ঢাকা
মঙ্গলবার, ১৮ নভেম্বর ২০২৫, ২ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
ই-পেপার

বটগাছের ছায়া: আমার বাবার গল্প

আপডেট : ১৫ জুন ২০২৫, ০৯:৩৬ এএম

বিশ্ব যখন পিতৃত্ব উদযাপন করছে, আমি ডুবে আছি স্মৃতির গভীরে। ভাবছি আমার বাবা, মো. আবুল কাশেমকে নিয়ে। তিনি ছিলেন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, একজন স্নেহময় পিতা, এক নিঃশব্দ দিকনির্দেশক।

এই বিশেষ দিনটি প্রতিবছর আসে জুনের তৃতীয় রবিবারে। সন্তানেরা জানায় কৃতজ্ঞতা, ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা।
কেউ উপহার দেয়, কেউ ছবি পোস্ট করে, কেউবা চুপিচুপি শুধু স্মরণ করে।

আমি বাবার একটি ছবি শেয়ার করেছি সামাজিক মাধ্যমে।
ছবির দিকে তাকিয়ে মনে হলো- তিনি যেন এখনো আমাদের মাঝে আছেন।
তিনি ছিলেন আমাদের ছায়া। সেই গভীর, বিস্তৃত ছায়া যা গ্রীষ্মের বিকেলে শান্তি দেয়।

বাবার ভালোবাসা ছিল নীরব:
মায়েরা আবেগ দেখান প্রকাশ্যে।
বাবারা করেন না।
তবু তারাই শক্ত ভরসা।
আমার বাবা কম কথা বলতেন।
কখনো নিজের ভালোবাসা মুখে আনেননি।
তবুও তাঁর প্রতিটি সিদ্ধান্ত, প্রতিটি ত্যাগে ছিল নিঃস্বার্থ মমতা।

আমি এখন নিজেও একজন বাবা।
বাবা হওয়ার পর বুঝেছি- কতটা বড় তার ছায়া ছিল।
কতটা দৃঢ়, কতটা নিঃশব্দ।

একটা কথা প্রায়ই মনে পড়ে যায়-
"বাবার ছায়া শেষ বিকেলের বটগাছের মতো।
সে নিজের সব ক্লান্তি রেখে ঢেকে রাখে সন্তানের মঙ্গলছায়া হয়ে।"

যুদ্ধের দিনগুলো:
বাবা ছিলেন পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে কর্মরত।
১৯৭১ সালে করাচিতে ছিলেন তিনি।
সেখানে পাকিস্তানি সেনারা তাকে নজরদারিতে রেখেছিল।

অক্টোবর মাসে তিনি সাহস করে পালান।
ভারতে যান।
সেখানে সেক্টর-২-এ মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন।
তিনি ছিলেন অস্ত্র প্রশিক্ষক।

তার জ্ঞান, দেশপ্রেম আর সাহস তাকে করে তুলেছিল অমূল্য।
কারও বাহবা চাওয়ার লোক ছিলেন না তিনি।
চেয়েছেন শুধু কর্তব্য পালন করতে।

যুদ্ধ-পরবর্তী জীবন:
স্বাধীনতার পর তিনি আবার বিমান বাহিনীতে যোগ দেন।
১৯৮৪ সালে অবসর নেন।
অবসরের পরও তিনি চুপ করে বসে থাকেননি।
শিক্ষা, সমাজসেবা, এলাকার উন্নয়নে যুক্ত ছিলেন।

তিনি ছিলেন করাচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দ্বৈত এমএ সম্পন্ন করা প্রথম ব্যক্তি আমাদের এলাকায়।
ছিলেন শিক্ষানুরাগী, কঠোর পরিশ্রমী ও অসাধারণ বিনয়ী।
১৯৯০ সালে তিনি আমাদের ছেড়ে চলে যান।

মায়ের অবদান:
বাবার মৃত্যুর পর মা আমাদের আগলে রেখেছেন।
তিনি হয়েছিলেন দ্বিতীয় পাহাড়,
যিনি সব ধাক্কা নিজে সামলে আমাদের দাঁড় করিয়েছেন।
আমরা কেশবপুরের মঙ্গলকোট গ্রামে চলে যাই।
সোনারগাঁ হয়ে ওঠে দূরের শহর।
স্মৃতিভারে ভারী, বিষণ্ণ।

উত্তরাধিকার:
আমরা বাবার সঙ্গে বেশি সময় পাইনি।
তবু তার আদর্শ আজও আমাদের পথ দেখায়।
তিনি ছিলেন সাহসের প্রতীক,
শান্ত আত্মবিশ্বাসের এক নাম।

আমি গর্ব করি- আমি একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান।
আমরা ভাইবোনেরা এখন স্বনির্ভর।
দেশের নানা ক্ষেত্রে কাজ করছি।
বাবার শেখানো সততা ও দেশপ্রেম আমাদের চালিত করে।

বাবা দিবসের মানে:
এই দিনটি কেবল স্মরণ করার নয়-
এটি শিক্ষা নেওয়ার দিন।
বাবার আদর্শ, দায়িত্ববোধ, নিঃশব্দ ভালোবাসাকে মনে রাখার দিন।
আমার বাবা ছিলেন এক নিভৃতচারী যোদ্ধা।
একজন পিতা যিনি শিখিয়েছেন মাথা উঁচু করে চলতে।

আজ, এই দিনে আমি শুধু বলি-
আমার বাবা একজন বীর ছিলেন।
তাঁকে ভোলা যায় না। কখনো না।

লেখক: কবি, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

SN
আরও পড়ুন