ঢাকা
সোমবার, ০১ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
ই-পেপার

বিশেষ প্রতিবেদন

শ্যামপুরে যেতে রাজি না রাসায়নিক ব্যবসায়ীরা, ঝুঁকিতে পুরান ঢাকা

আপডেট : ০১ এপ্রিল ২০২৪, ১১:০৭ এএম

রাজধানীর পুরান ঢাকার জনাকীর্ণ জনপদ যেন একটা ভয়াবহ মাইনফিল্ডে পরিণত হয়েছে। অলিতে-গলিতে বাড়ীভাড়া করে গড়ে উঠেছে রাসায়নিক গুদাম। ফলে ঝুঁকিতে রয়েছেন লাখ-লাখ বাসিন্দা। অতীতের মতো ভয়াবহ দুর্ঘটনায় মুহূর্তেই বিরানভূমিতে পরিণত হতে পারে লাখ-লাখ মানুষের জনপদটি। ঘিঞ্জি পরিবেশে কোনোরকম নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে প্রতিদিন ভোর থেকে রাত অবধি রাসায়নিক পদার্থের কেনাবেচায় সরগরম থাকে পুরো এলাকা। 

২৪ মার্চ, সকাল ১০টা। আরমানিটোলার থ্রি-এম মার্কেট ও এপি রাসায়নিক মার্কেটে গিয়ে দেখা যায় ব্যবসাপাতিতে সরগরম এলাকাটি। পণ্য উঠানামায় ব্যস্ত শত-শত শ্রমিক। ফুটপাতহীন সংকীর্ণ সড়ক, ঘিঞ্জি পরিবেশ, জরাজীর্ণ ভবনে ঠাসা সরু অলিগলি আর জনবহুল এই এলাকার অধিকাংশ রাসায়নিক গুদাম আবাসিক স্থাপনাতেই চলছে। এলাকার বেশিরভাগ ভবনের নিচে গাদাগাদি করে বোঝাই করে রাখা হয়েছে ভয়াবহ দাহ্য রাসায়নিক পদার্থ। 

আরমানিটোলায় সামিয়া এন্টারপ্রাইজের সামনে কথা হয় প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী আশিক ইসলামের সাথে। খবর সংযোগ ডটকমকে তিনি জানান, ১০ বছর ধরে এখানে তার রাসায়নিক গুদামটি। 

সরকারের উদ্যোগে গড়ে ওঠা শ্যামপুরে গুদাম স্থানান্তরের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, এ বিষয়টি তার জানা নেই। এমনকি, ব্যবসায়ী সমিতি থেকেও এনিয়ে কোনো নোটিশ পাননি বলেও জানান তিনি। 

একই এলাকায় হিমেল কেমিক্যালস এর স্বত্বাধিকারী হিমেল আহমেদ খবর সংযোগ ডটকমকে বলেন, এই এলাকায় ১০ বছর ধরে রাসায়নিক দ্রব্যের দোকান ও গুদাম আছে। পাইকারি বাজার হওয়ায় দূর-দূরান্ত থেকে ক্রেতারা আসেন। 

তিনি বলেন, সরকারের নির্ধারিত স্থান শ্যামপুরে গেলে পণ্য আনা-নেওয়ার খরচ ২০০-৩০০ টাকা বেড়ে যায়। দোকান মালিকেরা এজন্য ওইখানে এখনই যেতে আগ্রহী না।

কথা হয় আরেকটি প্রতিষ্ঠানের মালিক জুনায়েদ আহমেদের সাথে। তিনি খবর সংযোগ ডটকমকে বলেন, আমাদের পূর্বপুরুষেরা এখানে ব্যবসা করে আসছেন। সরকার বড় কোনো জায়গায়  গুদাম স্থাপনের ব্যবস্থা করলে আমরা সেখানে চলে যাব। আমরাও চাই ভালো পরিবেশে ব্যবসা করতে ।

