আসন্ন দুর্গপূজাকে সামনে রেখে দেশের ২৯ জেলাকে ‘ঝুঁকিপ্রবণ’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে নাগরিক সমাজকে নিয়ে নবগঠিত প্ল্যাটফর্ম ‘সম্প্রীতি যাত্রা’।
বিগত এক দশকে দেশজুড়ে পূজা ও অন্যান্য সময়ে পূজামণ্ডপ, শোভাযাত্রার রুট বা সংখ্যালঘু বাড়িঘরে হামলার ঘটনা বিশ্লেষণ করে এই ‘ঝুঁকি মানচিত্র’ তৈরি করার কথা জানানো হয়েছে। যেখানে ২৯ টি ‘ঝুঁকিপ্রবণ’ জেলার মধ্যে ৫টি জেলা ‘উচ্চ ঝুঁকিতে’ রয়েছে বলেও জানানো হয়েছে।
শনিবার (২০ সেপ্টম্বর ) ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটে ‘মসজিদ, মন্দির, মাজার, আখড়া ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সুরক্ষায় সম্প্রীতি যাত্রার ডাক এবং আসন্ন দুর্গাপূজায় ঝুঁকি পর্যালোচনা ও করণীয়’ শীর্ষক আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানানো হয়।
তথ্য অনুযায়ী, উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে ঢাকা, রংপুর, যশোর, চাঁদপুর ও নোয়াখালী জেলা।
আর মাঝারি ঝুঁকিতে থাকা জেলার তালিকায় রয়েছে- গাজীপুর, ফরিদপুর, মানিকগঞ্জ, রাজবাড়ী, চট্টগ্রাম, বান্দরবান, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়ীয়া, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, পাবনা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর, লালমনিরহাট, দিনাজপুর, গাইবান্ধা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, খুলনা, কুষ্টিয়া, সুনামগঞ্জ, বরিশাল, পটুয়াখালী এবং নেত্রকোণা।‘
বাকি ৩৫ জেলাকে তারা ঝুঁকিমূক্ত রাখেননি, পরিস্থিতি বিবেচনায় সেসব জেলাগুলোকে ‘নিন্ম ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে।
মীর হুযাইফা আল-মামদূহর ভাষ্য, হামলায় প্রাণহানী ও আহতের সংখ্যা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, একই সময়ে একাধিক স্থানে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার প্রবণতা, ভিন্ন ভিন্ন বছরে পুনরাবৃত্তি, টার্গেটের ধরণ ও পরিসর বিবেচনায় এনে ঝুঁকির মাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
তিনি বলেন, বৈষম্যহীনতার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে ২০২৪ সালের গণআন্দোলনের পরও এ প্রবণতার কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটেনি। বরং গুজব, উসকানি ও সহিংসতার পুনরাবৃত্তির মাধ্যমে মন্দির-মণ্ডপে ভাঙচুর, মাজার ও দরগাহে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট, আখড়া ও বাউল-কাওয়ালি আসরে হামলা, এমনকি মসজিদে রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনার জেরে বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষ ও গোলযোগ সংঘটিত হয়েছে।
‘এসব কেবল বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এগুলো হলো একটি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার বহিঃপ্রকাশ, যার লক্ষ্য বাংলাদেশের সম্প্রীতির ঐতিহ্যকে দুর্বল করা। তাছাড়া এই হামলাগুলো কোনো একক সম্প্রদায়কে লক্ষ্য করে হয়নি; বরং এগুলো বাংলাদেশের সামগ্রিক সামাজিক সংহতি ও সাংবিধানিক শৃঙ্খলার ওপর আঘাত আনতে করা হয়েছে’।
এ সময় তিনি ‘সম্প্রীতি যাত্রা’ নামের কর্মসূচি সূচনার কথা জানিয়ে তিনি বলেন,সাম্প্রদায়িক উসকানি ও বিভ্রান্তি রুখে দিতে আমরা যুক্ত করছি ফ্যাক্টচেকিং টিম। এছাড়াও আমরা যুক্ত করেছি ঝুঁকিপূর্ণ জেলাসমূহের স্থানীয় নাগরিক সমাজের সংগঠন, মাইনরিটি সংগঠন, সুফি ও মাজারভিত্তিক সংগঠন, বাউল ও ফকির সম্প্রদায়, আদিবাসী সংগঠন, নারী সংগঠন, সাংস্কৃতিক সংগঠন, পেশাজীবী সংগঠন এবং রাজনৈতিক দলগুলোর প্রগতিশীল অংশ।
