ঢাকা
সোমবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৫, ২ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
ই-পেপার

এলডিসি থেকে উত্তরণে সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ প্রয়োজন

আপডেট : ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৭:৩১ পিএম

এলডিসি (Least Developed Countries) থেকে উত্তরণে সরকার ও ব্যবসায়ী সংগঠনের মধ্যে বেশ টানাপড়েন লক্ষ করা যাচ্ছে। সরকার বলছে, আমরা এলডিসি থেকে উত্তরণ পেছাবো না, অর্থাৎ ২০২৬ সালের যথাসময়ে বাংলাদেশ এলডিসি থেকে উত্তরণ হবে। বিপরীত দিকে সংগঠনগুলো বলছে, এলডিসি থেকে উত্তরণে প্রস্তুতির জন্য যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। সুতরাং, এলডিসি থেকে উত্তরণ হবে বাংলাদেশের জন্য আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। এখন প্রশ্ন হলো— এলডিসি থেকে উত্তরণ বাংলাদেশের জন্য কতটা যৌক্তিক?

১৯৭১ সালে প্রতিষ্ঠার পর গত পাঁচ দশকে সব মিলিয়ে ৮টি দেশ এলডিসি থেকে উত্তরণ হয়েছে। উত্তরিত ৮টি দেশ হতে একটু অভিজ্ঞতা নেওয়া যেতে পারে। ওইসব রাষ্ট্র কখনো এলডিসি থেকে উত্তরণ হয়েছে, উত্তরণের ফলে বর্তমান অবস্থা এবং উত্তরণের পরপর তাদের কী অবস্থা হয়েছিল? তবে এলডিসি থেকে উত্তরণে অনেক দেশ নানা ধরনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেছে এবং শেষপর্যন্ত সফল হয়েছে। ঝুঁকি বলতে বোঝানো হয়— বাণিজ্য নির্ভরতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, দারিদ্র্যের উচ্চ হার, অবকাঠামোগত দুর্বলতা অথবা বহিঃনির্ভরশীল অর্থনীতি। তবুও সঠিক পরিকল্পনা ও সংস্কারের মাধ্যমে কিছু দেশ সফলভাবে উত্তরণ ঘটাতে পেরেছে। তাই বাংলাদেশ যে পারবে না এমনটা ভাবা সমীচীন হবে না। ভুটান ভৌগোলিকভাবে পাহাড়ি ও দুর্গম এলাকা, অবকাঠামোগত দুর্বল এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ একটি রাষ্ট্র। তবুও শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবেশ সংরক্ষণ ও বিদ্যুৎ (হাইড্রোপাওয়ার) খাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন করেছে এবং লাওস একটি স্থলবেষ্টিত রাষ্ট্র হওয়ার কারণে বৈদেশিক বাণিজ্যে বড় সীমাবদ্ধতা ছিল। দারিদ্র্যের হারও ছিল বেশ উঁচু। তবুও আঞ্চলিক সহযোগিতা (আসিয়ান) ও অবকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগের মাধ্যমে তারা উত্তরণের পর্যায়ে পৌঁছেছে। দেশ দুটি নিয়ে বাংলাদেশের সাথে যদি তুলনা করা যায়, তাহলে বাংলাদেশই বর্তমান অবস্থায় এগিয়ে থাকবে। কারণ বাংলাদেশ স্থলবেষ্টিত দেশও নয়, আবার পাহাড়ি দুর্গম এলাকাও নয়। সুতরাং, এসব রাষ্ট্র পারলে বাংলাদেশ কেন পারবে না সেটাই প্রশ্ন?

