বাংলা সংগীতাঙ্গনের উজ্জ্বলতম নক্ষত্রদের একজন ফরিদা পারভীন। শুধুমাত্র লালনগীতি নয়, আধুনিক ও দেশাত্মবোধক গানেও যিনি নিজের একক পরিচয় গড়েছেন। চার দশকেরও বেশি সময় ধরে বাঙালির হৃদয় জয় করেছেন তার কণ্ঠের মাধুর্যে।
‘এই পদ্মা, এই মেঘনা’, ‘তোমরা ভুলেই গেছো মল্লিকাদির নাম’, ‘নিন্দার কাঁটা যদি না বিঁধিল গায়ে প্রেমের কী সাধ আছে বলো’, ‘খাঁচার ভিতর’, ‘বাড়ির কাছে আরশি নগর’ এমন অনেক গানেই ভেসে ওঠে তার আবেগময় গায়কী, যা দর্শক-শ্রোতাদের অন্তরে গেঁথে গেছে।
ফরিদা পারভীনের গানের জগৎ কেবল মঞ্চ আর টিভিতেই সীমাবদ্ধ নয়, তিনি অডিও অ্যালবামেও রেখেছেন দুর্দান্ত উপস্থিতি।
তার উল্লেখযোগ্য কিছু অ্যালবাম হলো-
- অচিন পাখি (১৯৭৬, স্পন্সর: শ্রোতার আসর / এসিআই)
- লালনগীতি (ডন কোম্পানি)
- লালনের গান (সারগাম)
- দেশাত্মবোধক/আধুনিক/লালন (দোয়েল প্রডাক্টস)
- আমারে কি রাখবেন গুরু চরণে (আরশিনগর)
- সময় গেলে সাধন হবে না (বেঙ্গল ফাউন্ডেশন)
- আশা পূর্ণ হলো না (আবুল উলাইয়া পরিবেশনা)
- লাইভ কনসার্ট ইন জাপান
- হিট সঙস অব ফরিদা পারভীন : মিলেনিয়াম / বহুদিন হলো ভেঙেছি ঘর
- লাইভ কনসার্ট ইন ফ্রান্স (প্রকাশের অপেক্ষায়)
পুরস্কার ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি
সংগীতে অবিস্মরণীয় অবদানের জন্য ফরিদা পারভীন পেয়েছেন একাধিক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সম্মাননা-
- একুশে পদক (১৯৮৭)
- জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার – শ্রেষ্ঠ নারী কণ্ঠশিল্পী (চলচ্চিত্র: অন্ধ প্রেম, ১৯৯৩)
- ফুকুওয়াকা এশীয় সাংস্কৃতিক পুরস্কার (২০০৮)
- সিটিসেল-চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাওয়ার্ডস
- অনন্যা শীর্ষ দশ পুরস্কার
একই কণ্ঠে লালন, দেশপ্রেম আর আধুনিকতার সুর
যেখানে অনেক শিল্পী একটি নির্দিষ্ট ধারার সংগীতে সীমাবদ্ধ, ফরিদা পারভীন সেখানে একাধারে লালনের আধ্যাত্মিক গান, স্বাধীনতা ও দেশপ্রেমের জাগরণ এবং আধুনিক প্রেম-বিরহের সুর সবকিছুই গেয়েছেন সমান দক্ষতায়।
তাঁর সংগীত চর্চা কেবল গান গাওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় প্রতিটি গান তিনি উপস্থাপন করেছেন তার মর্মবাণী বোঝার গভীর উপলব্ধি নিয়ে। সেই কারণেই শ্রোতারা তার কণ্ঠে শুধু গান নয়, খুঁজে পান দর্শন, দেশপ্রেম আর মানবিকতার সুর।
ফরিদা পারভীন কেবল একজন কণ্ঠশিল্পী নন, তিনি বাংলা সংগীতের এক জীবন্ত অধ্যায়। তার সুর, তার কণ্ঠ, তার বোধ সবকিছুই মিশে আছে বাংলা গানের ঐতিহ্যে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মও তাকে মনে রাখবে এক অনন্য সাংস্কৃতিক সম্পদ হিসেবে।
গত ৫ জুলাই গুরুতর অসুস্থ হয়ে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন ফরিদা পারভীন। অবস্থার অবনতি হলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সমন্বয়ে মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়। কিছুটা সুস্থ হয়ে ২১ জুলাই তিনি বাড়ি ফেরেন। তবে ২ সেপ্টেম্বর ফের অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। শারীরিক অবস্থার ক্রমাগত অবনতির কারণে ১০ সেপ্টেম্বর থেকে তিনি লাইফ সাপোর্টে ছিলেন।
সবশেষ শনিবার রাত ১০টা ১৫ মিনিটে রাজধানীর ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৭১ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। তার মৃত্যুতে লালনসঙ্গীত হারাল এক সুধাময় কণ্ঠ, আর বাঙালি হারাল এক সাংস্কৃতিক সম্পদ।
লালনশিল্পী ফরিদা পারভীন আর নেই
কিংবদন্তি ফরিদা পারভীনের মৃত্যুতে তারেক রহমান ও মির্জা ফখরুলের শোক
ফরিদা পারভীনের দাফন কুষ্টিয়ায়