এ সময় তিনি তাদের কর্মপরিকল্পনার অংশ হিসেবে স্থানীয় পর্যায়ে ‘সম্প্রীতি কমিটি গঠন’, মনিটরিং ও নথিভুক্তি, গুজব প্রতিরোধ, দ্রুত সহায়তা কাঠামো গড়ে তোলার কথা বলেন।
সংবাদ সম্মেলনে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক মাহা মির্জা সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনায় অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে ‘শক্ত পদক্ষেপ নেওয়ার বার্তা’ পেলেও মাঠপর্যায়ে ‘দেখতে না পাওয়ায়’ হতাশা ব্যক্ত করেন।
তিনি বলেন, ‘আমরা মনে করি অন্তর্বর্তী সরকার মব ঠেকানো থেকে শুরু করে মাজার পোঁড়ানো এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘু যে গোষ্ঠীগুলো আছে তাদের উপর যে নিপীড়নগুলো হয়েছে, সেগুলোর ব্যপারে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে’।
জুলাই অভ্যুত্থানের পরে এ ধরণের ‘ব্যর্থতা’ এবং এ ধরণের ঘটাগুলোকে ‘স্বাভাবিকায়ন’ করা একেবারেই ‘কাম্য নয়’ বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
তার ভাষ্য, ‘আমরা মনে করি এ ঘরণের জঘণ্য ঘটনাগুলোর স্বাভাবিকায়ন হচ্ছে, যেটা কোনওভাবে হতে দেওয়া যাবে না। এ ধরণের ঘটনার যেন পুনরাবৃত্তি না হয়, সেটার ব্যবস্থা নিতে হবে স্বয়ং রাষ্ট্রকে। সরকার কোনভাবেই হাত ধুয়ে ফেলতে পারেন না’।
সংস্কৃতিকর্মী জামসেদ আনোয়ার তপন বলেন, 'রাষ্ট্র না চাইলে দাঙ্গা হয় না, কথাটি আমাদের দেশের জন্য খুবই প্রযোজ্য এবং সঠিক। সরকার যদি চায় এ ধরণের ঘটনা ঘটবে না। হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের তথ্য অনুযায়ী, গত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ৬ হাজার ৬০০ টি সাম্প্রদায়িক নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছে। একটি ঘটনারও বিচার হয়নি'।
যে ফ্যাসিবাদী সরকার কাঠামো বিতাড়ণের জন্য লড়াই করা হলো, সেই কাঠামো ‘এখনও বিদ্যমান’ বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
শিল্পী অরূপ রাহী বলেন, ‘ কোন ঘটনার কোন সঠিক বিচার এখন পর্যন্ত হয়নাই। গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে আমরা ফ্যাসিস্ট সরকার থেকে একটা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ঢুকবো আশা করে যাত্রা শুরু করলাম বটেই। কিন্তু দুঃখের বিষয় সেই হাসিনা আমলের বিচারহীনতার সংস্কৃতি, সেটা কিন্তু আমরা এখনও দেখতে পাচ্ছি।’
শিল্পী বিথী ঘোষ ‘সম্প্রীতি যাত্রা’ উদ্যোগের বিষয়ে করা এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘সম্প্রীতির যাত্রা একটা উদ্যোগ। এই উদ্যোগে কিছু মানুষ নিজের তাগিদ থেকে যুক্ত হয়েছে। আমরা চাই এই উদ্যোগের বার্তাটা যাতে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। যারা আমাদের সাথে কাজ করতে আগ্রহী তারা যেন যোগাযোগ করতে পারেন।’
এখানে অনেকগুলো পরিকল্পনা দেওয়া আছে, এর বাইরে কারো আরো কোন পরিকল্পনা থাকলে সেই ভাবনাটা যেন উসকে দেয়। শুধু সম্প্রীতির যাত্রার সাথে যুক্তই হতে চান তা নয়, আপনারা নিজেরাও যদি এই উদ্যোগগুলো নেন তাহলে সম্প্রীতির যাত্রা আপনাদের সঙ্গে যুক্ত হবে।
রাজধানীজুড়ে দুর্গাপূজার আমেজ, চলছে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি