ঢাকা
সোমবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৫, ২ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
ই-পেপার

একজন পুরুষ যেভাবে ভালো স্বামী হতে পারেন

আপডেট : ১০ নভেম্বর ২০২৫, ০৩:৫৩ এএম

দাম্পত্য জীবন মহান আল্লাহর এক অপূর্ব নিদর্শনের নাম। এটি কেবল দুটি মানুষের মিলন নয়, বরং পারস্পরিক স্নেহ, ভালোবাসা, দয়া, অনুগ্রহ ও প্রশান্তির এক পবিত্র বন্ধন। আল-কোরআনে আল্লাহ তাআলা এই সম্পর্ককে তাঁর মহা কুদরতের অংশ হিসেবে ঘোষণা করেছেন-

‘তাঁর নিদর্শনের মধ্যে হল এই যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য হতেই তোমাদের সঙ্গিণী সৃষ্টি করেছেন যাতে তোমরা তার কাছে শান্তি লাভ করতে পার আর তিনি তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক ভালবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। এর মাঝে অবশ্যই বহু নিদর্শন আছে সেই সম্প্রদায়ের জন্য যারা চিন্তা করে।’ (সুরা আর-রূম, আয়াত: ২১)
 
একজন পুরুষ কীভাবে উত্তম ও সফল স্বামী হতে পারেন, তা নিচে তুলে ধরা হলো:

 

১) ঈমানের পূর্ণতা ও শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি: উত্তম ব্যবহার

নবী মুহাম্মদ (সা.) ঘোষণা করেছেন যে, একজন মুমিনের ঈমানের পূর্ণতা প্রকাশ পায় তার চারিত্রিক মাধুর্যে। আর এর শ্রেষ্ঠতম উদাহরণ হলো স্ত্রীর সাথে তার আচরণ।

ঈমানের পূর্ণতা
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন— "ইমানের দিক থেকে পূর্ণতম মুমিন সেই ব্যক্তি, যার চরিত্র উত্তম। আর তোমাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ সেই ব্যক্তি, যে তার স্ত্রীর সঙ্গে উত্তম আচরণ করে।" (তিরমিজি)

 শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণা
ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, নবী করিম (সা.) বলেছেন, "তোমাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ সে-ই, যে তার স্ত্রীর সঙ্গে সর্বোত্তম আচরণ করে। আর আমি তোমাদের মধ্যে আমার স্ত্রীদের সঙ্গে সর্বোত্তম আচরণকারী।" (ইবনে মাজাহ)

২) সহনশীলতা ও স্ত্রীর প্রতি মমত্ববোধ

দাম্পত্য জীবনে মতের অমিল বা ভুল-ত্রুটি স্বাভাবিক। একজন আদর্শ স্বামী হিসেবে উচিত, স্ত্রীর দোষের চেয়ে গুণকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া এবং ধৈর্যশীল হওয়া।

দোষের ওপর গুণকে প্রাধান্য
নবী (সা.) বলেন, "কোনো মুমিন পুরুষ যেন মুমিনা স্ত্রীকে ঘৃণা না করে; তার কোনো একটি দোষ অপছন্দ হলে অন্য কোনো গুণে সে সন্তুষ্ট থাকবে।" (মুসলিম)
 
পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্পদ
রাসুলুল্লাহ (সা.) এই নশ্বর দুনিয়ার সেরা সম্পদ কী, তা উল্লেখ করেছেন— "এই দুনিয়া সাময়িক আনন্দের স্থান, আর দুনিয়ার সেরা সম্পদ হলো সৎ ও ধর্মপরায়ণ স্ত্রী।" (মুসলিম)

৩) ভালোবাসার প্রকাশ: কেবল মুখে নয়, আচরণে

ভালোবাসা কেবল মুখে বলে শেষ করার বিষয় নয়, বরং দৈনন্দিন জীবনে আচরণের মাধ্যমে তা ফুটিয়ে তোলা উচিত। নবীজির জীবনে এর বহু সুন্দর দৃষ্টান্ত রয়েছে:
 
স্নেহের বহিঃপ্রকাশ
আয়েশা (রা.) বলেন, নবী (সা.) তাঁকে একদিন পান করার জন্য একটি পাত্র দিলেন। তিনি (আয়েশা) হায়েজ অবস্থায় থাকলেও তিনি আমার মুখের স্থানে মুখ রেখে পানি পান করলেন। (নাসায়ি)

স্ত্রীকে সম্মান
আনাস (রা.)-এর বর্ণনায় জানা যায়, নবীজির এক প্রতিবেশী তাঁকে খেতে আমন্ত্রণ জানালে নবী (সা.) জানতে চান, ‘আয়েশাও কি আসতে পারবে?’ প্রতিবেশী প্রথমে রাজি না হলে নবী (সা.) আমন্ত্রণ গ্রহণ করেননি। তিনবার এমন হওয়ার পর প্রতিবেশী যখন আয়েশা (রা.)-সহ আমন্ত্রণ জানালেন, তখন নবী (সা.) আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন। (মুসলিম)
 
