বুলবুলিদের জানালার সামনে ক’গজ দূরে একটা শান বাঁধানো পুকুরপাড়। যেখানে সকাল সকাল পাড়ার মহিলারা বসে ছাই দিয়ে বাসন মাজে। তখন শব্দ হয় ঘ্যাচর ঘ্যাচর। মাঝে মাঝে পুকুরটায় হলুদ রঙের একটা সাপ দেখা যায়। যেটা মাথা উঁচু করে পানি নাচাতে নাচাতে পাক খায়। কখনো এদিকটায় আসে না। একদিন বুলবুলি সাপ দেখে তার মাকে বলেছিল, মা দ্যাখো দ্যাখো, সাপ। বুলবুলির মা তখন হায় হায় হারামজাদি, সারলুতো বলে ওর মাথার চুল ধরে নিচু করে পিঠে ধপধপ করে পাঁচটা কিল বসিয়েছিল। সাপ দেখাতে গিয়ে বুলবুলি ওর মার হাতে থাকা ধোয়া থালাবাটি ফেলে দেওয়ায় দণ্ডটা তাকে পেতে হয়।
পুকুরের ওদিকটায় বিঘা বিঘা জমি। জমিগুলোয় সরষের আবাদ করলে জানালা থেকে ওগুলো খেজুরপাতার ফাঁক দিয়ে দেখা যায়। ওগুলোর গন্ধ ঠিকঠাক জানালা ভেদ করে ঘরে প্রবেশ করে। পুকুর ঘেঁষে বড় একটা কড়ই গাছ দাঁড়িয়ে আছে কবে থেকে, তার ইয়ত্তা নেই কারও। কিন্তু ওর পাতাগুলো মাঝে মাঝে পুকুরে পড়ে পুকুরকে কেমন ভৌতিক করে তোলে। মজার ব্যাপার হলো, লোকে বলে ও গাছে না-কি পেত্নি থাকে। পেত্নির দাঁত বড় বড়, অনেকে চুল দেখেছে। কেউ বলে পেত্নির শরীরে কোনো কাপড় থাকে না।
একসন্ধ্যায় প্রৌঢ় বৃদ্ধ গাছটার ধারঘেঁষে পেশাব করতে বসে চিৎকার করে বলে উঠেছিল, ‘ওবাবারো হামাকে লিয়্যা গেলো রো।’ তারপর ওখানেই চিৎপটাং। বুড়োর চিৎকার শুনে আশপাশের লোকজন ছুটে এসে তাকে উদ্ধার করে মাথায় পানি ঢেলে জ্ঞান ফিরিয়ে এনে জিজ্ঞেস করলে সে জানায়, একটা পেত্নি উলঙ্গ শরীরে গাছ বেয়ে তার দিকে এগিয়ে আসছিল! শুনে অনেকে মজা করে বলেছিল, ‘বুড়োর কপাল খুলেছিল; কিন্তু ব্যাটায় জ্ঞান হারিয়ে কপালটা নিজেই পুড়ালো!’
