ঢাকা
সোমবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৫, ২ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
ই-পেপার

ফুলঝাড়ু টেকসই উন্নয়নে সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত

আপডেট : ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৩:৪০ পিএম

বাংলাদেশের শহরে কিংবা গ্রামীণ-জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য উপকরণ হলো ফুলঝাড়ু। ভোরবেলায় জানালা দিয়ে প্রথম সূর্যের আলো ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে অধিকাংশ বাসায় শুরু হয় ঘর পরিষ্কারের কাজ। আধুনিক ভ্যাকুয়াম ক্লিনার বা মপ থাকলেও এখনো আমাদের ঘরের মেঝে ঝাড় দেওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় এক প্রাচীন ও পরিবেশবান্ধব উপকরণ, ফুলঝাড়ু। দেখতে সরল; কিন্তু কার্যকারিতায় অসাধারণ এই ঝাড়ু তৈরি হয় খাগড় বা ফুলঝাড়ু ঘাসের শুকনো ফুল দিয়ে, যা প্রকৃতির দান এবং দীর্ঘকাল ধরে গ্রামীণ অর্থনীতির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ।

গত দুই দশকে ঝাড়ু তৈরির প্রধান উপকরণ হয়ে উঠেছে পাহাড়ি অঞ্চলে জন্মানো বিশেষ ঘাস Thysanolaena maxima, যা পোয়াসি (Poaceae) পরিবারের অন্তর্গত। বাংলাদেশে এটি সাধারণভাবে ফুলঝাড়ু ঘাস নামে পরিচিত হলেও অঞ্চলভেদে ঝাড়ুঘাস, ঝাড়ুপাতা, ফুলঘাস বা বনঝাড়ু নামেও ডাকা হয়। বিভিন্ন আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে এর রয়েছে নিজস্ব নাম— চাকমারা বলে সুইপ ঘাস, মারমারা মুলুক ঘাস, গারোদের কাছে থ্রুং নামে পরিচিত। প্রতিবেশী দেশগুলোয় নামের ভিন্নতা লক্ষ করা যায় আসামে ফুল জাহরু, মেঘালয়ে থিসান ঘাস, নেপালে আম্রিসো ঘাস। ইংরেজিতে পরিচিত নামগুলো হলো— Broom grass, Tiger grass, Bouquet grass, Asian broom grass ও Bamboo grass। নামের এ বৈচিত্র্য প্রমাণ করে উদ্ভিদটি বিভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। এটি বহুবর্ষজীবী ঘাস, যা মূলত পাহাড়ি ঢাল, টিলা এবং লালচে মাটির অনুর্বর জমিতে ভালো জন্মে। ফুলের মতো পুষ্পমঞ্জরিই পরবর্তীতে ঝাড়ুর মূল উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

বাংলাদেশে ফুলঝাড়ু ঘাস মূলত চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ির পাহাড়ি অঞ্চল এবং শেরপুর ও সিলেটের টিলায় জন্মে। এছাড়া ময়মনসিংহ, জামালপুর, নেত্রকোনা, টাঙ্গাইল, কুমিল্লা, কিশোরগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, সাতক্ষীরাসহ বিভিন্ন অঞ্চলেও পতিত এবং অনুর্বর জমিতে উৎপাদিত হয়। নদীর চর, পতিত জমি, আর্দ্র এলাকা এবং পাহাড়ি ঢাল এই ঘাসের জন্য উপযুক্ত।

এই ঘাস প্রাকৃতিকভাবে উৎপন্ন হয়। তবে প্রথাগতভাবে চাষের জন্য বর্ষাকালের শুরুতে বীজ ছিটিয়ে বা সারিতে বপন করা হয়। প্রায় সাত-আট মাস পর গাছ ফুলে ওঠে। শীতের শুরুতে শুকনো ফুল কেটে রোদে শুকিয়ে, তারপর বাঁশ বা কাঠের হাতলে বেঁধে তৈরি হয় আমাদের পরিচিত ফুলঝাড়ু। ১৯৯০-এর দশকের শেষদিকে কৃষকরা এটিকে বাণিজ্যিকভাবে চাষ শুরু করে। এর আগে ঝাড়ুর চাহিদা পূরণ হতো নারিকেলের পাতার শলা, খেজুর পাতা বা খড় থেকে তৈরি ঝাড়ু দিয়ে। কিন্তু সেগুলো ছিল তুলনামূলক ভারী ও কম টেকসই। ফুলঝাড়ু ঘাস থেকে তৈরি ঝাড়ু হালকা, টেকসই, ব্যবহার উপযোগী এবং দেখতে আকর্ষণীয় হওয়ায় দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বর্তমানে শহর ও গ্রাম উভয় এলাকায় ঝাড়ু বলতে প্রায় সবাই ফুলঝাড়ুই বোঝেন।