ঝুঁকিপূর্ণ জেনেও এলাকায় এমন গুদাম কেন - এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তিন যুগ ধরে এই এলাকায় আমরা ব্যবসা করছি। ক্রেতারাও এখানে এসে রাসায়নিক দ্রব্য কেনেন। ব্যবসার মূল কেন্দ্র হওয়ায় ঝুঁকি জেনেও এখানেই ব্যবসা চালিয়ে যেতে হচ্ছে। অন্য এলাকায় দোকান সরিয়ে নিলে ক্রেতা ছুটে যাবার আশঙ্কা রয়েছে ।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক ব্যবসায়ী খবর সংযোগ ডটকমকে বলেন, এখান থেকে শ্যামপুরে দোকান ভাড়া বেশি। মালামাল নেওয়ার ক্ষেত্রেও খরচ বেশি পড়ে । তাছাড়া সেখানে মাত্র ৫৮ টি দোকান, সব দোকান থেকে গুদাম সরানো যাবে না। এসব কারণে আমরা সেখানে যাচ্ছি না ।

আরমানিটোলার মতো একই চিত্র চকবাজারেও। সেখানকার হাজী বাল্লু রোডে ৪/১ নম্বর ভবনের মালিক ফারহানা আহমেদ রাসায়নিক গুদামের কথা অস্বীকার করে খবর সংযোগ ডটকমকে বলেন, বাসার নিচ তলায় প্লাষ্টিকের গুদাম ভাড়া দিয়েছি। গুদামে কোনো রাসায়নিক পদার্থ নেই। নিচ তলায় কেউ ভাড়া নিতে চায় না তাই গুদাম ভাড়া দিয়েছি।

চকবাজারের রহমতগঞ্জের ৪৯ নং বাড়ির ২য় তলায় একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলের কার্যক্রম চলছে। ৬ তলা আবাসিক ভবনের নিচতলায় রাসায়নিকের গুদাম রয়েছে। ভবনের মালিক খবর সংযোগ ডটকমকে বলেন, আশেপাশে সবগুলো রাসায়নিক পদার্থের দোকান। আর তারাই নিচতলায় গুদাম নিতে বেশি আগ্রহী। 

রহমতগঞ্জের হাজী বাল্লু রোড ,চুড়িহাট্টা ,বড় কাটরা ,ছোট কাটরা, ইমামগগঞ্জ এলাকার কয়েকজন ভবনের মালিকের সঙ্গে কথা বলে একই ধরনের তথ্য মিলেছে। 

আরেক ভবন মালিক বাদল মিয়া উষ্মা প্রকাশ করে বলেন, 'ঘটনা হলে তখন সরকারের তোড়জোড় বেড়ে যায়। কাজের কাজ তো কিছুই হয় না। বছরের পর বছর এই ব্যবসা চলছে। তারা এখানে ব্যবসা করতে পারলে আমরা ভাড়া দিয়ে তো কোনো অন্যায় করি নি'।

একই এলাকায় পাশাপাশি সারি-সারি রাসায়নিক গুদামে কাজ করছেন শত শত শ্রমিক। কেনাকাটায় সরগরম পুরো এলাকা। বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই এসব এলাকায় শত শত রাসায়নিকের গুদাম রয়েছে। আবাসিক স্থাপনার উপরে গড়ে উঠেছে প্রায় ২০ হাজারের বেশি অবৈধ রাসায়নিক দ্রব্যের গুদাম। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) হিসাবে এ এলাকায় রাসায়নিক দ্রব্যের গুদামের সংখ্যা মাত্র ১ হাজার ৯২৪ ।

২০১৮ সাল থেকে পুরান ঢাকায় রাসায়নিকের ব্যবসায় ট্রেড লাইসেন্স দেওয়া বন্ধ রেখেছে ডিএসসিসি। এ এলাকায় কোনো রাসায়নিক কারখানা বা গোডাউনের অনুমোদনও দিচ্ছে না বিস্ফোরক অধিদপ্তর।

শুধু আরমানিটোলাই নয়, এক সময় সমৃদ্ধ পুরান ঢাকার চকবাজার, হাজারীবাগ,লালবাগ, চকবাজার, আরমানিটোলা, বাবুবাজার, ইমামগগঞ্জ মিটফোর্ড ,ইসলামবাগ শহিদনগর এলাকা এখন কার্যত ভাসছে রাসায়নিক গুদামের ওপর। জনবহুল পুরান ঢাকার যেন এখন পরিণত হয়েছে মাইনফিল্ডে। যেকোনো মূহূর্তেই বিস্ফোরণে ছিন্নভিন্ন হয়ে যেতে পারে এক সময়ের সমৃদ্ধ এই এলাকাটি। 

