দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব পালনকারী বাংলাদেশ পুলিশের সদস্যরা নিজেরাই নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে। নিজেদের রক্ষা করতে পারছে না যারা তারা একটি দেশ ও জনগণের নিরাপত্তা দেবে কীভাবে? সম্প্রতি এই প্রশ্নটি ব্যাপক আলোচনায় এসেছে।
গত শনিবার (৮ জুন) রাজধানীর বারিধারার কূটনীতিকপাড়ায় ফিলিস্তিন দূতাবাসের সামনে কাউসার আলী নামে কর্তব্যরত এক পুলিশ কনস্টেবলের গুলিতে মনিরুল ইসলাম নামে আরেক কনস্টেবল নিহত হয়েছেন। সহকর্মীকে গুলি করে হত্যার পর কনস্টেবল কাউসার অস্বাভাবিক বা এলোমেলো আচরণ করছিলেন বলেও ডিউটিতে থাকা অন্য সহকর্মীরা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে জানান। একজন মানসিক ভারসাম্যহীন লোকের কাছে কীভাবে অস্ত্র তুলে দেয়া হলো তা নিয়ে প্রশ্ন দেশবাসীর। নিজেদের নামে ইস্যুকৃত আগ্নেয়াস্ত্র এবং গুলি ব্যবহার করে আত্মহত্যা বা সহকর্মীকে গুলি করার বিষয়ে পুলিশে কর্মরতদের মানসিক স্বাস্থ্য এবং নিরাপত্তা নিয়েও দেখা দিয়েছে প্রশ্ন।
এদিকে কনস্টেবল কাওসারের পরিবারের সদস্যরা বলছেন, গত ১৪ বছর ধরে মানসিক সমস্যায় ভুগছিলেন কাওসার। তিনি হাসপাতালে গিয়ে মানসিক রোগের চিকিৎসাও নিয়েছেন। মানসিক সমস্যার কারণে তিনি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কম কথা বলতেন। তার স্ত্রী জানান,‘কাউসারের মানসিক সমস্যা ছিল। সরকারিভাবেই তাকে পাবনা মানসিক হাসপাতালে অন্তত: তিনবার চিকিৎসা করানো হয়েছিল।’
কূটনৈতিক জোনের মতো গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর এলাকায় এমন মানসিক সমস্যাগ্রস্ত পুলিশ সদস্যকে কেন ডিউটি দেয়া হলো সে বিষয়েও প্রশ্ন সংশ্লিষ্টদের। মানসিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পোশাক ও আধুনিক অস্ত্র-সরঞ্জাম দেয়া হলেও মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখার পারিপার্শ্বিক সুযোগ সুবিধা থেকে এখনও বঞ্চিত পুলিশ সদস্যরা।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, পুলিশ বাহিনীতে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কোনো মানসিক চিকিৎসকের পদ নেই। কিন্তু পুলিশ সদস্যদের প্রতিনিয়ত মানসিক চাপ নিয়ে কাজ করতে হয়। কর্মক্ষেত্রে বা পারিবারিক নানা ধরনের চাপ মোকাবেলা করতে গিয়ে মানসিক নানা রোগে আক্রান্ত হন পুলিশে কর্মরতরা। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে তাদের ব্যক্তি জীবনে। এসব সমস্যার সমাধান করতে পারেন একমাত্র মানসিক বিশেষজ্ঞ বা কাউন্সিলররা। কিন্তু সচেতনতার অভাবে অনেকে মানসিক চিকিৎসকের কাছে যেতে অনীহা দেখান। তাদের ধারণা মানসিক ডাক্তারের কাছে গেলে লোকে পাগল ভাববে।
জানা গেছে , ২০২৩ সালের ২৫ মে রাজধানীর বনানীতে পুলিশ চেকপোস্টে আশরাফুজ্জামান রনি নামে এক পুলিশ কনস্টেবল আত্মহত্যা করেন। নিজের নামে লাইসেন্স করা পিস্তল দিয়ে নিজের বুকে গুলি চালান। একই বছরের ৩ আগস্ট পঞ্চগড় জেলা শহরের সোনালী ব্যাংকের ভেতরে নিজের মাথায় গুলি করে আত্মহত্যা করেন ফিরোজ আহমেদ নামে এক পুলিশ কনস্টেবল। ২০২১ সালের ২১ জুলাই মেহেরপুরের মুজিবনগরে ডিউটিরত অবস্থায় নিজের রাইফেল দিয়ে গুলি করে আত্মহত্যা করেন সাইফুল ইসলাম নামের অপর এক পুলিশ কনস্টেবল। নিহত পুলিশ কনস্টেবল মুজিবনগরের রতনপুর পুলিশ ক্যাম্পে কর্মরত ছিলেন। ২০২০ সালের ২৩ জানুয়ারি ভোরে মিরপুর ১৪ নম্বরের পুলিশ লাইন মাঠে নিজের ইস্যুকৃত অস্ত্র দিয়ে নিজের বুকে গুলি চালিয়ে মো. কুদ্দুস সাহা (৩১) নামের পুলিশের এক নায়েক আত্মহত্যা করেন।
অতিরিক্ত ডিউটি, ছুটি ও পদোন্নতি না হওয়া এবং দীর্ঘদিন কম গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় পদায়নের কারণে পুলিশ সদস্যদের মধ্যে হতাশা দেখা দেয়। মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানসিক স্বাস্থ্য গঠনে পেশাগত কাউন্সেলিং ভালো ভূমিকা রাখে। পুলিশের মতো পেশাজীবীদের কাজের ফাঁকে গান শোনা জরুরি। মানসিক প্রশান্তির জন্যই বিভিন্ন পেশার বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে মতের আদান, প্রদান এবং মাঝেমধ্যে ছুটি নিয়ে ঘুরতে যাওয়া দরকার। কাউন্সেলিংয়ের জন্য পুলিশে সাইকোলজি ইউনিট গঠনেও জোর দেন তারা। এমনকি পুলিশের মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা করা জরুরি বলে মন্তব্য করেন অনেকে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. কামালউদ্দিন দৈনিক খবর সংযোগকে বলেন, ‘সহকর্মী একজন আরেকজনকে গুলি করে মেরে ফেলা অসম্ভব কিছু না। কারণ একটা মানুষ এমন পর্যায়ে যাওয়ার আগে অনেক বিষয়ের উপর নির্ভর করে। তার মধ্যে অন্যতম হলো তার মনস্তাত্ত্বিক ও পারিপার্শ্বিক বিষয়। তার আগে আমাদের বুঝতে হবে তিনি কোন অবস্থায় ছিলেন? অভিযুক্ত পুলিশ সদস্য যদি চিকিৎসার মধ্যে থাকেন তাহলে তাঁকে ডিউটিতে রাখা উচিত হয়নি। পুলিশের উচিত প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কাউন্সেলিং বা মনস্তাত্ত্বিক পরামর্শ নিয়ে কাজ করার।
এ সময় তিনি আরও বলেন, পুলিশরা কর্মক্ষেত্রে যে পরিমাণ চাপে থাকে তাতে তাদের মানসিক অবস্থার উপর প্রভাব পড়াটা স্বাভাবিক। সেজন্য এত বড় একটা প্রতিষ্ঠানে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে মানসিক চিকিৎসক থাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