ফুলঝাড়ুর চাষ কেবল অর্থনৈতিক সুবিধা নয়, পাহাড়ি অঞ্চলের পরিবেশ সংরক্ষণেও গুরুত্বপূর্ণ। পাহাড়ি ঢাল ভূমিধসের ঝুঁকিতে থাকলেও এর গুচ্ছমূল মাটি আঁকড়ে ধরে মাটিক্ষয় রোধ করে প্রাকৃতিক বাঁধের মতো কাজ করে। এতে ভূমিধস কমে পাহাড় পুনরুজ্জীবিত হয়। বিশেষত, জুমচাষে ক্ষতিগ্রস্ত ঢাল পুনর্বাসনে ফুলঝাড়ু ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্য হয়েছে। এক বছরের মধ্যে এ ঘাস ঢালকে সবুজ আচ্ছাদনে ঢেকে ফেলে। পাহাড়ি অঞ্চলে যেখানে ফসলি জমি সীমিত, সেখানে এটি টেকসই জীবিকার উৎস। সাম্প্রতিক সময়ে কাজুবাদামসহ ফলগাছের সঙ্গে আন্তঃফসল হিসেবে এর জনপ্রিয়তা বাড়ছে। সাধারণত মোথা বা কাটিং রোপণ করে চাষ করা হয়, যা এক বছরের মধ্যে আহরণযোগ্য হয় এবং টানা তিন থেকে চার বছর ফলন দেয়। প্রথম বছরে ফলন কম হলেও দ্বিতীয় ও তৃতীয় বছরে সর্বাধিক হয়, আর চতুর্থ-পঞ্চম বছরে ধীরে কমতে থাকে, ফলে নতুন চারা লাগাতে হয়। এ চাষে সার বা কীটনাশকের প্রয়োজন নেই, ফলে পরিবেশ দূষণের ঝুঁকিও নেই। খরা সহিষ্ণু এ বহুবর্ষজীবী ফসল পাহাড়কে সবুজে ঢেকে জুমচাষে ক্ষতিগ্রস্ত জমি পুনর্বাসনে কার্যকর ভূমিকা রাখছে। রাঙামাটির মতো এলাকায় এখন বাণিজ্যিক চাষ হয়ে কৃষকদের আয়ও বাড়াচ্ছে।

বাজার বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে প্রতিবছর কয়েক কোটি টাকার ফুলঝাড়ু বিক্রি ও বাজারজাত হয়, যা স্থানীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সাধারণত একটি ঝাড়ুর দাম ৫০ থেকে ১০০ টাকার মধ্যে ওঠানামা করে, ফলে এটি নিম্নআয়ের মানুষের কাছেও সহজলভ্য থাকে। গ্রামীণ নারীরা গৃহস্থালি কাজে ব্যবহারের পাশাপাশি ঝাড়ু তৈরি করে স্থানীয় হাটে-বাজারে বিক্রি করেন, এতে তাদের হাতে আসে বাড়তি আয় এবং আর্থিক স্বনির্ভরতা গড়ে ওঠে। একটি ঝাড়ু তৈরিতে প্রায় ২৫০-৩০০ গ্রাম শুকনো ফুলঝাড়ু ঘাস লাগে। প্রতিবিঘা জমি থেকে বছরে গড়ে ১,৫০০-২,000 কেজি শুকনো ঘাস পাওয়া যায়, যা থেকে একজন কৃষক প্রায় ৫০-৬০ হাজার টাকা আয় করতে পারেন। পাহাড়ি কৃষকদের জন্য এটি একটি নির্ভরযোগ্য আয়ের উৎস। বর্তমানে বিভিন্ন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ও স্থানীয় সমবায় সমিতি ফুলঝাড়ুর চাষ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বাজারজাতকরণে সহায়তা করছে, ফলে হাজারো নারী ও যুবকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে।

বাংলাদেশে উৎপাদিত ফুলঝাড়ু শুধু অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণ করছে না; বরং আন্তর্জাতিক বাজারেও এর বিস্তার ক্রমে বাড়ছে। প্রতিবেশী দেশ ভারত, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা এবং মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে নিয়মিত রপ্তানি হচ্ছে। সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, প্রতিবছর কয়েকশ’ টন শুকনো ফুলঝাড়ু ঘাস বিদেশে যাচ্ছে, যা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বিশ্ববাজারে ঝাড়ুর কাঁচামাল হিসেবে এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে, বিশেষত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও ইউরোপে। ইতোমধ্যে এটি বাণিজ্যিক পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। পরিবেশবান্ধব ও প্রাকৃতিক উপাদান হওয়ায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারে এর সম্ভাবনা আরও বাড়ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, আধুনিক প্রযুক্তি ও নীতিগত সহায়তা পেলে রপ্তানি আয় উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ানো সম্ভব।

বাংলাদেশে উৎপাদিত ফুলঝাড়ু কেবল দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাচ্ছে না; বরং আন্তর্জাতিক বাজারেও এর গ্রহণযোগ্যতা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রতিবেশী দেশ ভারত, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা ছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ থেকে নিয়মিত ঝাড়ু রপ্তানি হচ্ছে। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রতিবছর কয়েকশ’ টন শুকনো ফুলঝাড়ু ঘাস রপ্তানি করা হয়, যা দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। বিশ্ববাজারে ঝাড়ুর কাঁচামাল হিসেবে এই ঘাসের ব্যাপক চাহিদা বিদ্যমান, বিশেষত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও ইউরোপের বাজারে। ইতোমধ্যে এটি আনুষ্ঠানিকভাবে বাণিজ্যিক পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। পরিবেশবান্ধব ও প্রাকৃতিক উপাদান হিসেবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারে এর সম্ভাবনা আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সঠিক নীতিগত সহায়তা ও আধুনিক প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রযুক্তি যুক্ত হলে বাংলাদেশ এই খাতে আরও বড় রপ্তানি আয়ের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারবে।

যদিও বাংলাদেশে ফুলঝাড়ু উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে, তবুও গবেষণা ও উন্নয়ন পর্যাপ্ত নয়। ঘাসের উন্নত জাত উদ্ভাবন, সংরক্ষণ প্রক্রিয়া, দীর্ঘমেয়াদি বাজার পরিকল্পনা এবং আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী প্যাকেজিং ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং স্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যদি ফুলঝাড়ুর ওপর গবেষণা জোরদার করে, তবে এর উৎপাদনশীলতা দ্বিগুণ করা সম্ভব। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মানের সার্টিফিকেশন নিশ্চিত করা গেলে বিদেশি বাজারে বাংলাদেশি ফুলঝাড়ু একটি বড় পণ্য হিসেবে দাঁড়াতে পারে। জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ফুলঝাড়ু পরিবেশ রক্ষা, দারিদ্র্য বিমোচন, নারীর ক্ষমতায়ন এবং বৈশ্বিক অংশীদারিত্ব গড়ে তোলার ক্ষেত্রে কার্যকর মাধ্যম হতে পারে। এটি পাহাড়ি ঢালকে সবুজ আচ্ছাদনে রূপান্তর করে মাটিক্ষয় ও ভূমিধস রোধ করে, ফলে পরিবেশকে টেকসই রাখে। একইসঙ্গে ঝাড়ু তৈরির মাধ্যমে স্থানীয় নারীরা ও যুবক-যুবতীর কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়, আয় বৃদ্ধি পেয়ে দারিদ্র্য কমে। এভাবে ফুলঝাড়ু স্থানীয় অর্থনীতি ও সামাজিক কাঠামো শক্তিশালী করার পাশাপাশি পরিবেশ ও টেকসই উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।

বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজে ফুলঝাড়ু কেবল একটি গৃহস্থালি পণ্য নয়; বরং এটি অর্থনৈতিক সম্ভাবনার প্রতীক হয়ে উঠেছে। পাহাড় রক্ষা, পরিবেশ সংরক্ষণ, নারীর ক্ষমতায়ন, কর্মসংস্থান এবং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সবদিক থেকে ফুলঝাড়ুর গুরুত্ব অপরিসীম। সঠিক পরিকল্পনা, গবেষণা ও সরকারি সহায়তা পেলে ফুলঝাড়ু বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী করতে পারবে এবং আন্তর্জাতিক বাজারে ‘গ্রিন প্রোডাক্ট’ হিসেবে দেশের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে।

লেখক: কৃষিবিদ, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা ও চেয়ারম্যান, ডিআরপি ফাউন্ডেশন

আরও পড়ুন