়ে গত বছরের ৩০ অক্টোবর একটি বিবৃতি দেন শিক্ষা ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। বিবৃতিতে তিনি বলেন, সমস্যাটির শুরু হয়েছে কয়েক বছর আগে ঢাকার সাতটি কলেজকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতা থেকে বের করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত করার একটি অবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্তের মাধ্যমে। এর ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাত কলেজ– উভয় পক্ষেরই সমস্যা তৈরি হয়েছে। যে কারণে ওই সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের নানা অসুবিধা ও বৈষম্যের শিকার হতে হয়েছে।
সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের মূল দাবি, তাদের জন্য একটি স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন। এ বিষয়ে এখনো একমত হননি সংশ্লিষ্টরা। সাত কলেজের আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ৩১ অক্টোবর বৈঠক করেন শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ এবং যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া।
বৈঠকে গৃহীত সিদ্ধান্ত তুলে ধরেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। তিনি বলেন, সাত কলেজ ঢাবির অধীনেই থাকবে। ঢাবির মধ্যে তাদের জন্য আলাদা একটি জায়গা ঠিক করা হবে, যেখানে প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডগুলো করা হবে। তাদের আলাদা রেজিস্ট্রার, কর্মকর্তা থাকবে। বিষয়গুলো ঢাবি ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সঙ্গে কথা বলেই করা হবে।
তবে ১ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এক বিবৃতির মাধ্যমে জানায়, তারা এ সমস্যা সমাধানে শিক্ষার্থীসহ গুরুত্বপূর্ণ অংশীজনদের সঙ্গে আরো আলোচনা করতে চায়।

সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ
সরকার ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা আশ্বাস সন্তুষ্ট করতে পারছে না সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের। তাদের দাবি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্তি বাতিল এবং স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠঅ করা না হলে সাত কলেজের সমস্যাগুলো দূরীভূত হবে না।
স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি কল্পিত মডেল উপস্থাপন করেছেন আন্দোলনের কয়েকজন ‘ফোকাল পার্সন’। তারা বলেন- আমরা একটি স্বতন্ত্র পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয়ে ভাবছি, যেখানে আমরা একেকটি বিভাগ একেকটি কলেজে রাখতে চাচ্ছি। যেমন ঢাকা কলেজে কিছু ডিপার্টমেন্ট, ইডেন কলেজে কিছু ডিপার্টমেন্ট, কবি নজরুল কলেজে কিছু ডিপার্টমেন্ট। একইভাবে অন্য কলেজগুলোতে নতুন এই বিশ্ববিদ্যালয়টির ক্যাম্পাস বিস্তৃত হবে। যার নাম হতে পারে সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ।
তবে শিক্ষার্থীদের এমন ভাবনার বিষয়ে সরকারের তরফ থেকে কোনো মন্তব্য আসেনি। কবে হবে এই সমস্যার সমাধান? নাকি হবেই না।
