কখনো খেয়াল করেছেন কি? যতটা মেধাবী, যতটা যোগ্য কর্মী, বসের সামনে ততটাই ঝুঁকিপূর্ণ মনে হয়? অনেক সময় যোগ্য কর্মীর প্রমোশন ও আটকে যায় এই ফাঁদে। প্রশ্ন হচ্ছে- কেন যোগ্য কর্মীরা বসের চোখে হুমকি হয়ে দাঁড়ায়?
বাংলাদেশের কর্পোরেট কালচারে এখনো অনেক বস তাদের অবস্থানকে ‘পজিশন অব পাওয়ার’ মনে করেন। যখন টিমে কেউ এমনভাবে পারফর্ম করে যে, তার কাজ, আইডিয়া কিংবা জনপ্রিয়তা বসের চেয়ে বেশি হাইলাইট হয়, তখনই বসের মাথায় একটা অ্যালার্ম বাজে-এই লোকটা ভবিষ্যতে আমার জায়গা নিতে পারে!
সমাধান কোথায়?
কোনো প্রতিষ্ঠানের সাফল্যের মূল চালিকাশক্তি হলো দক্ষ, সৎ ও দায়িত্বশীল কর্মী। কিন্তু অনেক সময় দেখা যায়, একজন সত্যিকারের যোগ্য কর্মীই অফিস রাজনীতির শিকার হন, কিংবা বসের চোখে তিনি হয়ে ওঠেন হুমকি। প্রশ্ন জাগে- কেন এমন হয়? আসলে এর পেছনে রয়েছে মনস্তাত্ত্বিক, সাংগঠনিক ও ব্যক্তিগত নানা কারণ। নিচে আমরা সেসব বিষয় গভীরভাবে আলোচনা করবো।
১. ক্ষমতা হারানোর ভয়
বেশিরভাগ বস বা ম্যানেজার তাদের অবস্থান ধরে রাখতে চান যেকোনো মূল্যে। একজন যোগ্য কর্মী যখন ক্রমাগত দক্ষতা দেখাতে থাকেন, তখন বসের মনে আশঙ্কা জন্মায়—
- কর্মীর জনপ্রিয়তা বাড়ছে
- কর্তৃপক্ষ বা মালিকের চোখে কর্মী হয়তো বেশি বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠছেন
- সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তিনি বসের জায়গায় বসার যোগ্য হয়ে উঠতে পারেন
এই ভয়ের কারণে বস অনেক সময় সচেতন বা অবচেতনভাবে ওই কর্মীকে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখতে শুরু করেন।
২. আত্মবিশ্বাসের অভাব ও হীনমন্যতা
সব বস সমান নেতৃত্বগুণসম্পন্ন নন। যাদের আত্মবিশ্বাস কম, তারা সবসময় আশেপাশের মানুষকে সন্দেহের চোখে দেখেন। যখনই কোনো কর্মী নতুন কোনো আইডিয়া দেন, সমস্যা সমাধানে দ্রুত পদক্ষেপ নেন বা টিমকে অনুপ্রাণিত করেন, তখন অযোগ্য বা দুর্বল বসের ভেতরে হীনমন্যতা কাজ করে।
ফলে তিনি মনে করেন- ‘এই কর্মী আমার ক্ষমতা ছিনিয়ে নেবে।’
৩. অফিস রাজনীতি ও ঈর্ষা
অফিসে রাজনীতি নতুন কিছু নয়। সহকর্মীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা, পদোন্নতি নিয়ে লড়াই- সবই সাধারণ ব্যাপার। একজন কর্মী যখন তার যোগ্যতা দিয়ে সবার থেকে আলাদা হয়ে ওঠেন, তখন শুধু বসই নয়, সহকর্মীরাও ঈর্ষান্বিত হয়ে ওঠেন। বস যদি দুর্বল মানসিকতার হন, তবে তিনি সহজেই এই ঈর্ষার ফাঁদে পড়ে কর্মীর প্রতি নেতিবাচক মনোভাব তৈরি করেন।
৪. নিয়ন্ত্রণ হারানোর আশঙ্কা
অনেক বস চান কর্মীরা যেন সবসময় তাদের নির্দেশের অপেক্ষায় থাকেন। কিন্তু যোগ্য কর্মীরা সচরাচর স্বাধীনভাবে কাজ করতে পছন্দ করেন। তারা সবকিছু খুঁটিনাটি জিজ্ঞেস না করে নিজের বিচারবুদ্ধি দিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম। এতে বসের মনে হয় তিনি নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছেন। এটাই তাদের চোখে যোগ্য কর্মীকে হুমকিতে পরিণত করে।
৫. প্রতিষ্ঠানের সংস্কৃতি ও নেতৃত্ব সংকট
