ঢাকা
মঙ্গলবার, ১৮ নভেম্বর ২০২৫, ৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
ই-পেপার

খালেদা জিয়ার নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে কাঁদলেন কায়সার কামাল

আদালতে কায়সার কামাল বলেন, তখন এটা রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন ছিল। শেখ হাসিনার নির্দেশে আদালতের মাধ্যমে খালেদা জিয়ার ওপর এ রকম রাষ্ট্রীয় অত্যাচার ও নিপীড়ন চলত।

আপডেট : ১১ জানুয়ারি ২০২৫, ০১:০৫ পিএম

সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার ওপর নির্যাতনের বর্ণনা দিতে গিয়ে কাঁদলেন জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের মহাসচিব ও বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল।

সম্প্রতি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় সাজা বাড়িয়ে হাইকোর্টের দেওয়া ১০ বছরের কারাদণ্ডের রায়ের বিরুদ্ধে বিএনপির চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার করা আপিল শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। শুনানিতে বেগম জিয়ার ওপর অত্যাচার-নিপীড়নের বর্ণনা দিতে গিয়ে অশ্রুসিক্ত হন ব্যারিস্টার কায়সার কামাল। পরে আদালত পরবর্তী শুনানির জন্য আগামী ১৪ জানুয়ারি দিন ঠিক করেন। 

আদালতে কায়সার কামাল জোর দিয়ে বলেন, তখন এটা রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন ছিল। শেখ হাসিনার নির্দেশে আদালতের মাধ্যমে খালেদা জিয়ার ওপর এ রকম রাষ্ট্রীয় অত্যাচার ও নিপীড়ন চলত।

এ সময় প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ ও আপিল বেঞ্চের বিচারপতিরা রায়ে উল্লিখিত খালেদা জিয়ার সেই বক্তব্য শোনেন। এ সময় আদালত কক্ষে উপস্থিত অন্যান্য আইনজীবীকেও আবেগাপ্লুত হতে দেখা যায়।

আদালতে আবেগাপ্লুত হওয়ার বিষয়ে ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, খালেদা জিয়াকে পারিবারিক, সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে হয়রানি করা হয়েছে, এটা অমানবিক। এটা রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন।

তিনি বলেন, সেদিন (২০১৭ সালের ২ ফেব্রুয়ারি) জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার শুনানি ছিল বিকাল ৪টা পর্যন্ত; কিন্তু খালেদা জিয়া পৌনে ৭টার দিকে আদালত থেকে বের হয়েছিলেন। বাংলাদেশে এটাও এক ধরনের ইতিহাস। একজন মানুষকে ‘ফরগেট অ্যাবাউট পলিটিশিয়ান’ মানুষ হিসেবে যদি মর্যাদা না দেওয়া হয় এ রাষ্ট্র কেন স্বাধীন হলো। তখন খালেদা জিয়া অসুস্থ ছিলেন। এ অবস্থায় মানুষ হিসেবে তার মৌলিক অধিকার, সাংবিধানিক অধিকারকেও কার্টেসি করেছেন আদালত।

তিনি বলেন, আদালতে বিচারকের সঙ্গে বলতে বলতে খালেদা জিয়া যখন কথা হাঁপিয়ে যেতেন, তখনো একটু সময় চাইলে দিতেন না। একটু বসে বিশ্রাম করতে চাইলে দিতেন না আদালত। বসার জন্য সময় চাইলে তৎকালীন সময়ে আদালতের বিচারক কোনো কথা বলতেন না।

তিনি বলেন, শেখ হাসিনার নির্দেশে খালেদা জিয়ার ওপরে এ রকম রাষ্ট্রীয় অত্যাচার ও নিপীড়নটা চলত আদালতের মাধ্যমে। আমরা চাই না এ রকম আচরণগুলো আবার হোক। 