তবে বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী গুদামের বিষয়টি অস্বীকার করেন। তারা দাবি করেন, ছোট ব্যবসায়ী বলে তাদের কোনও গুদাম নেই। দোকানে যতটুকু ধরে ততটুকু মাল রাখেন তারা। অর্ডার পেলে মাল আনেন অথবা বড় দোকান থেকে ব্যবস্থা করেন। তবে আবাসিক স্থাপনায় ঝুঁকিপূর্ণ গুদাম থাকার বিষয়টি স্বীকার করলেও সেগুলো বড় দোকানদারদের বলে দাবি তাদের।

গোডাউন থাকার সত্যতা মেলে শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে। শ্রমিক আজাদ খবর সংযোগ ডটকমকে বলেন, ‘রাতে গাড়ি এলে আমাদের ডাকে। দিনে এখানে মাল লোড হয় না, প্রতি রাতেই রাসায়নিক দ্রব্য আসে। আমরা গাড়ি থেকে রাসায়নিকের ড্রামগুলো নামিয়ে গুদামে রাখি। এখানে সব বাসার নিচেই গুদাম পাবেন। তবে পুরান বাড়ির চেয়ে নতুন বাড়িগুলোতে গুদামের সংখ্যা কম ।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চকবাজারের বাসিন্দা স্থানীয় এক স্কুলশিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এখানে রাসায়নিক পদার্থের গুদাম আর মানুষ একসাথে বসবাস করে। আমি যে বাসায় থাকি সেটার নিচ তলায় গুদাম আছে। সবসময় ভয়ের মধ্যে থাকতে হয়। দুর্ঘটনা ছাড়া প্রশাসনের টনক নড়ে না কখনো ।

অতীতে রাসায়নিক গুদামের ভয়াবহতা এই এলাকার মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে। এখনো চকবাজারের চুড়িহাট্টার দুর্ঘটনা সেখানকার মানুষের হৃদয়ে গভীর ক্ষত একে দিয়েছে। ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারিতে সেখানে অগ্নিকাণ্ডে ৭৮ জন প্রাণ হারান। শুধু চুড়িহাট্টাই নয়, পুরান ঢাকার মানুষ ২০১০ সালের  ৩ জুন নিমতলীতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের কথা এখনও ভোলেনি। ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ঘটনায় সেদিন ১১৯ জন নিহত হন। 

পুরান ঢাকায় রাসায়নিক গুদামের জন্য প্রতিনিয়ত ঘটছে ছোট-বড় অসংখ্য দুর্ঘটনা। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলে কিছুদিন প্রশাসনের তোড়জোড় আর ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দেখা গেলেও ১৪ বছরেও বদলায় নি পরিস্থিতি।

বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা-১৯৯৭ অনুযায়ী, বিপজ্জনক রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করে কোনো শিল্প ইউনিট আবাসিক এলাকায় এবং তার আশপাশে কাজ করতে পারে না। কিন্তু সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর দুর্বল নজরদারির সুযোগে সেখানে এই ব্যবসা চালু রয়েছে।

এ অবস্থায় বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে পুরান ঢাকায় চুড়িহাট্টা ও নিমতলীর মতো আবারো বড় দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে পারে। দাহ্য রাসায়নিক পদার্থে ঠাসা আবাসিক এলাকাগুলোতে মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছেন লাখ লাখ বাসিন্দা। আর এসব গুদামে রাসায়নিক পদার্থে মজুদ করা গভীর রাতে। বিষয়টি দেখভালের দায়িত্বে থাকা সিটি করপোরেশনের  নেই কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা। 

সিটি করপোরেশনের পরিসংখ্যান:

