চা-কফি পছন্দ করেন না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া আজকাল বেশ কঠিন। রাস্তার মোড়, অফিস কিংবা আদালত পাড়া থেকে শুরু করে নগর জীবনের অধিকাংশ স্থানে রয়েছে চা-কফির দোকান। অনেক দোকানেই চা-কফি বিক্রিতে ব্যবহার হয় ওয়ান টাইম প্লাস্টিকের কাপ। আর এ এসব কাপ মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে। এসব কাপের প্লাস্টিক কণা ছড়িয়ে পড়ছে সব জায়গায়। এমনকি খাবারের মাধ্যমেও প্লাস্টিক কণা ঢুকে পড়তে পারে আমাদের শরীরে। আর সে কারণেই প্লাস্টিকজনিত স্বাস্থ্যঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। রোজকার জীবনে এসব কাপ পরিহার করার মাধ্যমে ঝুঁকি কমিয়ে আনা সম্ভব। প্লাস্টিক কণার প্রভাবে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে মানবদেহ।
হৃদ্রোগ, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস ও হরমোনের সমস্যা হতে পারে এ থেকে। শিশুদের বিকাশেও নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। এমনকি গর্ভের শিশুও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। সন্তান ধারণক্ষমতা কমে যাওয়ার কারণও হতে পারে প্লাস্টিক কণা। তবে রোজকার জীবনে টেকসই, পরিবেশবান্ধব পণ্য ব্যবহার করলে এবং প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার সীমিত করে ফেলতে পারলে অনেকটাই নিরাপদ থাকা সম্ভব।
প্লাস্টিকের কাপ আমাদের শরীরের ক্ষতি ডেকে আনে। এই কাপ তৈরি করতে মাইক্রোপ্লাস্টিক ব্যবহার করা হয়। আবার কাগজের তৈরি কাপেও মাইক্রোপ্লাস্টিক থাকে। এই মাইক্রোপ্লাস্টিক শরীরের জন্য যথেষ্ট ক্ষতিকর। কাপে যখন গরম চা ঢালা হয়, তখন সেই তাপে প্লাস্টিক গলে চায়ে মিশে যায়। গবেষকরা জানাচ্ছেন, এক একটি কাপে প্রায় ২৫ হাজার মাইক্রোপ্লাস্টিক থাকে। কাপে গরম চা ঢাললে খুব অল্প সময়ে এই প্লাস্টিক গলে চায়ে মিশে যায়। দিনে যারা চার-পাঁচবার এই কাপে চা খান, তাদের শারীরিক ক্ষতির আশঙ্কা অনেকটাই বেশি।

পরিবেশবাদীরা বলছেন, নানা কারণেই ওয়ান টাইম কাপ বা ডিসপোজেবল কাপ ব্যবহার করতে হয়। বিশেষত বাইরে বেড়াতে গেলে চা-কফি খাওয়ার জন্য এ ধরনের ওয়ান টাইম কাপ দেওয়া হয়। যদি এটা নিয়মিত ব্যাপার হয়, তবে তা ভাবার বিষয়। কারণ বেশির ভাগ ওয়ান টাইম কাপ প্লাস্টিকের হয়ে থাকে। এগুলো এত পাতলা প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি হয় যে একবার ব্যবহারের পর পুনরায় ব্যবহার করা যায় না।
পরিবেশবিদরা বলেন, কাগজের কাপ তৈরিতে রাসায়নিক ও মাইক্রোপ্লাস্টিক ব্যবহৃত হয়। গরম পানীয়ের সংস্পর্শে এসে এ রাসায়নিক পদার্থগুলো মিশে যেতে পারে। যা থাইরয়েডসহ অন্যান্য গুরুতর রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। কাগজের কাপ শুধু স্বাস্থ্যের জন্য নয়, পরিবেশের জন্যও ক্ষতিকারক। পোড়ানোর সময় ক্ষতিকর রাসায়নিক পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ে।
প্লাস্টিক কাপ পরিবেশে ৫০ বছর পর্যন্ত টিকে থাকে। এটি মাটি, পানি ও বাতাসে মাইক্রোপ্লাস্টিক ছড়িয়ে বাস্তুতন্ত্র ধ্বংস করে। বাংলাদেশে বছরে ৮৬ হাজার ৭০০ টনের বেশি ওয়ান টাইম প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপন্ন হয় যার অধিকাংশই আসে খাবার প্যাকেজিং থেকে বলে জানান পরিবেশবিদরা। তারা আরো বলেন, বর্তমানে সারা বিশ্বে ওয়ানটাইম ব্যবহার উপযোগী প্লাস্টিক কাপের ব্যবহার সর্বত্র। ছোট টং দোকান থেকে শুরু করে অফিস ও রেস্টুরেন্টসহ নানা জায়গায় পানীয় পরিবেশনে এটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। বিশেষ করে কোভিট-১৯ মহামারীর সময় থেকে