গত ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫ তারিখে অর্থনৈতিক সাংবাদিকদের সংগঠন ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) আয়োজনে অনুষ্ঠিত ‘এলডিসি থেকে উত্তরণ ও বাংলাদেশের প্রস্তুতি’ শীর্ষক সেমিনারে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, এলডিসি উত্তরণ নিয়ে সরকার আগের অবস্থানে আছে। নতুন কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে তথ্য-উপাত্ত নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। আবার এটাও মনে রাখতে হবে, বিতর্কও অনেক সময় ছিনতাই হয়ে যায়। কারণ ব্যবসায়ীরা যখন কথা বলেন তখন প্রকৃত তথ্য-উপাত্তের চেয়ে আবেগকে বেশি গুরুত্ব দেন। প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী আনিসুজ্জামান চৌধুরী বলেন, স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উত্তরণ পিছানোর আবেদন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার করবে না। আগামী নির্বাচিত সরকার চাইলে এ আবেদন করতে পারে। তিনি যুক্তি দাঁড় করান— নেপাল ও লাওস যদি পেছনের আবেদন করে, বাংলাদেশও করতে পারে। জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসিতে (জিডিপি) গিয়ে সময় চাওয়ার কথা বলতে হবে। তবে নেপাল ও লাওস উত্তরণ করতে পারলে, আমরা কেন পারবো না? তাদের দুজনের কথা অত্যন্ত যুক্তিশীল এবং সরকার পক্ষ থেকে স্পষ্ট করেছেন যে, সরকার আর এলডিসি থেকে উত্তরণে পিছাতে চায় না। তাদের কথার যতটা স্পষ্ট; ঠিক অনুরূপভাবে বলা যায়, এলডিসি থেকে উত্তরণের দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য ততটাই অস্পষ্ট। তারা অনেক যুক্তি দিয়ে বুঝিয়েছেন; কিন্তু একটু আবেগী হয়েছিলেন বলে মনে হয়। সরকারি উচ্চপর্যায়ে থেকে আবেগী হওয়ার সুযোগ নেই। তথ্য-উপাত্ত দিয়ে বুঝিয়ে দিতে হবে এবং সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা থাকতে হবে। ছোটরা বরাবর বড়দের কাছে আবেদন করবে। বড়দের সেই জায়গা থেকে দায়িত্বশীল আচরণটা করতে হবে। এটা সত্য, সরকার চাইলে উত্তরণ ঠেকানোর জন্য যথেষ্ট তথ্য-উপাত্ত সরকারের কাছে নেই। বাস্তবতা হলো, এটাই বিগত যে ৮টি রাষ্ট্র এলডিসি থেকে উত্তরণ হয়েছে, তারা ৩টি শর্তের মধ্যে দুটি শর্ত পূরণ করে হয়েছে। বাংলাদেশ একমাত্র দেশ, যেখানে ৩টি শর্তই সম্পূর্ণরূপে পরিপালন হয়েছে। সুতরাং, উত্তরণ পিছনো এতটা সহজ হবে না। যদি পিছনো সম্ভব না হয়, তার মানে আপনাকে উত্তরণের পূর্বে ওপরে কিছু কর্মসূচি বা কর্মপন্থা হাতে নিতে হবে এবং সেই কর্মসূচি সবার মাঝে স্পষ্ট করে দিতে হবে।

