ঢাকা
মঙ্গলবার, ১৮ নভেম্বর ২০২৫, ২ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
ই-পেপার

ফিলিস্তিন সঙ্কট সমাধানের জন্য মুসলিম বিশ্বকে এগিয়ে আসতে হবে

আপডেট : ০৮ এপ্রিল ২০২৪, ১০:৫০ এএম

গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, গত ছয় মাসে ইহুদিবাদী দখলদারদের বর্বর হামলায় ফিলিস্তিনে শহীদের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩২ হাজার ৭৮২ এবং আহত হয়েছেন ৭৫ হাজার ২৯৮ জন। কাতার ভিত্তিক আল জাজিরা নিউজ চ্যানেল আন্তর্জাতিক রেডক্রসকে উদ্ধৃত করে জানিয়েছে, গাজায় চলমান সংঘাত শুরু হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর হাতে নিহত হয়েছেন সংস্থাটির ২৬ সদস্য।

গত ছয় মাসে বর্ণবাদী ইসরায়েলি সেনাদের নজিরবিহীন ধ্বংসযজ্ঞ ও গণহত্যায় গাজা উপত্যকায় যে মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে তাতে পশ্চিমা মানবাধিকার সংগঠনগুলোও হতভম্ব হয়ে পড়েছে। যেসব পশ্চিমা গণমাধ্যম এবং মানবাধিকার সংগঠন ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকারের অজুহাত তুলে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আগ্রাসনের পক্ষে কথা বলতে অভ্যস্ত এবার তাদের পক্ষেও সরাসরি ইসরায়েলের পক্ষে সাফাই গাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। ইসরায়েলি তাণ্ডবের বিরুদ্ধে বিশ্বজুড়ে নিন্দার ঝড় বইছে। পাশ্চাত্যে অনেক উদার ও শান্তিকামী সংগঠন ইতোমধ্যে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সরব হয়েছে। অনেকে গাজায় ইসরায়েলি হামলা ও ধ্বংসযজ্ঞকে শতাব্দীর অন্যতম ‘নিকৃষ্ট বর্বরতা’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। ইউরোপ আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইসরায়েলের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে এবং মজলুম ফিলিস্তিনিদের পক্ষে বিক্ষোভ হচ্ছে। এমন কি ইসরায়েলের ভিতরে নেতানিয়াহুর যুদ্ধকামী নীতির বিরুদ্ধে প্রবল জনমমত গড়ে উঠেছে।

এমন পরিস্থিতিতে, ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর মুখপাত্র দুই সপ্তাহ ধরে গাজার আল শিফা হাসপাতালের ভেতর অভিযান চালানোর পর সেটি ছেড়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়। তবে চলে যাওয়ার আগে গাজার সবচেয়ে বড় এই হাসপাতালটিকে তারা ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে রেখে যায়। ইসরালি বাহিনী হাসপাতালটি ছেড়ে যাওয়ার পর বার্তাসংস্থা এএফপি যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে তাতে বলা হয়েছে, ইসরালি সেনারা হাসপাতাল থেকে সরে যাওয়ার পর সেখানে কয়েকডজন মরদেহ পড়ে থাকতে দেখা গেছে।

এরপর রাফাহ শহরে অভিযান চালানোর কথা ঘোষণা করে ইহুদিবাদী দখলদার সেনারা। তবে রাফাহ শহরে স্থল অভিযানের ঘোষণার পর ইসরায়েল প্রবল আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়ার মুখে পড়ে। এমনকি এ ব্যাপারে ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ মিত্র এবং প্রধান পৃষ্ঠপোষক মার্কিন সরকারও কঠোর হুঁশিয়ারি দেয়। এক পর্যায়ে ইসরায়েলি বাহিনী শহরটিতে আকাশ ও সমুদ্র পথে বোমাবর্ষণ করে। এতে অর্ধ শতাধিক বেসামরিক ফিলিস্তিনি প্রাণ হারায়।

