চব্বিশের জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণহত্যার দায়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালকে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের নির্দেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
সোমবার (১৭ নভেম্বর) দুপুরে বিচারপতি গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল এ রায় দেন। ট্রাইব্যুনালের অন্য দুই সদস্য হলেন— বিচারপতি শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
বিশ্বজুড়ে যুদ্ধাপরাধ থেকে শুরু করে দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো অপরাধের জন্য নেতাদের মৃত্যুদণ্ড রায় দেওয়া হয়েছে। সর্বশেষ শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। তার মতো একই পরিণতি হয়েছিল ইরাকের সাবেক প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন, পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট জেনারেল (অব.) পারভেজ মোশাররফ, পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোসহ একাধিক বিশ্বনেতার।
শেখ হাসিনার মতো একই পরিণতি যেসব বিশ্বনেতার—
পাকিস্তান : নওয়াজ শরিফ ও পারভেজ মোশাররফ
পলাতক নেতাদের আলোচনায় পাকিস্তানের দুই সাবেক শাসক নওয়াজ শরিফ ও পারভেজ মোশাররফের কথা প্রায়ই উদাহরণ হিসেবে হাজির করা হয়। দুর্নীতির মামলায় দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর ২০১৮ সালে নওয়াজ শরিফ কারাগারে যান। পরে শারীরিক অসুস্থতার কারণে জামিন পান এবং লন্ডনে চিকিৎসার জন্য গিয়ে আর দেশে ফেরেননি তিনি। দীর্ঘ চার বছর পর রাজনৈতিক সমঝোতার পরিবেশ তৈরি হলে তিনি দেশে ফিরেন। ২০২৩ সালে দুর্নীতির সব মামলা থেকে খালাস পান তিনি। কিন্তু পাকিস্তানের সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে বিতর্ক আজও রয়ে গেছে।
অন্যদিকে, ক্ষমতা দখলের অভিযোগে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা এবং একাধিক মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে সাবেক সামরিক শাসক পারভেজ মোশাররফ দুবাইয়ে আত্মগোপন করেন। পাকিস্তানের বিশেষ আদালত তাকে মৃত্যুদণ্ডের রায় দিলেও মোশাররফ কখনোই দেশে ফেরেননি। ২০২৩ সালে তিনি সেখানেই মারা যান তিনি। তার বিচার ও পরিণতি দেশটিতে রাজনৈতিক বিভাজনকে আরও স্পষ্ট করে তোলে।
থাইল্যান্ড : থাকসিন সিনাওয়াত্রা
দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর ২০০৮ সালে থাইল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী থাকসিন সিনাওয়াত্রা দেশত্যাগ করেন। প্রায় ১৫ বছর দুবাই ও লন্ডনে নির্বাসিত জীবন কাটানোর পর ২০২৩ সালে দেশে ফিরে কারাবরণ করেন তিনি। তবে রাজনৈতিক আপস ও রাজকীয় ক্ষমার ফলে তার সাজা দ্রুত কমে আসে। থাকসিনের ঘটনায় বিচার শুধু আইনি নয়; রাজনীতির ক্ষমতা-সমীকরণও এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
শ্রীলঙ্কা : গোতাবায়া রাজাপাকসে
২০২২ সালের ব্যাপক গণ-আন্দোলনের মুখে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে। দেশটিতে ভয়াবহ অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে নাগরিকদের তুমুল আন্দোলনের মুখে দেশ থেকে পালিয়ে যান গোতাবায়া। আত্মগোপনে থাকার সময় তার বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আনা হয়। তবে দেশে ফিরে বিচার এড়াতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। বিচারপ্রক্রিয়ার দুর্বলতা ও রাজনৈতিক সুরক্ষার কারণে গোটাবায়া এখনও কোনও সাজার মুখোমুখি হননি।