তিনি বলেন, যে যত বড় অপরাধী হোক না কেন তাকে ডিফেন্স করার সুযোগ দেওয়া হয়। কিন্তু খালেদা জিয়াকে ৫ বছরের সাজা জোড় করে দিলেন। খালেদা জিয়ার বিষয়ে সংবিধানকে তোয়াক্কা করা হয়নি।

তারপর আবার হাইকোর্টে এসে যে বিচারক ১০ বছরের দণ্ড করে রায় দিয়েছেন, আমাদের শুনানি করতে দেননি। আমরা আদালতে চেয়েছি একদিন সময় দেন। দুদক যে রিভিশন করেছে, প্রিপারেশন নিয়ে পরের দিন শুনানি করবো, আমাদের কোনো সময় দেননি। রেকর্ডে আছে, এক তরফা রায় দিয়ে দিলেন ৫ বছরের সাজা ১০ বছর করে।

এই আইনজীবী বলেন, ৫ বছরের সাজা ১০ বছর করার সময় আদালত থেকে দুদককে ইনভাইট করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, আপনারা কী খালেদা জিয়ার ৫ বছরের সাজায় সন্তুষ্ট? সো, এ যে আদালতের প্রবণতা খালেদা জিয়াকে ভিকটিম করার জন্য, ঘটনা আমরা বহুবার মিডিয়াতে বলেছি। এ জিনিসগুলো রেয়ার কেইস। এটা রাষ্ট্র, সংবিধান ও আইন অ্যালাউ করে না। এটা বাংলাদেশের আর কারো বেলায় ঘটেনি।

তিনি বলেন, যেহেতু খালেদা জিয়া জাতীয় সংসদ নির্বাচনে (৯১ থেকে ২০০৮) ৫টি আসনের কোনোটিতে কখনো ফেল করেননি। যেহেতু তিনি পরাজয়ের গ্লানি বহন করেন না, যেহেতু তিনি সবচেয়ে জনপ্রিয় নেত্রী।

তিনি বলেন, দেশনেত্রী খালেদা জিয়াকে এ পর্যায়ে নিয়ে গেছে, এরপর অবৈধভাবে সাজা দিল, তিনি নিজে হেঁটে গেলেন, কোথায় নির্জন কারাগারে। এ কথাগুলো আদালতে বলতে চেয়েছিলাম কিন্তু আবেগাপ্লুত হয়ে বলতে পারেনি। যেখানে তিনি ছাড়া আর কোনো বন্দি ছিলেন না। নির্জন কারাগার। একমাত্র বন্দি ছিলেন বেগম জিয়া। কোথায় ব্রিটিশ আমলের একটি কারাগার। যেটি ব্রিটিশ আমলে যখন ইংরেজ শাসন ছিল তখন তারা এ কাজ করত। সলিটারি কনফাইনমেন্ট, দিয়ে দ্বীপান্তর করা।

স্বৈরচারী শেখ হাসিনা সলিটারি কনফাইনমেন্টের মাধ্যমে খালেদা জিয়াকে মারতে চেয়েছিল। কিন্তু আল্লাহর অশেষ মেহেরবানি মানুষের দোয়ায় খালেদা জিয়া প্রাণে বেঁচে গেছেন। কিন্তু বাংলাদেশে তার চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। পরিবার ও দল থেকে বিভিন্নভাবে মন্ত্রণালয়ে, আদালতে বিদেশে চিকিৎসার জন্য বলা হয়েছে, কিন্তু বলা হতো আইনে নেই।

এ মামলায় সাজা বাড়িয়ে হাইকোর্টের দেওয়া ১০ বছরের কারাদণ্ডের বিরুদ্ধে খালেদা জিয়ার আপিলের শুনানি প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে আপিল বিভাগ তৃতীয় দিনের মতো অনুষ্ঠিত হয়। আদালত পরবর্তী শুনানির জন্য আগামী ১৪ জানুয়ারি দিন ধার্য করেন।