তারপর কী কাণ্ড! বাড়ি ফিরে বুড়োর মুখ দিয়ে অন্ন ঢোকে না। একমনে আকাশে তাকিয়ে মাঝে মাঝে বলে ওঠে, ‘হামি দেখিছি, ওবাবারো।’ বুড়োর কাণ্ড দেখে নাতবৌ নূরবানু দূর থেকে হাসে। বুড়োর সাথে মাঝে মাঝে বলে ওঠে, ‘ও দাদু কে আসিছিলো? দাদি না-কি? আপনেক পছন্দ করিছে না-কি? আপনে পছন্দ করেননি?’ বুড়ো পাল্টা জবাব দেয়, ‘তুই মরবু রো তুই মরবু।’ ‘ও বাবারো, হামি দেকিছি। চুলগুলা কালো কুচকুচা।’ বুড়োর কথা শুনে নূরবানু খিকখিক করে হেসে ওঠে। ‘বউ অত হাসিচ্চু ক্যা? কি হছে?’ আফসার আলীর কথা শুনে নূরবানু আরও হেসে গড়াগড়ি খায়। ‘ওমা আপনে জানেন না সাঁঝের বেলা কি কাণ্ডটা হছে। বুড়ো হাট থেকে ফিরার সময় কড়ির গাছের কাছে মুতপ্যার বচ্চিলো। তারপর গাছেত থেকে না-কি পেত্নি ন্যামা আচ্চে। পেত্নির গায়েত না-কি পেটিকুট বেলাউজ আছিলো না!’ বলেই নূরবানু আবার হেসে ওঠে। নাতবৌয়ের মশকরা সহ্য করতে না পেরে বুড়ো রাগে গরগর করে চলে যায়! যাওয়ার সময় বলে যায় ‘হামি দেকিছি, তোরাও দেখ।’
পরদিন বুড়ো বাড়ির খোলায় বসে বিড়ি টানছিল। বুলবুলি দৌড়াতে দৌড়াতে বুড়োর সামনে থেমে হাঁপাতে হাঁপাতে বললো, ‘দাদা মায় কলো ক্যাল আপনে না-কি পেত্নি দেখিছেন। পেত্নি দেখতে কেংকা?’ বুড়ো কিছুক্ষণ চুপ থেকে বিড়িতে আরেকটা টান দিয়ে ধক করে ধোঁয়া ছেড়ে বললো, ‘ধারি হছু এখনো দৌড়াস? কতা কস ন্যা তো, বাড়িত যা। তুর চাচি মুড়ি ভাজিছে খা যা।’ বুলবুলি আবার জিজ্ঞেস করলো, ‘দাদা কবেন না?’ বুড়ো এদিক-সেদিক তাকিয়ে বললো, ‘কঞ্চিটা কুটি গেলো।’ বুলবুলি কঞ্চির কথা শুনে বাড়ির ভেতর দৌড়ে পালালো।
বুলবুলির পা সবেমাত্র কৈশোরে গড়িয়েছে। চুলগুলো পেছনে কাঁধ অবধি। সামনের চুল প্যাঁচ খেয়ে থুঁতনি পর্যন্ত গড়ায়। বুকে শবরী অঙ্কুরিত হচ্ছে মাত্র। ইংলিশ প্যান্ট পরে উদল গায়ে কদিন আগেও বুলবুলি এপাড়া-ওপাড়ায় বরই, জাম, আম গাছতলা চষে বেরিয়েছে। একদিন বুলবুলির মা গুলবানু ওর চুলের মুটি ধরে তাকে বলেছে, ‘কিরে মাগি, তুক না কছি খালি গায়ে বাড়িত থ্যাকা আর বাড়াবু না? কতা কানেত যায়নি?’ তারপর থেকে বুলবুলি বুকের কাছে ঝালট দেওয়া ফ্রক পরে ঘুরে বেড়ায়।
একদিন পাড়ার মেয়েদের সাথে পুকুরে দাপাদাপির পর ভেজা গায়ে বাড়ি ফিরছিল, হঠাৎ বুলবুলি খেয়াল করলো ওর প্যান্ট বেয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। ও দৌড়ে বাড়ি গিয়ে ওর মাকে বললো, ‘মা... আ, মা... রো, প্যান্টের ভেতর জুঁক ঢুকছে। জুঁক ছাড়ায়ে দে রো মা’ বলেই ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে