মহাবিশ্ব কেন বিদ্যমান? আমরা কেন আছি? এই প্রশ্নগুলো যুগের পর যুগ ধরে বিজ্ঞান, দর্শন ও ধর্মের কেন্দ্রে রয়েছে। কিন্তু এবার সেই প্রশ্নের বৈজ্ঞানিক উত্তরের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছাতে চলেছে এক বৈপ্লবিক গবেষণা— যুক্তরাষ্ট্রের Deep Underground Neutrino Experiment (DUNE) প্রকল্প।
বিশ্বখ্যাত এই গবেষণাটি দক্ষিণ ডাকোটার ভূগর্ভে অবস্থিত বিশাল গবেষণা ল্যাবরেটরিতে পরিচালিত হচ্ছে। এই গবেষণার উদ্দেশ্য একটাই— কেন মহাবিশ্বে বস্তু (Matter) রয়েছে, অথচ তার বিপরীত অ্যান্টি-ম্যাটার নিখোঁজ?
প্রেক্ষাপট: মহাবিশ্বের সৃষ্টি ও কণা-সমতা
তত্ত্ব অনুযায়ী, বিগ ব্যাং-এর সময় সমান পরিমাণে তৈরি হয়েছিল ম্যাটার ও অ্যান্টি-ম্যাটার।
তবে বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, আমরা সবাই ম্যাটার দিয়ে গঠিত। তাহলে কোথায় গেল অ্যান্টি-ম্যাটার?
উত্তর খুঁজতে বিজ্ঞানীরা মনোযোগ দিয়েছেন এক রহস্যময় উপাদান— নিউট্রিনো এবং তার বিপরীত, অ্যান্টি-নিউট্রিনো।
‘ডিউন’ প্রকল্প: প্রযুক্তির এক অনন্য উচ্চতা
ডিউন প্রকল্পটি চালানো হচ্ছে ১,৫০০ মিটার গভীরে অবস্থিত তিনটি বিশাল গুহায়। এই গুহাগুলো এমনভাবে নির্মিত যাতে বাইরের বিকিরণ ও আওয়াজ থেকে গবেষণা মুক্ত থাকে।
এই প্রকল্পে অংশ নিচ্ছে ৩০টি দেশের প্রায় ১,৪০০ বিজ্ঞানী।
ডিউনের বিজ্ঞান পরিচালক ড. জারেট হেইজ বলেন, এই ডিটেক্টর আমাদের মহাবিশ্বের মূল চরিত্রকে বুঝতে সহায়তা করবে। এটি শুধুমাত্র পদার্থবিজ্ঞানের নয়, মানব সভ্যতার জন্যও এক ঐতিহাসিক অর্জন হবে।
গবেষণার প্রক্রিয়া: নিউট্রিনোর গতিপথে নজর
- গবেষণার শুরু হবে ইলিনয় রাজ্য থেকে— সেখানে তৈরি হবে উচ্চশক্তির নিউট্রিনো ও অ্যান্টি-নিউট্রিনোর স্রোত।
- এই কণা গুলো প্রায় ৮০০ মাইল পাড়ি দিয়ে পৌঁছাবে দক্ষিণ ডাকোটার ডিটেক্টরে।
- এই যাত্রার পথে কণাগুলোর আচরণ সামান্য পরিবর্তিত হয়।
- বিজ্ঞানীরা খতিয়ে দেখবেন, এই পরিবর্তন নিউট্রিনো এবং অ্যান্টি-নিউট্রিনোর জন্য কি একরকম, না কি রয়েছে কোনো পার্থক্য।
এই পার্থক্যই হতে পারে সেই সূত্র, যা জানিয়ে দেবে কেন ম্যাটার জিতে গেল অ্যান্টি-ম্যাটারকে— অর্থাৎ কেন আমরা আছি।
মানব সভ্যতায় সম্ভাব্য প্রভাব
ডিউনের গবেষণার ফলাফল শুধু পদার্থবিদ্যার নয়, বরং অস্তিত্ববাদ, দর্শন ও কসমোলজির চর্চায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে পারে।
ড. কেট শ’ও, সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যুক্ত রয়েছেন প্রকল্পে। তিনি বলেন— এই গবেষণা আমাদের নিজেদেরকে নতুনভাবে চিনতে শেখাবে। প্রযুক্তি, সফটওয়্যার ও ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সমন্বয়ে আমরা এখন সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার অবস্থানে পৌঁছেছি, যা এক সময় কেবল কল্পনা ছিল।
বিশ্লেষণ: কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ
- নিউট্রিনো পৃথিবীর অন্যতম ক্ষুদ্র এবং রহস্যময় কণা— এরা প্রায় কিছুই প্রতিক্রিয়া দেখায় না, তাই বোঝা কঠিন।
- এদের আচরণ বোঝা গেলে জানা যাবে— মহাবিশ্বের ভিত্তি কেমনভাবে গড়ে উঠেছে।
- এটি কেবল বিজ্ঞানীদের তত্ত্বগত কৌতূহল নয়, বরং ভবিষ্যতের এনার্জি, প্রযুক্তি ও কসমিক স্টাডির রূপরেখাও পাল্টে দিতে পারে।
ডিউন প্রকল্প শুধু আরেকটি বৈজ্ঞানিক গবেষণা নয়, এটি এক বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লবের সূচনা। মানব সভ্যতা তার নিজ অস্তিত্বের ব্যাখ্যা খুঁজছে— প্রযুক্তির আলো হাতে। এই গবেষণার সাফল্য প্রমাণ করতে পারে— বিজ্ঞান শুধু তথ্যের খনি নয়, বরং মহাবিশ্বকে বোঝার একটি দর্শন।