এ মামলায় ৩৪২ ধারায় খালেদা জিয়ার দেওয়া বক্তব্যের যে অংশবিশেষ ব্যারিস্টার কায়সার কামাল সর্বোচ্চ আদালতে উপস্থাপন করেন। সেখানে উল্লেখ করা হয়, প্রায় তিন যুগ আগে মানুষের ডাকে ও ভালবাসায় সাড়া দিয়ে আমি (খালেদা জিয়া) রাজনীতির অঙ্গনে পা রাখি। সেদিন থেকেই বিসর্জন দিয়েছি নিজের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য। আমি কেন রাজনীতিতে এসেছি? নিশ্চিত ও নিরাপদ জীবন ছেড়ে কেন আমি ঝুঁকিপূর্ণ অনিশ্চিত পথে পা দিয়েছি? তখন আমার সামনে মসনদ কিংবা ক্ষমতার কোনো হাতছানি ছিল না। রাষ্ট্রক্ষমতা অবৈধ দখলকারীরা চায়নি আমি রাজনীতিতে থাকি। আমি রাজনীতি না করলে তারা আমাকে অনেক বেশি সম্মান ও সুযোগ সুবিধা দেওয়ার কথা বলেছিল। রাজনীতি করলে অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হবে বলে আমাকে ভয়ভীতি দেখানো হয়েছিল। সবকিছু উপেক্ষা করে আমি রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা রাখি। কারণ, দেশে তখন গণতন্ত্র ছিল না। জনগণের নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করে নেওয়া হয়েছিল। জনগণের অধিকার ছিল না। গণতন্ত্র ও মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে শুরু থেকেই আমাকে রাজপথে নামতে হয়েছিল।

বক্তব্যে খালেদা জিয়া আরও বলেন, আমি রাজনীতিতে এসেছি শহিদ জিয়াউর রহমানের আদর্শের পতাকা হাতে নিয়ে। আমার সংগ্রাম শুরু হয়েছিল তার অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করার লক্ষ্য নিয়ে। আমি সব সময় চেয়েছি বাংলাদেশ যেন গণতান্ত্রিক পথে পরিচালিত হয়। মানুষের যেন অধিকার থাকে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থাকে। বিচার বিভাগ ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা থাকে। আমি চেয়েছি আমাদের অর্থনীতি যেন শক্তিশালী হয়। বিশ্বসভায় বাংলাদেশ মর্যাদার আসন পায়। সেই লক্ষ্যগুলো অর্জনের জন্যই আমার রাজনীতি। আমি রাজনীতিতে যোগ দিয়ে দেশ ও জনগণের ভাগ্যের সঙ্গে নিজের ভাগ্যকে একাকার করে ফেলেছি। আমার নিজের কোনো পৃথক আশা আকাঙ্ক্ষা নেই। জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষাই আমার আশা আকাঙ্ক্ষায় পরিণত হয়েছে। আমার জীবন পুরোপুরি জড়িয়ে গেছে এ দেশের মানুষের স্বপ্ন ও প্রত্যয়ের সঙ্গে। তাদের সুখ-দুঃখ ও উত্থান-পতনের সঙ্গে। দেশের মানুষের জীবনের চড়াই-উতরাই ও সমস্যা সংকটের সঙ্গে। তাদের বিজয় এবং সমস্যা ও সমৃদ্ধির সঙ্গে। প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ এবং এদেশের মানুষ যখনই দুর্যোগ ও দুর্বিপাকের মুখে পড়েছে তখন আমিও দুর্যোগের মুখে পড়েছি।

দেশ-জাতি যখন সমস্যায় আক্রান্ত হয়েছে, অধিকার হারিয়েছে, বিপন্ন হয়েছে তখন আমিও নানাভাবে আক্রান্ত হয়েছি। আমার পরিবারও পড়েছে নানামুখী সমস্যা সংকটে। বারবারই প্রকাশ হয়েছে যে বাংলাদেশ ও এ দেশের জনগণের ভাগ্যের সঙ্গে আমার নিজের ও আমার পরিবারের ভাগ্য একসূত্রে গাঁথা হয়ে গেছে।

SN/KK
আরও পড়ুন