বিশ্ব ইজতেমা মুসলিম বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম জমায়েত। বরাবরের মতো এবারও রাজধানীর অদূরে বসছে বিশ্ব ইজতেমার ৫৭তম আসর। এরই মধ্যে শীত উপেক্ষা করে প্রতিদিন তুরাগ তীরে ইজতেমা ময়দানে আসতে শুরু করেছেন ধর্মপ্রাণ দেশ-বিদেশের মুসল্লিরা।
একটু ফিরে তাকানো যাক ইজতেমার ইতিহাসের দিকে। উপমহাদেশে মুসলমানদের দাওয়াতি কাজের শুরু মূলত ভারতে। এ বিষয়ে বাংলাপিডিয়ায় বলা হয়েছে- ১৯২৬ সালে হযরত মাওলানা ইলিয়াস (রহ.) ভারতের উত্তর প্রদেশের মেওয়াত এলাকায় তাবলিগী আন্দোলনের গোড়াপত্তন করেন। একই সঙ্গে এলাকাভিত্তিক ইজতেমার আয়োজন করেন। কালক্রমে তাবলিগ সমগ্র উপমহাদেশে বিস্তার লাভ করে এবং উপমহাদেশের বাইরেও এর প্রভাব পড়ে।
তাবলিগ আন্দোলন হিসেবে শুরু হয়েছিল। ইতিহাসবিদদের মতে, একটা বিশেষ পরিস্থিতিতে এটা শুরু হয়েছিল। তখন হিন্দুদের মধ্যে একটা সংস্কার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। হিন্দু ধর্ম থেকে যারা অন্য ধর্মে চলে যাচ্ছিল তাদেরকে আবারও হিন্দু ধর্মে ফিরিয়ে নেওয়ার একটা চেষ্টা ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশে শুরু হয়। তখন মুসলমানদের সংখ্যা কমে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। তখন দেওবন্দ কেন্দ্রিক মুসলমানেরা চিন্তা করলেন মুসলমানদের ইসলাম সম্পর্কে আরও সচেতন করে তুলতে হবে। সেই লক্ষে শুরু হয় তাবলিগ-জামাত।
পরে মাওলানা আবদুল আজিজের মাধ্যমে ১৯৪৪ সালে বাংলাদেশে শুরু হয় তাবলিগের কাজ। পরে এ কাজ ধীরে ধীরে আরও বিস্তার লাভ করলে এলাকাভিত্তিক সম্মেলনের পদক্ষেপ নেন মাওলানা ইলিয়াস (রহ.)। বিশেষ করে ১৯৪৫ সালে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ভিন্ন ভিন্নভাবে ইজতেমা অনুষ্ঠানের। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের কাকরাইল, ভারতের ভুপাল এবং পাকিস্তানের রাইবেন্ডে ইজতেমা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
ধর্মীয় ও সামাজিকসহ অন্যান্য পারিপার্শ্বিক কারণে প্রথম থেকেই বাংলাদেশের ইজতেমার আয়তন অন্য দুই ইজতেমার চেয়ে বেশি ছিল। অধিকসংখ্যক লোকের অংশগ্রহণ, স্বল্প ব্যয়, ভিসার সহজলভ্যতা, আন্তরিকতা, সামাজিক ও ধর্মীয় সহিষ্ণুতাসহ সার্বিক অনুকূল পরিবেশের কারণে বাংলাদেশের ইজতেমা সারা বিশ্বের তাবলিগ জামাতের অনুসারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ফলে ক্রমেই বাংলাদেশের ইজতেমাটি বিশ্ব ইজতেমায় পরিণত হয়।
কেউ কেউ বলেন, বাংলাদেশকে বিশ্ব ইজতেমার স্থান হিসেবে বেছে নেয়া হয়েছিল লটারির মাধ্যমে। তবে তাবলিগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেন, বিষয়টি তাদের জানা নেই।
বাংলাদেশে প্রথম ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয় ১৯৪৬ সালে ঢাকার কাকরাইল মসজিদে। এরপর বিভিন্ন জায়গায় অনুষ্ঠিত হয়েছে ইজতেমা। ১৯৪৮ সালে সেটা চলে যায় চট্টগ্রামের হাজি ক্যাম্পে। ১৯৫৮ সালে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে অনুষ্ঠিত হয় ইজতেমা। তবে দিন দিন ইজতেমায় অংশগ্রহণ করা লোকসংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় ১৯৬৬ সালে টঙ্গীর মনসুর জুট মিলের কাছের একটি মাঠে ইজতেমা অনুষ্ঠিত হতে থাকে।
১৯৬৭ সালে টঙ্গীর তুরাগ নদীর পাড়ে এই ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়। তবে জায়গা নিয়ে এই দৌড়াদৌড়ির অবসান হয় স্বাধীনতার পর। বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ইজতেমা জমায়েতের জন্য টঙ্গীতে তুরাগ পাড়ে ১৬০ একর জমি বরাদ্দ দেন। সেই থেকে টঙ্গীর তুরাগ পাড়ই হয়ে ওঠে বিশ্ব ইজতেমার স্থায়ী ঠিকানা।
সময়ের সঙ্গে বিশ্ব ইজতেমায়ও ঢুকেছে কোন্দল। বিরোধের কারণে এখন দুই ভাগে ইজতেমা হয়। একভাগে থাকেন মাওলানা জুবায়েরপন্থীরা। অন্যভাগে মাওলানা সাদ কান্ধলভীপন্থীরা। আগামী শুক্রবার ৫৭তম বিশ্ব ইজতেমা শুরু হবে। রোববার আখেরি মুনাজাতের মাধ্যমে শেষ হবে জুবায়েরপন্থীদের পর্ব। দিন দুয়েক পর অনুষ্ঠিত হবে সাদপন্ধীদের ইজতেমা।