রপ্তানি বাণিজ্যের বিভিন্ন সংগঠন, বিভিন্নভাবে দাবি করছে এবং এ বিষয়ে সভা-সেমিনার করছে, তারা বুঝাতে চাচ্ছে যে এলডিসি থেকে উত্তরণের যথেষ্ট প্রস্তুতি নেই। তাই এলডিসি থেকে উত্তরণের জন্য আরও তিন বছর সময় প্রয়োজন। এ কথা সত্য যে, সুবিধা পেতে কে না চায়; সুবিধা নিতে পারলে সেটা অবশ্যই রাষ্ট্রের জন্য ভালো। কিন্তু সেই সুবিধা নেওয়ার জন্য যথেষ্ট তথ্য-উপাত্ত থাকতে হবে। আপনি সঠিক যুক্তি উপস্থাপনের মাধ্যমে আপনার সুবিধাটি অর্জন করতে পারবেন। একটু পিছনে গেলে দেখা যায়, এলডিসি থেকে উত্তরণের জন্য সর্বপ্রথম নির্বাচিত হয় ২০১৮ সালে। কারণ ওই বছর বাংলাদেশ এলডিসি থেকে উত্তরণের জন্য ৩টি শর্তই পূরণ করে। তিন বছর পর ২০২১ সালে পুনরায় বাংলাদেশের মানদণ্ড নিয়ে পুনঃমূল্যায়ন হয়, শেখানে বাংলাদেশ ৩টি শর্ত ভালোভাবে পূরণ করে এবং ওই বছর চূড়ান্ত সুপারিশ পাই যে, ২০২৪ সালে এলডিসি থেকে বেরিয়ে যাবে বাংলাদেশ। কিন্তু করোনা মহামারির কারণে দু-বছর সময় পিছিয়ে দিয়ে ২০২৬ সাল নির্ধারণ করা হয়। এখানে ২০১৮ সালকে ভিত্তিবছর ধরা হয়, তাহলে আট বছর সময় পেলো বাংলাদেশ, আবার ২০২১ সাল ভিত্তিবছর ধরলেও বাংলাদেশ পাঁচ বছর সময় পেলো। অতএব, এ সময়টি যথেষ্ট ছিল না? গত ২৩ এপ্রিল ২০২৫ তারিখে অনুষ্ঠিত ‘স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ : প্রস্তুতি ও বাস্তবতা’ শীর্ষক এক বৈঠকে চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের গবেষণাপ্রধান ইশতিয়াক বারী বলেন, ‘বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশে থেকে উত্তরণের ৩টি শর্তই পূরণ করেছে। ২০২৬ সালের ২৪ নভেম্বর থেকে বাংলাদেশ এ তালিকা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কথা। কিছু দেশ ও অঞ্চলে বাংলাদেশের বাণিজ্যে শুল্কছাড় সুবিধা ২০২৯ সাল পর্যন্ত থাকবে। আর ওষুধ উৎপাদনে মেধাস্বত্বে ছাড় সুবিধা থাকবে ২০৩৩ সাল পর্যন্ত।’

সুতরাং, বাংলাদেশ এলডিসি থেকে উত্তরণের জন্য কিছুটা হলেও সময় পাচ্ছে। এটিকে আশীর্বাদ হিসেবে ধরে চেষ্টা করতে হবে আরও সময় পিছানোর। যদি সময় পাওয়া যায়, সেটা আমাদের জন্য বড়ই সৌভাগ্যের; কিন্তু যদি না পাওয়া যায় সেটি হবে ব্যর্থতা। তবে চেষ্টা করতে দোষের কিছু নেই, একটু চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে। প্রয়োজনে রপ্তানিকারকদের সাথে নিয়ে কোনো উপায় খুঁজে পাওয়া যায় কি না, সে বিষয়টি খতিয়ে দেখা দরকার। তখন রপ্তানিকারকরাও বুঝবে, সরকার আমাদের প্রতি আন্তরিক। সময় পিছাতে না পারলেও তাদের আর আফসোস থাকবে না। সরকারকে আরও একটু দায়িত্বশীল হওয়া প্রয়োজন এ বিষয়টি নিয়ে, সরকারকে নিশ্চিত করা প্রয়োজন বিনিয়োগ পরিবেশ, সমুদ্রবন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধি, দেশের অভ্যন্তরে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরগুলোকে আরও আধুনিকায়ন, দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি এবং বিদ্যুৎ ও গ্যাসের নিরবচ্ছিন্ন সংযোগ স্থাপন, দেশের সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা ইত্যাদি বিষয়গুলো রপ্তানিকারকদের এবং ব্যবসায়ীদের শতভাগ নিশ্চয়তা প্রদান করা। সরকারের উচিত সরকার ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বস্ত সম্পর্ক ও সৌহার্দ্য স্থাপন করা।

লেখক : ব্যাংকার ও কলামিস্ট

NJ
আরও পড়ুন