মুক্তিযুদ্ধ মধ্যবর্তী সময়ে সৃষ্ট বাংলা ছোটগল্প আমাদের সাহিত্যে বিশাল আলোড়ন সৃষ্টি করে, যার আলোয় উদ্ভাসিত হয়েছিল স্বাধীনতাত্তোর বাংলা ছোটগল্প। তারই ধারাবাহিকতায় যারা বর্তমান সময়ের তরুণ গল্পকাররা তাদের গল্পে নিয়ে এসেছেন অনন্য এক বোধ এবং উপলব্ধি তাদের একজন হেমন্ত হাসান। তার গল্পগ্রন্থ 'যে নদী হারায় স্রোত' অনন্য কিছু গল্পের সূচিবদ্ধ সংকলন। তার গল্পের ভাষা সাবলীল কিন্তু বুননে রয়েছে মুন্সিয়ানার পরিচয়। প্রমীত ভাষার সঙ্গে আঞ্চলিক ভাষার সরল উপস্থাপন তার গল্পের শানিত ধ্বনিকে বেগবান করেছে। তার গল্প অপরিসীম হাহাকার জাগায় কখনো কখনো।
গ্রন্থের প্রথম গল্প 'মা বোধ হয় আর বাঁচবে না'- যেখানে মায়ের জন্য হু হু করে কেঁদে ওঠা হাজারো মানুষের আর্তি উঠে এসেছে। মানুষ তার জীবনের সারাংশের খোঁজ করে মায়ের মধ্যে। আবার 'জলের গভীরে' গল্পের বৃদ্ধ লোকমানের মতো অনেক চরিত্র আমাদের সমাজে সংসারে ঘুরে বেড়ায় সবসময়। আমাদের চোখের সামনে হেঁটে চলা এ সব চরিত্রগুলোই হেমন্ত তুলে এনেছেন তার গল্পে। ' ‘মেয়েমানুসি' গল্পের তমাল ও মজিদ মানুষের জীবনের চিরচেনা আবহ নিয়ে আসে গল্পের আয়োজনে। 'অভিনেতা ' গল্পের রাশেদ তো এ সমাজের জলজ্যান্ত উদাহরণ। তার জীবনের টানাপোড়েনগুলো আমাদের জীবনের সঙ্গেই তো হুবহু মিলে যায়। আসলে জীবন থেকেই তো তৈরি হয় প্রতিটি গল্প। মা বোধ হয় আর বাঁচবে না, জলের গভীরে, মেয়েমানুষি, অভিনেতা, বেয়নেট, একই পথে বিপথে, নৈঃশব্দের কলতান, শেষ বিকেলের গান, রক্ত, একটি অবিনাশী কবিতা,যে বন্যায় কুমির এসেছিল, যে নদী হারায় স্রোত-শিরোনামে এই গ্রন্থে সূচিবদ্ধ বারোটি গল্পের প্রতিটি আলাদা ধরনের মেজাজ নিয়ে হাজির হয়েছে।' বেয়নেট' গল্পে পাকিস্তানি হানাদারদের নির্মমতা পাঠকের চোখ ভিজিয়ে দিতে সক্ষম হবে এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায়। যে নদী হারায় স্রোত গল্পের বাস্তবিক প্রকাশ আমাদে মনন ও জীবনবোধকে অনন্য এক উচ্চতায় নিয়ে যায়।
বাংলাদেশের ছোটগল্পে কেবল কাহিনীর বুননই নয়, ভাষার ব্যবহারে এক ধরনের জীবনঘনিষ্ঠতা দেখা যায়, যা পাঠকের সঙ্গে গভীর সংযোগ তৈরি করে। এই ছোটগল্পগুলো আমাদের সাহিত্যকে যেমন সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি জাতিসত্তা ও সংস্কৃতির বহুমাত্রিক দিকও উন্মোচন করেছে। তারই ধারাবাহিকতায় তরুণ কথাসাহিত্যিকরাও সমানতালে তাদের অবদান রেখে যাচ্ছেন বাংলা ছোটগল্পে। হেমন্ত হাসান সেই গোত্রেরই গল্পকার। তিনি প্রমিত ভাষার পাশাপাশি আঞ্চলিক ভাষার সফল ব্যবহার করেছেন সিদ্ধহস্তে। তার সত্যিকারের মুন্সিয়ানা গল্পের সামান্য বিষয়কেও দিয়েছে নতুন আঙ্গিক।
ছোটগল্পকে বোধ, ভাবনার চেয়ে একটু নাটকীয়ই হতে হয়। উপন্যাসে যে মন্থরতা দেখা যায় তার চেয়ে নাটকীয় একধরনের দ্রুতগতিই এর গতিপ্রকৃতির নির্দেশক বলে মনে করেন অনেকেই । নাটক অনেক সময়ই অনাবশ্যকতা বর্জন করে লঘুগতিতে অগ্রসর হয়। নাটকের মতো গল্পেও একটি শীর্ষমুহূর্ত (পষরসধী) থাকে। সাধারণত গল্পের পরিসমাপ্তির মধ্যেই নাটকীয় আকস্মিকতা থাকে। কোনো কোনো সমালোচক এইধরণের গল্পের প্রকৃতির সঙ্গে একাঙ্কিকার তুলনা করেছেন তাদের চিন্তা থেকে। কিন্তু বাইরের দিক থেকে এই তুলনা অনেকখানি সার্থক মনে হলেও, একে সবথেকে উপযুক্ত বলে মনে হয় না হয়তো এবং এই কারণেই একাঙ্কিকার তীক্ষ্নতা ও আয়তনের কৃশতা, রসপরিণামের একমুখিতা আপাতদৃষ্টিতে ছোট-গল্পের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এই মন্তব্য তীব্রভাবেই প্রযোজ্য হেমন্ত হাসানের এই গল্পগ্রন্থের বিষয়ে। হেমন্তের গল্প হয়ে উঠুক শব্দের নিপুণ শিল্প।
যে নদী হারায় স্রোত
হেমন্ত হাসান
প্রকাশক : কারুবাক (অমর একুশে বইমেলা-২০২৫)
প্রচ্ছদ :পরাগ ওয়াহিদ
মূল্য : ২৮০ টাকা