চিৎকার করে কান্নাকাটি শুরু করলো। গুলবানু পুরোনো শাড়ির ন্যাকড়াসহ বুলবুলিকে টিউবওয়েল পাড়ে নিয়ে ওর রক্ত ধুয়ে বললো, ‘জুঁক ব্যার করে দিছি। এই তেনা যেংকা করে লাগায়ে দিচ্চি, এংকা করে প্রত্যেকদিন প্যান্টের নিচে পড়বু। রক্ত দিয়ে বেশি ভিজে গ্যালে তেনা পাল্টাবু। কয়দিন বাড়ি থেকে ব্যার হোস না মা।’ বুলবুলি ততক্ষণে স্থির হয়ে গেছে। বললো, ‘আচ্ছা।’
রাতের বেলা ঘুম থেকে জেগে বুলবুলি ওর মাকে বললো, ‘মা জুঁক হামার প্যাটের মধ্যে ঢুকচে। প্যাটের নিচে খালি লাগিচ্চে।’ বলে খুঁতখুঁত করতে লাগলো। বুলবুলির বাবা কাজেমউদ্দিন বললো, ‘ক্যারে গুলবানু বুলবুলির কি হছে? হামাক তো কসনি? ওর কি অসুখ করছে?’ গুলবানু বললো, ‘আপনে ঘুমায়ে যান বুলবুলির বাপ। অর কিছু হয়নি।’ ‘তালে ঊই খুঁতখুঁত করিচ্চে ক্যা?’ ‘আপনে বুজপেন না। ঘুমায়ে যান। ক্যাল কমুনি।’
পরদিন বুলবুলি স্কুলে যাওয়ার জন্য সকালে তৈরি হলেও পেট ব্যথা আর হালকা জ্বরে যেতে পারলো না। ঘরের ভেতর বসে জানালা দিয়ে বাইরে পুকুরের দিকে তাকিয়ে ছিল। হলুদ রঙের সাপ দেখার জন্য। তখনো পাড়ার মহিলাদের কেউ থালাবাটি মাজছিল আবার কেউ কাপড় কাঁচতেছিল। একটা কালো ভ্রমর জানালার ফাঁক দিয়ে প্রবেশ করে বুলবুলির চোখের সামনে উড়তে লাগলো। ‘ওই যা যা’ বলে বুলবুলি ভ্রমরটাকে তাড়িয়ে দিলো। হঠাৎ রুপালি জানালার কাছে এসে জোরে করে ‘হাউ’ বলে বুলবুলিকে চমকে দিয়ে পালিয়ে গেলো। বুলবুলি বললো, ‘ওই থাম থাম।’ রুপালি বললো, ‘পরে আসমুনি, ওই পাড়া যামু, মৌঅল আমের গাছেত থ্যাকা মধু নামাবি, ওড্যা দেখমু। মৌঅল মধু চ্যাকপ্যার দিবি রো।’ বাড়ির ভেতর থাকতে বুলবুলির আর ভালো লাগছে না। ওর বারবার মনে হলো, কাল পুকুরে গোসল করতে গিয়েই ভুল করেছে। পেটের ভেতর জোঁক ঢুকেছে। বের হচ্ছে না! পেট ব্যথা আর শরীর চিবানোয় বাড়ি থেকে বেরও হতে পারছে না। এভাবে কেটে গেলো আরও কয়েকদিন। বুলবুলি খেয়াল করলো, ওর পেটে ব্যথা নেই। রক্তও বের হচ্ছে না আর। ওর মা ওকে বলেছে, ‘প্রত্যেক মাসেই তুর প্যাটের ভিতর জুঁক ঢুকপি। তখন তুই ওই তেনা পড়বু।’ শুনে বুলবুলির মন ভার হয়ে রয়েছে তখন। এরপর বারবার নিজেকে ধিক্কার দিয়েছে সেদিন পুকুরে গোসলে নামায়।