এদিকে গত ২৫ মার্চ গাজায় অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে একটি প্রস্তাব পাস হয়। এই প্রস্তাব পাস হওয়ার পরও কট্টর জায়োনবাদী নেতা নেতানিয়াহুর নেতৃত্বে ইহুদিবাদী সেনাবাহিনী নারী, শিশু ও সাধারণ ফিলিস্তিনি নাগরিক হত্যা বন্ধ করেনি। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ফিলিস্তিনি শহীদের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। আসল বিষয়টি হলো- যে জায়োনিষ্ট নেতা নেতানিয়াহু জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের রেজুলেশনকে পাত্তা দেন না, কারণ তিনি এটা ভালো করেই বুঝেন যে পশ্চিমা দেশের সরকারগুলোর বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বাত্মক সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা তার পেছনে রয়েছে এবং যেকোনো পরিস্থিতিতে পশ্চিমা সরকারগুলো ইসরায়েলের পাশেই থাকবে। তাই বিশ্বের অধিকাংশ দেশের সরকার ও জনগণের ক্ষোভ ও প্রতিবাদকে অগ্রাহ্য করে তিনি অধিকৃত ফিলিস্তিনজুড়ে যুদ্ধাপরাধ ও ধ্বংসলীলা চালিয়ে যাচ্ছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বিশ্বের প্রশ্রয়ে ইসরায়েলের বর্ণবাদী নেতারা এতটাই উন্মাদ ও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে যে তারা গত ১লা এপ্রিল সকল আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘ সনদ লঙ্ঘন করে দামেস্কের ইরানি কনস্যুলেট ভবনে বোমা হামলা চালায়। এই উস্কানিমূলক পদক্ষেপের উদ্দেশ্য হলো যুদ্ধের পরিধি বিস্তৃত করে বিশ্বকে আরেকটি বড় যুদ্ধের দিকে এগিয়ে নেওয়া। তাদের ধারণা গোটা মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের আগুন ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হলে ফিলিস্তিনে জবরদখল পাকাপোক্ত করা এবং ফিলিস্তিনিদের স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্ন ধূলিসাৎ করে দেওয়া যাবে। কিন্তু এটা কি সম্ভব? ফিলিস্তিন ভূখণ্ড দখলদারিত্বের ৭০ বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে একদিকে যেমন জায়োনবাদী ইহুদিরা অবর্ণনীয় অত্যাচার নিপীড়নের মাধ্যমে ফিলিস্তিনি জাতিকে নাস্তানাবুদ করার অব্যাহত চেষ্টা চালিয়েছে, অপরদিকে ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি ও নিপীড়নের স্টিম রোলার চালানো হলেও ফিলিস্তিনিরা তাদের প্রতিরোধ এবং মাতৃভূমি পুনরুদ্ধারের আন্দোলন থেকে বিন্দুমাত্র পিছপা হয়নি। বরং তাদের প্রতিরোধ আন্দোলন অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় আরও বেগবান ও শক্তিশালি হয়েছে। এর পাশাপাশি নির্যাতিত ফিলিস্তিনিদের প্রতি পশ্চিমা দেশগুলোর শাসকদের বিপরীতে এসব দেশের বিবেকবান ও শান্তিকামী মানুষের সমর্থন ও সহমর্মীতা দিন দিনই বৃদ্ধি পাচ্ছে।

