বাংলাদেশ থেকে বিদেশে বাইসাইকেল রপ্তানি বেড়েছে। এক যুগ আগেও এ খাত ছিল শতভাগ আমদানিনির্ভর। এখন স্থানীয় বাজারেই উৎপাদিত হচ্ছে মোট চাহিদার ৪০ শতাংশ। রপ্তানি হচ্ছে ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে। সেই সঙ্গে এই শিল্পের জড়িতদের ব্যস্ততাও বেড়েছে।

এই ব্যবসায় যুক্ত হয়েছেন বাগেরহাটের মোস্তাফিজ আহমেদ। তিনি কাঠ দিয়ে বাইসাইকেল বানিয়ে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। ইতোমধ্যে ৪০ হাজার পিস কাঠের বাইসাইকেল তৈরির অর্ডার পেয়েছেন। ২০ হাজার বাইসাইকেল বিদেশে রপ্তানি করেছেন। আরও ২০ হাজার পিস কারখানায় তৈরি করা হচ্ছে।

মোস্তাফিজ জানান, প্রথম দিকে নারকেলের ছোবড়ার বিভিন্ন পণ্য তৈরি করে দেশে বিক্রির পাশাপাশি বিদেশেও রপ্তানি করতাম। সম্প্রতি নারকেলের ফলন কমে যাওয়ায় কাঁচামালের সমস্যা দেখা দেয়। অনেক কর্মচারী, বড় প্রতিষ্ঠান এসব টিকিয়ে রাখতে নতুন পণ্য ও কাস্টোমার খুঁজতে লাগলাম। একটি প্রতিষ্ঠান পেলাম যারা পরিবেশবান্ধব পণ্য বাজারজাত করে।

তিনি জানান, প্রথমদিকে তারা আমাকে কাঠের তৈরি ৪০ হাজার পিস বেবি ব্যালান্স বাইসাইকেল তৈরি করার চাহিদা দিলো। স্যাম্পল অনুযায়ী কাঠ দিয়ে সাইকেল তৈরি করে দিলাম, তারা পছন্দ করল। এরপর ৪০ হাজার পিস তৈরি করার অর্ডার দিলেন।
মোস্তাফিজ আহমেদ বলেন, বিসিক শিল্প নগরীতে স্থাপিত এই ফ্যাক্টরিতে এখন নিয়মিত ও অনিয়মিত মিলে ১২০ শ্রমিক কাজ করেন। গত ছয় মাস ধরে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলছে কাজ। কেউ কাঠ সাইজ করছে, কেউ তৈরি করছেন চাকা, কেউ তৈরি করছেন হ্যান্ডেল, আবার কেউ তৈরি করছেন সাইকেলের ফ্রেম। সবশেষে রং ও পালিশ করা হচ্ছে। প্রতিদিন এই কারখানায় প্রায় ৩০টি সাইকেল তৈরি করা হচ্ছে। বিদেশে রপ্তানি করা পণ্য নির্মাণের সাথে সম্পৃক্ত থাকতে পেরে খুশি শ্রমিকরা।

কারখানার শ্রমিক শিল্পী রানি সরকার বলেন, এক বছর ধরে এই প্রতিষ্ঠানে যুক্ত হয়ে বাইসাইকেল ফিটিংসের কাজ করছি। মাসে প্রায় ১০ হাজার টাকা আয় হয়। এই আয়ে ছেলে-মেয়েদের পড়ালেখার পাশাপাশি সংসারের চাহিদা পূরণ হচ্ছে।
কারিগর শরিফুল তরফদার বলেন, সাইকেলটি তৈরি করতে ১১টি আলাদা অংশের প্রয়োজন হয়। কারখানার বিভিন্ন স্থানে এসব অংশ তৈরি করে ফিটিংস করা হয়। তারপরে রং করে প্রস্তুত করা হয়। একটা সাইকেল বানাতে গড়ে ৭-৮ ঘণ্টা সময় লাগে।
কারখানার ব্যবস্থাপক আয়াস মাহমুদ রাসেল বলেন, চারটি প্রকল্পে শ্রমিকরা কাজ করছে। আমরা শুধু দক্ষ শ্রমিকই কাজে নেই বিষয়টি এমন নয়। কাজ শেখার প্রতি আগ্রহ থাকলে অদক্ষ শ্রমিকদের হাতে-কলমে কাজ শিখিয়ে প্রশিক্ষিত করা হয়। এছাড়া আমাদের আরও কর্মসংস্থান সৃষ্টির পরিকল্পনা রয়েছে।
উদ্যোক্তা মোস্তাফিজ আহমেদের ছোট ভাই মোজাহিদ আহমেদ বলেন, বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ওয়েবসাইটে আমরা আমাদের নানা পণ্যের বিজ্ঞাপন দেই। সেখান থেকেই মূলত ক্রেতারা আমাদের সাথে যোগাযোগ করেন।

মোজাহিদ বলেন, প্রতিটি বেবি ব্যালান্স সাইকেল ১৮ ইউরো, কাঠের বিশেষ চেয়ার ১৭ থেকে ১৮ ইউরো, সান বেড ৫০ ইউরো এবং হোটেল বেড ৫০ থেকে ৬০ ইউরোতে বিক্রি করা হয়।
মোজাহিদ আরও বলেন, রপ্তানির জন্য সরকার আমাদেরকে ১০ শতাংশ প্রণোদনা দিতো। সম্প্রতি তা কমিয়ে দিয়েছে। প্রণোদনা কমিয়ে দিলে বাজারে টিকে থাকা মুশকিল হবে। এছাড়া নারকেলের ছোবড়া বা কাঠের কোনো পণ্য রপ্তানির করতে হলে ফাইটোস্যানিটারি সার্টিফিকেট লাগে। সার্টিফিকেট বিদেশে রপ্তানি করা যায় না। এই সার্টিফিকেট জোগার করতে আমাদের বেগ পেতে হয়। সরকারের সহযোগিতা পেলে ইউরোপসহ উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাইসাইকেল রপ্তানি করা সহজ হবে।
জানা গেছে, গ্রিসের ‘কোক-ম্যাট’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের চাহিদা অনুযায়ী কাঠ দিয়ে সাইকেল তৈরির কারখানা স্থাপন করেন মোস্তাফিজ আহমেদ ও তার ভাই মোজাহিদ আহমেদ।
গ্রিসের কোকো মাট কোম্পানির প্রজেক্ট ইনচার্জ মিস এভা বলেন, বাংলাদেশে তৈরি এই কাঠের সাইকেল বিশ্বের সেরা সাইকেল। এটা একদম স্থানীয় পণ্য দিয়ে তৈরি হয়। এর বেশ চাহিদা রয়েছে গ্রিসসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে।