ইউক্রেন: ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ
২০১৪ সালের ইউরোমাইদান আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ রাশিয়ায় পালিয়ে যান। পরে ইউক্রেনের আদালত রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে তার অনুপস্থিতিতেই বিচারকাজ শুরু করে এবং এই মামলায় দোষী সাব্যস্ত হন তিনি। রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায় ১৩ বছরের সাজা পেলেও কারাভোগ করতে হয়নি ইউক্রেনের সাবেক এই প্রেসিডেন্টকে।
ইউক্রেনের এই প্রেসিডেন্ট এখনও রাশিয়ায় বসবাস করছেন এবং সেখানে রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা পাচ্ছেন। শক্তিশালী মিত্রদেশ পলাতক নেতার বিচারে যে প্রভাব ফেলতে পারে ইউক্রেনের ইয়ানুকোভিচের ক্ষেত্রে তা স্পষ্ট।
তিউনিসিয়া: বেন আলী
আরব বসন্তে ক্ষমতাচ্যুত তিউনিসিয়ার প্রেসিডেন্ট জিন আল আবেদিন বেন আলী ২০১১ সালে সৌদি আরবে পালিয়ে যান। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়। পরে তার অনুপস্থিতিতে দেশটির আদালত একাধিক সাজার রায় ঘোষণা করে। তবে সৌদি আরবে রাজনৈতিক আশ্রয় পাওয়ায় তিনি আর দেশে ফেরেননি। ২০১৯ সালে সেখানেই মারা যান তিনি।
বলিভিয়া: জিনিন আনেজ ও ইভো মোরালেস
২০১৯ সালে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর বলিভিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট ইভো মোরালেস দেশত্যাগ করেন এবং আশ্রয় নেন আর্জেন্টিনায়। পরে মেক্সিকোতে রাজনৈতিক আশ্রয় নেন তিনি। ২০২০ সালে দেশে ফিরেন তিনি। তার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে উসকানি ও নির্বাচনী অনিয়মের অভিযোগ আনা হলেও পরে তা স্থগিত করা হয়। বর্তমানে বলিভিয়ার রাজনীতিতে সক্রিয় রয়েছেন তিনি।
তবে আইনি ও রাজনৈতিক নানা জটিলতার মুখোমুখি হচ্ছেন। ২০২৪ সালের নভেম্বরে বলিভিয়ার আদালত তাকে ভবিষ্যতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে নিষিদ্ধ করেছে। অন্যদিকে, তার উত্তরসূরি জিনিন আনেজকে পরবর্তীতে বলিভিয়ায় ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়।
জিম্বাবুয়ে: রবার্ট মুগাবে
প্রায় চার দশক ক্ষমতায় থাকা জিম্বাবুয়ের প্রেসিডেন্ট রবার্ট মুগাবে ২০১৭ সালের সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হন। মানবাধিকার লঙ্ঘন, অর্থনৈতিক ধস ও রাজনৈতিক দমন-পীড়নের অভিযোগ সত্ত্বেও তাকে দেশের মধ্যেই নিরাপদ ‘অবসর’ দেওয়া হয়। বিচার এড়ালেও তার শাসনামলের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বহু অভিযোগ রয়েছে। ২০১৯ সালে সিঙ্গাপুরে মারা যান তিনি।
ইরাক: সাদ্দাম হুসেইন
২০০৩ সালে মার্কিন নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ইরাক আক্রমণ করে এবং সাদ্দাম হুসেইনের পতন ঘটে। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তিনি প্রায় আট মাস পালিয়ে ছিলেন। পরে ওই বছরের ১৩ ডিসেম্বর তিকরিতের কাছের একটি এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
পরে ইরাকের বিশেষ ট্রাইব্যুনালে তার বিচার হয়। ১৯৮২ সালে দুজাইল শহরে ১৪৮ জন শিয়া মুসলমানকে হত্যার ঘটনায় তার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ অভিযোগ আনা হয়। পরে এই মামলায় আদালত তাকে দোষী সাব্যস্ত করে এবং ২০০৬ সালের নভেম্বরে তার ফাঁসির রায় ঘোষণা করা হয়। ২০০৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর বাগদাদের ক্যাম্প জাস্টিসে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