তবে মুসলমানদের কাছে ফিলিস্তিন ভূখণ্ড কয়েকটি কারণে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। মুসলমানদের প্রথম কেবলা আল-আকসা মসজিদ রয়েছে ফিলিস্তিনের বায়তুল মোকাদ্দাস (জেরুজালেম) শহরে। এটি এমন এক পূণ্যভূমি যেখানে অনেক নবী-রাসুল জন্মেছেন এবং বসবাস করেছেন। এই মাটির বুকে শুয়ে আছেন হজরত ইবরাহিম (আ.), হজরত ইসহাক (আ.), হজরত ইয়াকুব (আ.), হজরত ইউসুফ (আ.), হজরত মুসা (আ.), হজরত দাউদ (আ.) ও হজরত সোলায়মান (আ.)-সহ অনেক পূণ্যবান পুরুষ। এছাড়া বিশ্ব নবী হযরত মোহাম্মাদ (সাঃ) এই ভূমি থেকেই মেরাজ বা  ঊর্ধ্বলোক গমন করেছেন। 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সাম্রাজ্যবাদি শক্তিগুলো মুসলিম বিশ্বকে বিভক্ত করে ছোট ছোট রাষ্ট্রে পরিণত করে এবং এসব দেশে তাদের অনুগত সরকার প্রতিষ্ঠা করে। এসব আরব শাসক ফিলিস্তিন ভূখণ্ড মুক্ত করার বিষয়টিকে ইসলামী চেতনার পরিবর্তে আরব জাতীয়তাবাদী চেতনার আলোকে দেখবার চেষ্টা করেছে। ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধের পর আরব শাসকরা ফিলিস্তিন ভূখণ্ড মুক্ত করার ক্ষেত্রে ক্রমেই নিষ্ক্রিয় হতে থাকে। এক পর্যায়ে ফিলিস্তিন ইস্যুটি আরব বিশ্বের শাসকদের কাছে শ্রেফ আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত হয়। কিন্তু ১৯৭৯ সালে ইরানের জনপ্রিয় ও প্রভাবশালী ধর্মীয় নেতা ইমাম খোমেনির নেতৃত্বে সেদেশে ইসলামী বিপ্লব বিজয় লাভের পর ফিলিস্তিনের মুক্তি আন্দোলন নতুন মাত্রা পায় এবং এর ধর্মীয় দিকটি পুনরায় সামনে আসে। মুসলমানদের কাছে ফিলিস্তিন ভূখণ্ডের গুরুত্ব এবং ফিলিস্তিনীদের মুক্তি আন্দোলনের মানবিক দিকগুলো সম্পর্কে বিশ্বের মুসলিম-অমুসলিম জনগোষ্ঠির মধ্যে সচেতনা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে ইরানের তৎকালীন শীর্ষনেতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ মুসাভি খোমেনি রমজান মাসের শেষ শুক্রবার ‘আন্তর্জাতিক কুদস দিবস’ হিসেবে পালনের ডাক দেন। এরপর থেকে বিগত তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে প্রতি রমজান মাসের শেষ শুক্রবার ইরান ও কয়েকটি আরব দেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই দিবসটি পালিত হয়ে আসছে । 

ফিলিস্তিনের মুক্তি আন্দোলনের প্রতি ইরানের নৈতিক সমর্থন এবং আন্তর্জাতিক কুদস দিবস পালনের মাধ্যমে ক্রমেই নিষ্ক্রিয় হয়ে আসা ফিলিস্তিন ইস্যু যে পুনরায় উজ্জীবিত হয়ে উঠেছে তা এখন দৃশ্যমান। এ জন্য মুসলিম বিশ্ব ইরানের কাছে কৃতজ্ঞতার পাশে আবদ্ধ। ফিলিস্তিন ইস্যুতে বাংলাদেশের সরকার এবং জনগণের নীতি-অবস্থান অত্যন্ত প্রশংসনীয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গাজায় জায়োনিষ্ট ইহুদিদের হঠকারীতাকে ‘গণহত্যা’ হিসেবে আখ্যায়িত করে তা বন্ধ করতে বিশ্বনেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন, ফিলিস্তিনের জনগণের বেঁচে থাকা ও তাদের নিজস্ব রাষ্ট্র গঠনের অধিকার রয়েছে। সেখানে যা ঘটছে, তা খুবই দুঃখজনক। তাই আমাদের উচিত তাদের সাহায্য করা এবং এই আক্রমণ ও যুদ্ধ বন্ধ করা। 

ফিলিস্তিন ইস্যু সব কিছুর আগে মুসলিম বিশ্বের একটি সঙ্কট। এটি ইরান বা একক কোনো দেশের সংকট নয়। মুসলিম দেশগুলোর মধ্যকার অনৈক্য এবং সমন্বয়হীনতার কারণে ফিলিস্তিন সঙ্কটের সমাধান বিলম্বিত হচ্ছে। তাই এই সঙ্কট সমাধানের জন্য মুসলিম দেশগুলোকে ঐক্যবদ্ধ ও সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে। 

লেখক: ইরানের জাতীয় সম্প্রচার সংস্থার বাংলা বিভাগের সাবেক পরিচালক

AST/FI
আরও পড়ুন