ঢাকা
সোমবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৫, ২ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
ই-পেপার

রাস্তার মাস্টার ॥ শারমিন রহমান

আপডেট : ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২:৫৩ পিএম

॥ পর্ব-৫ ॥
নতুন সংসারে অন্যরকম জীবন শুরু হলো আভার। কলতলার ভিড় নেই, লাইন ধরার প্রতিযোগিতা নেই। চেঁচামেচি হই হুল্লোড় নেই। একদম শান্ত জীবন। অভাব থাকলেও স্বস্তি আছে। নিজের মতন করে বাঁচার আনন্দ অন্যরকম। সত্যনারায়ণবাড়ি পাহারা দেওয়ার কাজটি পেয়ে বেশ খুশি। সত্যনারায়ণ আর আভা নিজের বাড়ির মতো ভালোবেসে আগলে রাখতে শুরু করেছে যাদবানন্দের এই জঙ্গলে ঘেরা বাড়িটিকে। 

বেশ খোলামেলা বাড়িটি। আলো বাতাসের কোনো অভাব নেই। বিদ্যুৎ, পানির পাম্প সব সুবিধা পেয়ে মেয়েরাও ভীষণ উচ্ছসিত। সোনালী, কাবেরী দূরের স্কুলে যেতে শুরু করেছে। বেবি মায়ের পেছন পেছন ঘুরে বেড়ায় আর প্রশ্ন করে, মা, ওমা! এইটা আমাদের নিজের বাড়ি! কথাটা বলার সময় বেবির চোখ মুখে যেন আলো ঠিকরে পড়ছিল। আভা তৃপ্তির হাসি হাসে। বেবিকে জড়িয়ে ধরে বুকে। হঠাৎ বুকের ভেতর থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। সন্তানকে বুকে জড়িয়ে ধরে কী শান্তি! সন্তান ছেলে না মেয়ে তাতে মায়ের কি অনুভূতি বদলায়! অথচ এই মেয়ে হওয়ার জন্য তাকে শ্বশুরভিটে ছাড়তে হয়েছে, জামুরিয়া বস্তি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হলো। তাদের পুরো পরিবার কে অশুভ বলে ধিক্কার জানানো হলো। ভাবতেই বুকটা কেঁপে উঠলো। বেবিকে আরো শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরলো আভা। মেয়ের মুখে আদরে ভরিয়ে দিলো। মায়ের এমন আচরণে অবাক হলো বেবি। চোখ বন্ধ করে মায়ের বুকে মিশে রইলো। 

ফুল কাকুর জঙ্গলে পরিণত হওয়া বাড়িটি সত্যিই ফুলের মতন হাসতে লাগলো। আভা নিজের থেকেও বেশি বাড়িটির যত্ন করতে শুরু করেছে। একটা মেয়ে তার সংসারকে কতোটা ভালোবাসতে পারে - আভাকে দেখে সত্যনারায়ণ এখন সেটা উপলব্ধি করতে পারে। অথচ এটাও তার নিজের সংসার নয়। কিছুই দিতে পারেনি আভাকে সে- এসব ভাবলে সত্যনারায়ণ মুষড়ে যায় ভেতরে ভেতরে। নিজেকে এক অথর্ব মানুষ মনে হয়। অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে দূরে বসে থাকা আভার দিকে। চোখ ঝাপসা হয়ে ওঠে। কবে যে এ বাড়ি থেকে চলে যেতে হয়! বাড়ির মালিক ফিরলেই তাকে অন্য কোথাও ঠাঁই খুঁজতে হবে। সে তো কেবল পাহারাদার, মালিক নয়। তার সারাজীবন থাকার অধিকার নেই এখানে। সত্যনারায়ণের বুক হালকা করে এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। কচুরিপানার মতন কি ভাসতে ভাসতেই যাবে জীবন? জীবন নামক এ গল্পে তাকে আর কোথায় কোথায় ভেসে বেড়াতে হবে- জানেনা সত্যনারায়ণ। কিন্তু সবাই মিলে যেভাবে বাড়ির সঙ্গে সখ্যতা তৈরি করছে, মায়ায় জড়িয়ে পড়ছে, তাতে এই মায়া কাটিয়ে অন্য কোথাও যাওয়া ভীষণ কঠিন হবে। 