যেসব প্রতিষ্ঠানে নেতৃত্ব উন্নয়নের সুযোগ নেই বা যেখানে “বস” মানে কেবল ক্ষমতা প্রদর্শন, সেখানে যোগ্য কর্মীরা টিকে থাকতে পারেন না। এই ধরনের পরিবেশে বসরা যোগ্য কর্মীকে সহযোগী হিসেবে নয়, বরং প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখেন। অন্যদিকে যেসব প্রতিষ্ঠানে নেতৃত্বগুণসম্পন্ন বস আছেন, তারা যোগ্য কর্মীকে হুমকি নয়, বরং প্রতিষ্ঠানের সম্পদ হিসেবে দেখেন।
৬. প্রশংসা ভাগ করতে না চাওয়া
যোগ্য কর্মী যখন কাজের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানকে উন্নতির পথে নিয়ে যান, তখন প্রাপ্য প্রশংসা স্বাভাবিকভাবেই তার দিকে আসে। কিন্তু কিছু বস চান সব কৃতিত্ব নিজের নামে নিতে। ফলে কর্মী যতই যোগ্য হন না কেন, বস তার অবদানকে খাটো করতে চান, এমনকি মাঝে মাঝে তাকে উপেক্ষা করেন বা ভুল ধরতে চেষ্টা করেন।
৭. ভিন্ন মতের প্রতি অসহিষ্ণুতা
যোগ্য কর্মীরা সাধারণত নতুন চিন্তা, ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি এবং চ্যালেঞ্জিং প্রশ্ন করতে দ্বিধা করেন না। কিন্তু যেসব বসের মনোভাব কর্তৃত্ববাদী, তারা এ ধরণের আচরণ পছন্দ করেন না। তারা মনে করেন কর্মী তাদের সিদ্ধান্তকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। ধীরে ধীরে ওই কর্মী তাদের চোখে “অশান্তির কারণ” হয়ে ওঠেন।
দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব
যোগ্য কর্মীকে হুমকি মনে করার ফলাফল শুধু কর্মীর জন্য নয়, প্রতিষ্ঠানের জন্যও ক্ষতিকর। যেমন—
- মেধাবী কর্মীরা হতাশ হয়ে প্রতিষ্ঠান ছেড়ে যান
- অফিসের ভেতরে নেতিবাচক সংস্কৃতি তৈরি হয়
- উদ্ভাবনী চিন্তা বাধাগ্রস্ত হয়
- শেষ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠান প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ে
সমাধানের পথ
- সব সমস্যার সমাধান আছে। বস ও কর্মী উভয়ের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করলে এই সংকট কাটানো সম্ভব।
- বসের দায়িত্ব হলো যোগ্য কর্মীকে প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, সহযোগী হিসেবে দেখা। তার দক্ষতা কাজে লাগিয়ে প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে নেওয়া।
- কর্মীর দায়িত্ব হলো বিনয়ী থাকা, বসকে সম্মান করা, এবং কাজের স্বীকৃতি ভাগ করে নিতে শেখা।
- প্রতিষ্ঠানের উচিত প্রশিক্ষণ ও নেতৃত্ব উন্নয়ন কার্যক্রম চালু করা, যাতে বস ও কর্মী উভয়ে সহযোগিতামূলক পরিবেশে কাজ করতে পারেন।
এর নেতিবাচক প্রভাব
যোগ্য কর্মীকে হুমকি মনে করার ফলে—
- মেধাবীরা হতাশ হয়ে প্রতিষ্ঠান ছেড়ে যান
- অফিসে নেতিবাচক সংস্কৃতি তৈরি হয়
- উদ্ভাবন বাধাগ্রস্ত হয়
- দীর্ঘমেয়াদে প্রতিষ্ঠান প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ে
যোগ্য কর্মীরা সত্যিই অনেক সময় অন্যায়ের শিকার হন, কিন্তু একটু কৌশল অবলম্বন করলে তারা এসব চ্যালেঞ্জ সামলাতে পারেন। নিচে কিছু কার্যকর উপায় তুলে ধরলাম:
১. পেশাদারিত্ব বজায় রাখা
যতই বিরূপ পরিস্থিতি আসুক না কেন, নিজের কাজের মান ধরে রাখতে হবে। যোগ্য কর্মীরা যদি হঠাৎ আবেগের বশে প্রতিক্রিয়া দেখান, তবে সেটাই বস বা সহকর্মীদের কাছে দুর্বলতার সুযোগ হয়ে দাঁড়ায়।