স্বাস্থ্যনিরাপত্তা বিবেচনায় চা, কফি, কোমল পানীয়, লাচ্ছিসহ দুধের তৈরি বিভিন্ন পানীয় পলিস্টাইরিন প্লাস্টিকের তৈরি একবার ব্যবহারে উপযোগী কাপগুলোয় পরিবেশন আরো বেশি জনপ্রিয়তা লাভ করে। এই কাপ ব্যবহারে মানুষের হার্টের সমস্যা, নারীদের স্তন ক্যানসার, মস্তিসকের ও ত্বকের সবচেয়ে ক্ষতি হয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, পরিবেশে প্লাস্টিক বহু বছর ধরে রয়ে যায়। ফলে মাটির উর্বরতা কমে যায়। আর মাটি বা পানিতে রয়ে যাওয়া প্লাস্টিকের প্রভাব পড়ে স্বাস্থ্যের ওপর। বাস্তুতন্ত্রের ওপর এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব রয়েছে। প্লাস্টিকের ব্যবহার পুরোপুরি এড়ানো সম্ভব না হলেও অনেকটা কমিয়ে আনা দরকার। যতটুকু ব্যবহার না করলেই নয়, প্লাস্টিকের ব্যবহার ততটুকুতেই সীমিত রাখতে চেষ্টা করতে হবে। ব্যবহার করতে হলেও ভালো মানের প্লাস্টিক বেছে নিতে হবে। মেনে চলুন এর ব্যবহারবিধি। আর খুঁজে নিন পরিবেশবান্ধব বিকল্প।
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে কথা হয় চায়ের দোকানি আলিম মিয়া, আক্কাস আলী, নিজামউদ্দিনের সঙ্গে । তাদের অভিযোগ, ক্রেতার চাহিদার চাপে এ কাপে চা দিতে বাধ্য হন তারা। ব্যবহারের পর ওই কাপ যেখানে-সেখানে ফেলার বিষয় জানতে চাইলে তারা বিষয়টি এড়িয়ে যান।
মোহম্মদপুর টাউনহল বাজারের প্লাস্টিক ব্যবসায়ী সুজন মিয়া জানান, অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান 'ওয়ান টাইম' প্লাস্টিক সামগ্রী বিক্রি করে। প্রতিদিন ১ লাখ 'ওয়ান টাইম' প্লাস্টিকের চায়ের কাপ বিক্রি হয়। প্রকারভেদে প্রতি পিস ৭০ পয়সা থেকে এক টাকা দরে পাইকারি বিক্রি হয়।
সম্প্রতি দেশে ওয়ান টাইম (একবার ব্যবহারযোগ্য) প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। এরমধ্যে রয়েছে বোতল, গ্লাস, কাপ, প্লেট, বক্স ও চামচ। এসব ব্যবহার শেষে এসব পণ্য ফেলে দেওয়া হচ্ছে যেখানে-সেখানে। এতে একদিকে বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি, অন্যদিকে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। এক গবেষণায় দেখা গেছে, গত দুই দশকে শুধু রাজধানীতেই প্লাস্টিক বর্জ্য বেড়েছে ৩ গুণের বেশি বলে জানান বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক আলমগীর কবির।
বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-১৯৯৫ (৬) এর ‘ক’ ধারার লঙ্ঘন। এসব পণ্য বিক্রির জন্য বিক্রেতা ও ব্যবহারকারীর বিভিন্ন দণ্ড নির্ধারণ করা আছে। বাপার সাধারণ সম্পাদক বলেন, ওয়ানটাইম প্লাস্টিক কাপে ব্যবহারে শুধু কারাদনণ্ড না অর্থদণ্ডও রয়েছে। যার জরিমানা ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা হতে পারে।
বাপার সাধারণ সম্পাদক মো. আলমগীর কবির দৈনিক খবর সংযোগকে বলেন, ওয়ানটাইম চায়ের কাপ দোকানে ব্যাপকহারে ব্যবহার হচ্ছে। সহজলভ্যতায় ক্রেতারা তাড়াতাড়ি খেয়ে ফেলে দেন। তিনি বলেন, পরিবেশে প্লাস্টিক বহু বছর ধরে রয়ে যায়। ফলে মাটির উর্বরতা কমে যায়। মাটি বা পানিতে রয়ে যাওয়া প্লাস্টিকের প্রভাব পড়ে স্বাস্থ্যের ওপর। বাস্তুতন্ত্রের ওপর এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব রয়েছে। প্লাস্টিকের ব্যবহার পুরোপুরি এড়ানো সম্ভব না হলেও অনেকটা কমিয়ে আনা সম্ভব। যতটুকু ব্যবহার না করলেই নয়, প্লাস্টিকের ব্যবহার ততটুকুতেই সীমিত রাখতে চেষ্টা করুন। ব্যবহার করতে হলেও ভালো মানের প্লাস্টিক বেছে নিন। মেনে চলুন এর ব্যবহারবিধি। আর খুঁজে নিন পরিবেশবান্ধব বিকল্প। তা ছাড়া প্লাস্টিক পণ্য রিসাইকেল করার প্রতিও গুরুত্ব দিলেন এই পরিবেশবিদ।