লিবিয়া: মুয়াম্মার গাদ্দাফি
২০১১ সালের আরব বসন্তে লিবিয়ার শাসক গাদ্দাফি দেশজুড়ে বিদ্রোহের মুখে আত্মগোপনে যান। পরে বিদ্রোহীদের হাতে বন্দী হন তিনি। গাদ্দাফির বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) মানবতাবিরোধী অপরাধের তদন্ত চলমান রেখেছিল। কিন্তু জীবিত অবস্থায় তাকে বিচারের মুখোমুখি করা সম্ভব হয়নি। তার পতনের পর লিবিয়া দীর্ঘসময় গৃহযুদ্ধ ও বিভক্তির মধ্য দিয়ে গেছে।
উগান্ডা : ইদি আমিন
১৯৭৯ সালে উগান্ডার স্বৈরশাসক ইদি আমিন দেশত্যাগ করে সৌদি আরবে পালিয়ে যান। তার শাসনামলে লাখ লাখ মানুষ হত্যার শিকার হন বলে অভিযোগ করা হয়। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা তার বিচার দাবি করলেও সৌদি আরব তাকে আশ্রয় দেয় এবং তিনি আর কখনো দেশে ফেরেননি। ২০০৩ সালে বিনাবিচারে মারা যান তিনি।
ইথিওপিয়া : মেঙ্গিস্টু হাইলে মারিয়াম
১৯৭৭ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকা ইথিওপিয়ার সামরিক শাসক মেঙ্গিস্টু হাইলে মারিয়ামের বিরুদ্ধে গণহত্যা, গুম ও হাজারো রাজনৈতিক হত্যার অভিযোগ রয়েছে। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তিনি জিম্বাবুয়েতে পালিয়ে যান। ২০০৬ সালে ইথিওপিয়ার আদালত গণহত্যার দায়ে তার অনুপস্থিতিতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়। ইথিওপিয়ার এই শাসককে জিম্বাবুয়ে এখনো আশ্রয় দিয়ে রেখেছে; ফলে বিচার এড়াতে সক্ষম হয়েছেন তিনি।
ফিলিপাইন : ফার্দিনান্দ মার্কোস সিনিয়র
১৯৮৬ সালে ‘পিপল পাওয়ার’ বিপ্লবে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর মার্কোস পরিবার হাওয়াইতে পালিয়ে যায়। মার্কোস সিনিয়রের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও সম্পদ লুটের অভিযোগে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা হয়। নির্বাসনে থাকাকালীন ১৯৮৯ সালে মারা যান তিনি। তবে তার পরিবার ফিলিপাইনের রাজনীতিতে সক্রিয় থেকে যায় এবং ২০২২ সালে তার ছেলে ফার্দিনান্দ ‘বংবং’ মার্কোস জুনিয়র নির্বাচনে জয়ী হয়ে প্রেসিডেন্ট হন। ফিলিপাইনের ইতিহাসে এটি এক ব্যতিক্রমী অধ্যায়।
তুরস্ক: ফেতুল্লাহ গুলেন
২০১৬ সালে ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের চেষ্টা হয় তুরস্কে। পরে দেশটির প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ান এজন্য ‘গুলেন আন্দোলনকে’ দায়ী করেন। এর নেতা ফেতুল্লাহ গুলেন বহু বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন। তুরস্ক তাকে রাষ্ট্রদ্রোহী ঘোষণা করে প্রত্যর্পণ দাবি করলেও যুক্তরাষ্ট্র তাতে সাড়া দেয়িনি। তুরস্কের বিভিন্ন আদালত ফেতুল্লাহর অনুপস্থিতিতেই তার বিরুদ্ধে কয়েক ডজন মামলার রায় ঘোষণা করেছে।
ইয়েমেন: আলী আবদুল্লাহ সালেহ
২০১১ সালের আরব বসন্তে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে প্রথমে সৌদি আরবে পালিয়ে যান ইয়েমেনের প্রেসিডেন্ট সালেহ। পরে দেশে ফিরে গৃহযুদ্ধে অংশ নেন তিনি। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ ছিল। ২০১৭ সালে হুথি বিদ্রোহীদের সঙ্গে সংঘর্ষে নিহত হন সালেহ। তার বিচার কখনোই কার্যকর হয়নি। ইয়েমেন আজও গৃহযুদ্ধের সংঘাতে জর্জরিত।
শেখ হাসিনার ফাঁসির রায়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে জাতিসংঘ মানবাধিকার হাইকমিশন