২. বিনয় ও নম্রতা প্রদর্শন
দক্ষতা দেখানোর পাশাপাশি সবসময় বিনয়ী থাকা জরুরি। কখনোই নিজের কৃতিত্ব অহংকারের সঙ্গে প্রকাশ করা উচিত নয়। এতে বসের মনে হুমকি নয়, বরং সহযোগী হিসেবে ইমেজ তৈরি হয়।
৩. বসের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলা
- নিয়মিত ফিডব্যাক চাওয়া
- গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে বসের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া
- তাদের অভিজ্ঞতার প্রশংসা করা
- এসব করলে বস মনে করবেন কর্মী তাকে মূল্য দিচ্ছে, প্রতিদ্বন্দ্বী নয়।
৪. নিজের অবদান দলগতভাবে উপস্থাপন করা
যোগ্য কর্মীরা যদি সব কৃতিত্ব নিজে নিতে চান, তবে বসের মনে সন্দেহ জন্মাবে। বরং কৃতিত্ব ভাগ করে নেওয়া উচিত—যেমন, “আমাদের টিম এই প্রজেক্টে দারুণ কাজ করেছে।”
৫. অফিস রাজনীতিতে জড়িয়ে না পড়া
অফিসের ছোটখাটো গসিপ, দলাদলি বা নেতিবাচক রাজনীতির অংশ হলে যোগ্য কর্মীর প্রতি অবিশ্বাস আরও বাড়ে। তাই নিরপেক্ষ ও ন্যায্য অবস্থান ধরে রাখা বুদ্ধিমানের কাজ।
৬. ধৈর্য ও সহনশীলতা চর্চা
সব সময় সঙ্গে সঙ্গে স্বীকৃতি বা সমর্থন পাওয়া সম্ভব নয়। ধৈর্য ধরে নিজের কাজ চালিয়ে যাওয়া উচিত। সময়ের সঙ্গে প্রকৃত দক্ষতা ও সততার প্রমাণ নিজেই জায়গা করে নেয়।
৭. নতুন দক্ষতা অর্জন করা
যত বেশি শিখবেন, তত বেশি আপনার ভ্যালু বাড়বে। বস হয়তো আজ হুমকি মনে করছেন, কিন্তু আপনি যদি এমনভাবে নিজেকে উন্নত করেন যে প্রতিষ্ঠান আপনার দক্ষতা ছাড়া চলতে না পারে, তবে শেষ পর্যন্ত আপনিই অপরিহার্য হয়ে উঠবেন।
৮. ইতিবাচক নেটওয়ার্ক তৈরি
শুধু বস নয়, সহকর্মী, উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ও বাইরের পেশাজীবীদের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো রাখতে হবে। এতে একদিকে সাপোর্ট সিস্টেম তৈরি হয়, অন্যদিকে বসও আপনাকে একা প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ভাবতে পারবেন না।
৯. বিকল্প সুযোগ খুঁজে রাখা
সব পরিবেশেই টিকে থাকা যায় না। যদি বারবার দেখেন বস আপনাকে দমিয়ে রাখতে চাইছেন এবং আপনার দক্ষতা কাজে লাগাতে দিচ্ছেন না, তবে বিকল্প সুযোগ খুঁজে রাখা উত্তম। কখনো কখনো জায়গা বদল করাই যোগ্য কর্মীর জন্য সবচেয়ে বুদ্ধিমানের সিদ্ধান্ত হয়।
উপসংহার
যোগ্য কর্মীরা আসলে প্রতিষ্ঠানের সম্পদ। কিন্তু যখন বসের ভেতরে অনিরাপত্তা, হীনমন্যতা বা নিয়ন্ত্রণ হারানোর ভয় কাজ করে, তখন সেই সম্পদই হুমকিতে পরিণত হয়। সত্যিকার নেতা কখনো যোগ্য কর্মীকে ভয় পান না; বরং তাকে শক্তিশালী করে তোলেন।
অন্যদিকে যোগ্য কর্মীদেরও বুঝতে হবে- সফলতা শুধু দক্ষতার ওপর নির্ভর করে না, বরং কৌশল, বিনয় এবং সম্পর্ক তৈরির ক্ষমতার ওপরও নির্ভর করে। তাই যোগ্য কর্মীদের উচিত- নিজের কাজের মান ধরে রাখা, টিমওয়ার্কে ফোকাস করা, বিনয়ী থাকা এবং প্রয়োজনে বিকল্প সুযোগ খোঁজা।
শুধু তখনই যোগ্য কর্মীরা হুমকি নয়, বরং প্রতিষ্ঠানের অগ্রগতির প্রধান শক্তি হিসেবে নিজেদের প্রমাণ করতে পারবেন।
লেখক: মোঃ জিয়াউল হক, মানব সম্পদ ব্যবস্থাপক, নেক্সাস টেলিভিশন।