ফুল কাকুর বাড়িতে ইট, সুরকির ঘরটি যত্ন করে প্রতিদিন গুছিয়ে, ঝাড় দিয়ে প্রস্তুত করে রাখে আভা। ফুলকাকুর থাকার ঘর এটা৷ পাশেই আরেকটা বড় মাটির ঘরে আভার সংসার। মাটির ঘর হলেও ভেতরে ছোট ছোট কয়েকটা ঘর রয়েছে। আভার যত্নে মাটির দেয়ালজুড়ে ফুলেরা যেন হাসছে। নানা রঙের আল্পনা করেছে আভা। পাশেই রান্নাঘর। পশ্চিমের দিকে বেশ ফাঁকা জায়গা রয়েছে। সেখানে সবজি চাষ করেছে সত্যনারায়ণ। নানারকম সবজি পাওয়া যায় সারাবছর। আভা, সত্যনারায়ণের সঙ্গে মেয়েরাও বাগান দেখাশোনা করে। বাগান যেন ওদের প্রাণ। সব আনন্দের কেন্দ্রবিন্দু এই বাগান। ফুলাকাকুর থাকার ঘরের সামনেই তুলসীমঞ্চ প্রতিষ্ঠা করেছে আভা। সকাল সন্ধ্যা তাতে পুজো দিয়ে সবার মঙ্গল কামনা করে আভা। 

বাড়ি থেকে রেলস্টেশন বেশ কয়েক কিলোমিটার দূরে। সেখানকার স্টেশন বাজার খুব জাঁকজমকপূর্ণ। সপ্তাহের প্রতি মঙ্গলবার সেখানে হাট বসে। সে হাটে সব জিনিস পাওয়া যায়। কেউ কেউ হাটকে মেলাও বলে। সত্যনারায়ণ মাঝে মাঝে মেয়েদের সঙ্গে করে পায়ে হেটে যায়। আজ মঙ্গলবার। মেয়েরা বায়না ধরেছে বাবার সঙ্গে আজ তারা স্টেশন যাবে। রেলগাড়ি দেখতে বেশ ভালো লাগে ওদের। সোনালী রেলগাড়িতে ওঠার স্বপ্ন দেখে রোজ। কিন্তু কাউকে কিছুই জানায় না। খাতার মধ্যে রেলগাড়ির ছবি আঁকে চুপিচুপি৷ বড় হয়ে চাকরি করবে সোনালী, রোজ রেলগাড়িতে চড়ে অফিস যাবে। এটা তার স্বপ্ন। তাইতো পড়ালেখায় খুব মনোযোগী সে৷ সত্যনারায়ণ মেয়েদের আবদার ফেলতে পারে না। এতোটা পথ পায়ে হেঁটে যাওয়া আসা করলে ওদের কষ্ট হবে ভেবেই নিতে চায় না সত্যনারায়ণ। তাছাড়া সন্তানদের সঙ্গে করে বেড়াতে কার না ভালো লাগে! স্টেশনে পৌঁছেই একটা রেলগাড়িকে স্টেশন ছেড়ে যেতে দেখলো ওরা। সোনালী তাকিয়ে রইলো সেদিকে। বড্ড অদ্ভুত লাগে সোনালীর৷ কতো কতো অচেনা মানুষ রোজ একসঙ্গে যাওয়া আসা করে এই রেলগাড়িতে৷ সবার গন্তব্য আছে, ব্যস্ততা আছে। আর রেলগাড়ি সবার গন্তব্যে পৌঁছে দিয়ে প্রতিদিন ছুটে চলে। রেলগাড়ির ভেতরে কেমন তা বাইরে থেকে দেখিয়েছে বাবা, জানালা দিয়ে। 

চলবে…

আরও পড়ুন