একদিন বিকেলবেলা বুলবুলি বাসায় ঢুকতেই অপরিচিত কয়েকজন মানুষকে দেখতে পেলো। বুলবুলির মা বললো, ‘কুনটি গেছিলু? খুঁজে খুঁজে হয়রান। তুর জন্যে লোকজন বসে আছে।’ ‘কে আচ্চে মা? মামা আচ্চে?’ ‘না বেগুনব্যাড়া থ্যাকা লোকজন আচ্চে, তাড়াতাড়ি রেডি হ।’ তালহারা গ্রাম থেকে চার গ্রাম পরেই বেগুনবাড়িয়া। বুলবুলি কিছু বুঝতে পারলো না কেন তাকে রেডি হতে হবে। কেন লোকজন বসে আছে। সে বললো, ‘কুটি যাবু মা?’ ‘হামি লয় খালি তুক লিয়্যা যাবি’, ‘হামাক একলাই কুটি লিয়্যা যাবি?’ ‘অ্যাজ লিয়া যাবি ন্যা, উন্ন দিন লিয়্যা যাবি, তুই তাড়াতাড়ি রেডি হ, চল।’ গুলবানু বুলবুলিকে শাড়ি, গহনা, লিপস্টিক পরিয়ে দিলো। লোকজনের সামনে নিয়ে যাওয়ার আগে মাথায় ঘোমটা টানিয়ে দিলো। আর বললো, ‘মানসের সামনে যায়্যা বেশি কতা কবু না।’
গুলবানু বুলবুলিকে নিয়ে ঢুকতেই একজন বলে উঠলো, ‘মিয়েটা তো ভালোই ডাঙ্গর হছে, কুন কেলাসে পড়িচ্চে?’ কাজেমউদ্দিন বললো, ‘কেলাস সিক্সে পড়িচ্চে চাচা।’ খুব ভালো যোগ-বিয়োগ করব্যার পারে।’ পান চিবোতে চিবোতে আরেকজন বললো, ‘রান্দিব্যার পারে?’ গুলবানু বললো, ‘ঘরের সব কাম করব্যার পারে।’ মাঝবয়সী একজন মহিলা বলে উঠলো, ‘মিয়ের ঘুমটা তুলেন দেকি।’ ‘এ মা মিয়ের চুলগুলো অত ছুটু ক্যা?’ ‘অল্প বয়েস বিআন সায়েবা, চুল বড় থুল্যাই হবি।’ ‘দেকি মিয়েক এনা হাঁটান।’ ‘মিয়েক হামাকেরে পছন্দ হছে, বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করেন তালে’ পান চিবানো লোকটি বললো। এতগুলো লোকজনের মধ্যে কিশোরী বুলবুলি নিজেকে অসহায়বোধ করছিল। শাড়ি পরানোর সময় খুশি হলেও বিয়ের কথা শুনে তার বুকটা কেঁপে উঠলো। লোকজনের সামনে চেয়ারে বসে থাকা থেকে উঠিয়ে দাঁড়িয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেলো। কাজেমউদ্দিন বললো, ‘মিয়েটা খুব লজ্জা করে।’
রাতের বেলা বিছানায় শুয়ে বুলবুলি বললো, ‘মা হামি বিয়্যা করমু না, হামাক বিয়্যা দিস না। ওই পাড়ার বিউটি খালার তো আখুনো বিয়্যা হয়নি। হামিও লেকাপড়া করে পরে বিয়্যা করমু?’ ‘ওই কতা মুখে আনিস ন্যা মা, বিউটির নামে গেরামের লোকজন কি কি কয় শুনিসনি? তুকো বারোভাতারি কবি। র্যাতের বেলা লোকজন জাংলার কাছে আসপি। বাড়িত ঢুকার চেষ্টা করবি। মা রো। ভালো ছেলে পাছি। সাত বিঘা জমি আছে। বয়স না হয় অল্পেনা বেশি। বাড়ির ভাত খায়। মিয়ে মানুষ পরের ঘরেত যাওয়াই লাগবি। কান্দিস ন্যা মা।’
মায়ের কথা শুনে বুলবুলি ফোঁপাতে থাকে। বুলবুলির তালহারা গ্রাম। পুকুর পাড়। পেত্নি থাকা কড়ই গাছ। রুপালি, মনি, মল্লিকাদের ছেড়ে যেতে হবে। এদেরও বিয়ে হয়ে যাবে? মাকে বাবাকে আর প্রতিদিন দেখতে পাবে না। ছেড়ে যেতে হবে সবাইকে! ভাবতে ভাবতে বুলবুলির ভেতরটা ফাঁকা হয়ে যায়! গুলবানু বুলবুলির মাথায় হাত বুলাতে থাকে। বুলবুলি ফোঁপাতে ফোঁপাতে একসময় ঘুমিয়ে যায়!