সংসারের কাজে সহায়তা
আয়েশা (রা.) বলেন, ‘নবী (সা.) ঘরে পরিবারের কাজে সাহায্য করতেন, আর নামাজের সময় হলে নামাজে দাঁড়াতেন।’ (বুখারি)

৪. আনন্দময় পরিবেশ ও চিত্তবিনোদন

পরিবারকে ভালোবাসা ও আনন্দময় করে তুলতে স্বামী হিসেবে হাসি-খুশি থাকা ও স্ত্রীর সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখা একান্ত প্রয়োজন।
 
দৌঁড় প্রতিযোগিতা
আয়েশা (রা.) বলেন, একবার আমি নবীজির সঙ্গে সফরে ছিলাম। নবী (সা.) সাহাবিদের সামনে এগিয়ে যেতে বললেন, তারপর বললেন, ‘চলো, দৌঁড়ে দেখি কে আগে যায়।’ আমি জিতে গেলাম। কয়েক বছর পর আবার তিনি দৌঁড়ের প্রস্তাব দিলেন, এবার তিনি জিতলেন এবং হেসে বললেন, ‘এখন সমান হয়ে গেলাম।’ (আহমাদ, আবু দাউদ)

খেলায় উৎসাহ
আরেকবার ঈদের দিন ইথিওপীয়রা মসজিদে ঢাল ও বর্শা নিয়ে খেলছিল। নবী (সা.) আয়েশাকে জিজ্ঞেস করলেন, খেলা দেখতে চাও? তিনি রাজি হলে নবী (সা.) তাঁকে নিজের পেছনে দাঁড় করালেন, নিজের গাল তাঁর গালে লাগানো অবস্থায় আয়েশা খেলাটি দেখলেন। নবী (সা.) বারবার উৎসাহ দিচ্ছিলেন, ‘চল, চালিয়ে যাও, হে বানু আরফিদা!’ (বুখারি)

৫) স্ত্রীর প্রতি অবিচল ভালোবাসা ও তার পরিবারের প্রতি যত্ন

স্ত্রীর ভালোবাসা কেবল জীবদ্দশায় সীমাবদ্ধ নয়, বরং তার অনুপস্থিতিতেও তাকে স্মরণ করা এবং তার পরিবারের প্রতি যত্নশীল হওয়া আদর্শ স্বামীর গুণ।

 খাদিজা (রা.)-কে স্মরণ
নবীজি (সা.) তাঁর প্রথম সহধর্মিণী হজরত খাদিজা (রা.)-কে মৃত্যুর পরও স্মরণ করতেন। আনাস (রা.) বলেন, নবীজির কাছে যখনই কোনো উপহার বা খাবার আসত, তিনি বলতেন, ‘এটা ওমুকের কাছে দাও, সে খাদিজার বন্ধু ছিল।’ (বুখারি)
 
স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা
আয়েশা (রা.) একবার খাদিজা (রা.) সম্পর্কে কিছু বললে নবী (সা.) কষ্ট পান এবং বলেন, ‘আল্লাহ আমার অন্তরে তার ভালোবাসা দান করেছেন।’ (মুসলিম)
 
স্ত্রীর পরিবারের প্রতি সম্মান
এক সাহাবি নবী (সা.)-কে জিজ্ঞেস করলেন, মানুষের মধ্যে আপনার কাছে সবচেয়ে প্রিয় কে? নবী (সা.) বললেন, ‘আয়েশা।’ সাহাবি আবার জিজ্ঞেস করলেন, পুরুষদের মধ্যে? নবী (সা.) বললেন, ‘তার বাবা।’ (ইবনে মাজাহ) এই উত্তরটি স্ত্রীকে ও তার পরিবারকে ভালোবাসার এক অনন্য দৃষ্টান্ত।

এই হাদিস এবং নবী জীবনের চিত্রগুলো শিক্ষা দেয় যে, একজন ভালো স্বামী হতে হলে স্ত্রীকে সম্মান করতে হবে, তার পাশে থাকতে হবে, তার ভুলে ধৈর্য ধারণ করতে হবে এবং তাকে সুখে-দুঃখে সঙ্গ দিতে হবে। দাম্পত্য জীবন সফল করতে প্রয়োজন মমতা, ধৈর্য, বোঝাপড়া ও পারস্পরিক সম্মান—যা নবীজির জীবনে প্রতিটি আচরণে ফুটে উঠেছে।

HN
আরও পড়ুন