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সূত্র মতে, দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অঞ্চল ৩,৪ ও ৫ নিয়ে পুরান ঢাকা গঠিত। উক্ত অঞ্চলের হাজারীবাগ ,লালবাগ, চকবাজার, আরমানিটোলা, বাবুবাজার, মিটফোর্ড ,ইসলামবাগ শহিদনগর সহ বিভিন্ন এলাকায় মোট ১৯২৪ টি কেমিক্যাল গুদাম রয়েছে। এর মধ্যে অঞ্চল-৩ -এ ১৩০১টি, অঞ্চল-৪ -এ  ৫৮৫টি এবং অঞ্চল-৫ -এ ৩৮টি রাসায়নিকের গুদাম ও প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে অঞ্চল-৩ এর ইসলামবাগে পাঁচশ'র মতো রাসায়নিক গুদাম ও প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব গুদামে রয়েছে গ্লিসারিন, সোডিয়াম অ্যানহাইড্রোজ, সোডিয়াম থায়োসালফেট, হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড, মিথাইল ইথাইল কাইটন, থিনার, আইসোপ্রোপাইল, টলুইনের মতো দাহ্য পদার্থ।

অন্যদিকে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) এক গবেষণায় বলা হয়েছে, পুরান ঢাকায় আনুমানিক ২৫ হাজার কেমিক্যাল গোডাউন বা কেমিক্যাল পণ্যের গুদাম রয়েছে। এসবের মধ্যে ১৫ হাজারই রয়েছে বাসাবাড়িতে। মাত্র আড়াই হাজার গুদামকে ট্রেড লাইসেন্স দিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)।বাকি ২২ হাজারের বেশি গুদাম অবৈধ। ক্ষতিকর ও ঝুঁকিপূর্ণ ২০০ ধরনের রাসায়নিকের ব্যবসা চলে সেসব গুদামে।

সরকারের উদ্যোগে ব্যবসায়ীদের অনীহা:

সম্প্রতি পুরান ঢাকার শ্যামপুরে ৫৮টি অস্থায়ী রাসায়নিক গুদাম উদ্বোধন করা হয়েছে। তবে পুরান ঢাকার ব্যবসায়ীরা সেখানে কোনো দোকান বা গুদাম স্থানান্তর করেন নি । এ নিয়ে শিল্প মন্ত্রণালয়, সিটি কর্পোরেশন এবং কেমিক্যাল ব্যবসায়ীদের ৩ দফা বৈঠক হলেও ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয় নি।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইম্পোর্টার্স অ্যান্ড মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব আবুল কালাম আজাদ খবর সংযোগ ডটকমকে বলেন, আমরা পুরান ঢাকা থেকে গুদাম সরাতে চাই এবং  নিরাপদে ব্যবসা করতে চাই। কিন্তু সেখানে মাত্র ৫৮ টি অস্থায়ী গুদাম। তাছাড়া পুরান ঢাকার চেয়ে শ্যামপুরের গুদামে ভাড়া বেশি । এজন্য ব্যবসায়ীরা কেউ আগ্রহ দেখাচ্ছে না। আমাদের বড় করে জায়গা দিলে আমরা গুদাম সরিয়ে নিতে পারবো। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএসসিসি অঞ্চল-৪ এর আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা মো : আতাহার মিয়া খবর সংযোগ -কে বলেন, সিটি কর্পোরেশনের সাথে শিল্প মন্ত্রণালয়ের একটা টিম সমন্বয় করে ব্যবসায়ীদের সাথে সভা করেছে। তবে এ বিষয়ে শিল্প মন্ত্রণালয় ভালো বলতে পারবে। '

এ বিষয়ে ডিএসসিসি প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা কাইজার মোহাম্মদ ফারাবী খবর সংযোগ কে বলেন, শ্যামপুরে কিছু গুদাম স্থানান্তর হয়েছে। স্থানান্তরের বিষয়ে আমরা সংশ্লিষ্ট সবাইকে চিঠি দেয়া হয়েছে। তাছাড়া নিয়মিত অভিযান চলছে। পুরান ঢাকায় কয়েকটি ভবন সিলগালা করা হয়েছে। নিয়মিত অভিযান অব্যাহত থাকবে ।

AST
আরও পড়ুন