ডিএমপি

ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট সীমান্ত দিয়ে পালিয়েছে হাদির খুনি

আপডেট : ২৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ০২:১৫ এএম

ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালিয়েছে ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শহীদ শরিফ ওসমান বিন হাদির হত্যাকারী ফয়সাল ও আলমগীর। রোববার (২৮ ডিসেম্বর) ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) এসএন মো. নজরুল ইসলাম। 

তিনি বলেন, ইতোমধ্যেই তাদের সহযোগিতাকারী দুজনকে আটক করেছে ভারতের মেঘালয় পুলিশ। ৭ জানুয়ারির মধ্যে দেওয়া হবে হত্যা মামলার চার্জশিট। যদিও সন্দেহভাজন দুই আসামির ভারতে পালিয়ে যাওয়ার দাবি নাকচ করে দিয়েছে মেঘালয় পুলিশ ও ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স (বিএসএফ)। এ ঘটনায় কাউকে গ্রেফতারও করেনি বলে দাবি তাদের। 

ঘটনার ১৭ দিন পর অভিযুক্তদের ভারতে পালানোর বিষয়টি সামনে আনায় পুলিশের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন অপরাধ বিশ্লেষকরা। তাদের দাবি- ঘটনার পর অপরাধীদের ধরতে কার্যত কোনো পদক্ষেপ নেয়নি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ সড়ক, প্রবেশপথ ও দেশের সীমান্তবর্তী এলাকায় জোরদার করা হয়নি নিরাপত্তাব্যবস্থা। ফলে অপরাধীরা নিরাপদে সীমান্ত দিয়ে দেশত্যাগ করেছে। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, অপরাধীরা সীমান্ত দিয়ে পালিয়ে গেছে। তারা কিন্তু জাদুর মাধ্যমে সীমান্ত পার হয়নি। তাদের প্রতিটা স্তর অতিক্রম করতে হয়েছে। এসব স্তর অতিক্রম করে তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেছে। তাদের চলে যাওয়ার দায় কোনোভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এড়াতে পারে না। এ ঘটনায় তারা নিজেদের পেশাদারত্বের পরিচয়টা দিতে পারেনি। 

তিনি বলেন, অভিযুক্তরা কীভাবে দেশত্যাগ করেছে, কোন প্রক্রিয়ায় করেছে, তাদের পেছনে দেশি-বিদেশি কোনো ইঙ্গিত ছিল কিনা- সেসব বিষয় রাষ্ট্রের খতিয়ে দেখা উচিত। কারণ এগুলো নিয়ে দেশের মানুষের আগ্রহ আছে। মানুষ এগুলো জানতে চায়। 

তিনি আরও বলেন, হাদিকে গুলির পর অভিযুক্তরা ভারতে পালিয়ে গেছে এমন দাবি দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে করা হয়েছে। কিন্তু এখানে ভারত ভিন্ন কথা বলছে। বিষয়টি নিয়ে দুই রাষ্ট্রের মতামত দুই রকম। অভিযুক্তরা যদি ভারতে পালিয়ে গিয়ে থাকে- তাহলে সেটি আমাদের পক্ষ থেকে বলার ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত তথ্য উপস্থাপন করা প্রয়োজন। কারণটা বিধিবহির্ভূতভাবে কেউ কোনো রাষ্ট্রে আশ্রয় নিলে- তা সেই রাষ্ট্র স্বীকার করবে না।

অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদেই শহীদ শরিফ ওসমান বিন হাদি হত্যার বিচার সম্পন্ন করা হবে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। তিনি বলেন, এ হত্যাকাণ্ডের পেছনে কারা জড়িত রয়েছে তা উদঘাটনের জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের জোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। গ্রেফতারদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য, সাক্ষীদের জবানবন্দি ও উদ্ধার আলামত পর্যালোচনা ও সার্বিক বিবেচনায় মামলাটির তদন্ত শেষ পর্যায়ে রয়েছে। আগামী ১০ দিনের মধ্যে এ মামলার চার্জশিট (অভিযোগপত্র) দেওয়া সম্ভব হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। রোববার বিকালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আইনশৃঙ্খলাসংক্রান্ত কোর কমিটির সভা শেষে আয়োজিত এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে তিনি এ কথা জানান। ‎

এর আগে সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার নজরুল ইসলাম বলেন, হাদি হত্যার ঘটনায় এখন পর্যন্ত ১১ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ছয়জন আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। এছাড়া চারজন সাক্ষীও আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। মামলাটির তদন্ত একেবারে শেষ পর্যায়ে রয়েছে। এ হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যের অনেককেই শনাক্ত করা হয়েছে। তদন্তের স্বার্থে সবার নাম বলা যাচ্ছে না। এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যে এটাকে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডই মনে হচ্ছে। আগামী ৭ থেকে ১০ দিনের মধ্যে এই মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া হবে। 

সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার এসএন নজরুল ইসলাম বলেন, তদন্তে প্রাপ্ত তথ্য, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন এবং গ্রেফতারদের দেওয়া জবানবন্দি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়- ফয়সাল ও আলমগীর ঘটনার পরই ঢাকা থেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় আমিনবাজার যায়। পরে একটি প্রাইভেট কারে করে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটে পৌঁছে। তদন্তে প্রাপ্ত তথ্য মোতাবেক মূল দুই অভিযুক্ত অবৈধ পথে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে থাকতে পারে মর্মে জানা গেছে। এ ঘটনার সঙ্গে বিভিন্নভাবে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে অভিযুক্ত ফয়সালের বাবা-মা, স্ত্রী, শ্যালক, প্রেমিকা ও পলায়নে সহায়তাকারী নুরুজ্জামান ইতোমধ্যে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। ফয়সাল ভারতের মেঘালয়ে পালিয়ে গেছেন। মেঘালয় পুলিশ তার দুই সহযোগীকে গ্রেফতার করেছে।

সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ন্যক্কারজনক এই ঘটনার পরই ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ, ডিবি, সিটিটিসি, র্যাব, সিআইডি এবং বিজিবি ঘটনায় জড়িতদের শনাক্তপূর্বক গ্রেফতার করে আইনের আওতায় নিয়ে আসার জন্য কাজ শুরু করে। ঘটনাস্থলে উপস্থিত ব্যক্তিদের দেওয়া তথ্য, সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ, ওপেন সোর্স ইন্টেলিজেন্স এবং তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় ঘটনার দিনই শুটার ফয়সাল করিম মাসুদ ওরফে দাউদ ওরফে রাহুল এবং তার সহায়তাকারী মোটরসাইকেলচালক আলমগীর শেখকে শনাক্ত করা হয়। তাৎক্ষণিক তাদের গ্রেফতারের জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক টিম সাভার, হেমায়েতপুর, আগারগাঁও, নরসিংদীতে অভিযান পরিচালনা করে। ধারাবাহিক অভিযানের অংশ হিসাবে ডিএমপির একটি টিম ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটের সীমান্তবর্তী এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে। ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট মামলাটি নিবিড় তদন্তের জন্য ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। তদন্তকালীন এযাবৎ এ ঘটনা সংঘটনে পরিকল্পনায় অংশগ্রহণ, ঘটনায় ব্যবহৃত অস্ত্র-গুলি লুকানোর সঙ্গে জড়িত, ঘটনার মূল দুই হোতাকে পলায়নে সহায়তাকারীসহ ১১ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। 

পুলিশ কর্মকর্তা নজরুল বলেন, ইনফরমাল চ্যানেলে আমরা মেঘালয় পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানতে পেরেছি- সেখানে তদের আটক করেছে। তারা হলেন পূর্তি ও সামি।

ইনকিলাব মঞ্চের নেতা ওসমান হাদি হত্যা মামলার প্রধান দুই সন্দেহভাজন আসামির ভারতের মেঘালয়ে পালিয়ে যাওয়ার দাবি নাকচ করে দিয়েছে মেঘালয় পুলিশ ও ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স (বিএসএফ)। একই সঙ্গে পূর্তি বা সামি নামে কাউকে শনাক্ত বা গ্রেফতার করার কথাও স্বীকার করেনি তারা। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম হিন্দুস্তান টাইমস ও মেঘালয় মনিটর এ খবর জানিয়েছে।

মেঘালয় পুলিশ ও বিএসএফ জানিয়েছে, ওসমান হাদির দুই খুনি ফয়সাল করিম মাসুদ ও আলমগীর শেখ ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেছেন বলে বাংলাদেশ পুলিশ যে তথ্য দিয়েছে, সেটির কোনো ভিত্তি নেই।

মেঘালয় পুলিশ সদর দপ্তরের এক কর্মকর্তা হিন্দুস্তান টাইমসকে জানান, পূর্তি বা সামি নামে কাউকে শনাক্ত বা গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। তাদের মতে, ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কোনো প্রকার সমন্বয় ছাড়াই এ তথ্য প্রচার করা হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশ পুলিশের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত কোনো আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগ করা হয়নি বলেও জানায় মেঘালয় পুলিশ।

জুলাই অভ্যুত্থান এবং আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে পরিচিতি পাওয়া হাদি ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-৮ আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। ১২ ডিসেম্বর বিজয়নগরে নির্বাচনি গণসংযোগে যান। এ সময় চলন্ত মোটরসাইকেল থেকে হাদিকে গুলি করা হয়। এতে গুরুতর আহত হাদিকে দ্রুত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে অস্ত্রোপচার করার পর রাতেই তাকে ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এর দুদিন পর এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে তাকে সিঙ্গাপুরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন থাকার পর ১৮ ডিসেম্বর হাদির মৃত্যুর খবর আসে।

HN
আরও পড়ুন