ঢাকা
সোমবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৫, ২ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
ই-পেপার

রক্তে অর্জিত মহান মে দিবস 

শ্রমজীবী মানুষের অধিকার নিশ্চিত হোক সংস্কারে

আপডেট : ০১ মে ২০২৫, ০৩:৫৩ পিএম

শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্য আত্মদানকারীদের সম্মান জানানোর জন্য পালন করা হয় মে দিবস। আজ বিশ্বজুড়ে উদযাপিত হচ্ছে মহান মে দিবস। শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের ইতিহাসে একটি তাৎপর্যপূর্ণ দিন হিসেবে পালন করা হয় দিবসটিকে। প্রতি বছর ১ মে আন্তর্জাতিক শ্রম দিবস বা আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসেবে পালন করা হয়। দিনটির ইতিহাস সম্পর্কে অনেকেরই জানা নেই।

দেখে নেওয়া যাক, কেন পালন করা হয় দিবসটি। আর এই দিবসের তাৎপর্যই বা কী? ১৮৮৬ সালে শিকাগো শহরের হে মার্কেটে নিহতদের আত্মত্যাগকে মনে রেখে এই দিবসটি পালিত হয়। সেদিন দৈনিক ৮ ঘণ্টার কাজের দাবিতে শ্রমিকরা হে মার্কেটে জমায়েত হয়েছিলেন। তাদের ঘিরে থাকা পুলিশের প্রতি কেউ একজন বোমা নিক্ষেপ করেন। আর এরপর পুলিশ শ্রমিকদের ওপর গুলিবর্ষণ শুরু করে। ফলে অনেক শ্রমিক ও পুলিশ হতাহত হন। ১৮৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবের শতবার্ষিকীতে প্যারিসে অনুষ্ঠিত কংগ্রেসে ১৮৯০ সাল থেকে শিকাগো প্রতিবাদের বার্ষিকী আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন দেশে পালনের প্রস্তাব করেন রেমন্ড লাভিনে। সেখান থেকেই আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসের সূচনা হয়। আর ১৮৯১ সালে প্যারিসেই দ্বিতীয় কংগ্রেসে এই প্রস্তাব আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হয়। স্বীকৃতি পায় মে দিবস। এরপর ১৯০৪ সালে আমস্টারডাম শহরে অনুষ্ঠিত সমাজতন্ত্রীদের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে এই উপলক্ষে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজের দাবি আদায়ের জন্য এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য বিশ্বজুড়ে পহেলা মে তারিখে মিছিল ও শোভাযাত্রা আয়োজন করতে সব গণতান্ত্রিক দল এবং ট্রেড ইউনিয়নের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষে এই দিবসটি পালন করা হচ্ছে ১৯২৩ সাল থেকে।

সেই সম্মেলনে সব শ্রমিক সংগঠন মে মাসের ১ তারিখে ‘বাধ্যতামূলকভাবে কাজ না-করার’ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ১৯১৭ সালে রাশিয়ায় বলশেভিক বিপ্লবের পর থেকে বিপুল সমারোহে দেশটিতে মে দিবস উদযাপিত হতে থাকে। এই উপলক্ষে দেশটিতে সামরিক কুচকাওয়াজের আয়োজন করা হতো। অবশ্য যে দেশে ঘটেছিল হে মার্কেটের ঘটনা, সেই যুক্তরাষ্ট্র ও এর পাশাপাশি কানাডায় মে দিবস পালিত হয় না। সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সোমবার ‘লেবার ডে’ বা  শ্রমিক দিবস পালন করে ওই দুই দেশ। তবে মে দিবসে সরকারি ছুটি থাকে অন্তত ৮০টি দেশে। এর মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে।

শ্রমজীবী মানুষের অধিকারের কথা বলতে গেলে প্রথমেই ন্যায্য মজুরির কথা বলতে হয়। স্বীকার করতে হবে যে, ন্যায্য মজুরি একটি আপেক্ষিক বিষয়। একটি দেশের ভৌগোলিক অবস্থান ও আর্থ-সামাজিক অবস্থার ওপর মজুরির বিষয়টি নির্ভর করে। এ ক্ষেত্রে জীবনযাত্রার ব্যয়ও বিবেচনার বিষয় হয়ে থাকে। জীবনযাত্রার ব্যয় শহরাঞ্চলে যতটা গ্রামাঞ্চলে ততটা নয়। তাই শহরের শিল্প শ্রমিকদের সঙ্গে গ্রামের কৃষি শ্রমিকদের মজুরির পার্থক্য হতে পারে। লিঙ্গভেদে মজুরির পার্থক্য অন্যায় ও অমানবিক। কর্মস্থল, কাজের ধরন ও কর্মঘণ্টা সমান হলে পুরুষ শ্রমিক ও নারী শ্রমিকের মজুরির পার্থক্য হতে পারে না। মজুরির ক্ষেত্রে এ লিঙ্গবৈষম্যের কথা প্রায়ই শোনা যায়। এর অবসান হওয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে শিশু শ্রমিক সমস্যা আর একটি প্রকট বিষয়। বাংলাদেশে শিশুশ্রম আইনত নিষিদ্ধ। তাই সব শিশু শ্রমিককে কারখানা বা কর্মস্থল থেকে অবমুক্ত করে স্কুলমুখী করা উচিত। শিশুরা যেন শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয় সে ব্যাপারে সমাজ ও রাষ্ট্রকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। অনিবার্য কারণে যেসব শিশু শ্রমের সঙ্গে জড়িত তাদের জন্য সীমিত সময় কাজ করা এবং কাজের ধরন শিশু উপযোগী রাখা এবং শিশুর মানসিক বিকাশের জন্য কর্মস্থলে শিক্ষা ও বিনোদনের ব্যবস্থা করা উচিত। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য এখনও অনেক শিশু শ্রমিক বিভিন্ন কলকারখানায় ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করছে। এ ধরনের শ্রমে নিয়োজিত শিশুদের অবমুক্ত করে শিক্ষার আওতায় আনা জরুরি।

বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ শ্রমশক্তির আবাসস্থল, যেখানে লাখ লাখ শ্রমিক বিভিন্ন শিল্প, যেমন- টেক্সটাইল, কৃষিসহ রকমারি উৎপাদনে নিযুক্ত। বাংলাদেশের গার্মেন্ট চীনের পর বিশ্বে দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক শিল্প। অধিকন্তু, এটি দেশের প্রধান রপ্তানি খাত এবং বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের মুখ্য উৎস। তবে অধুনা দেশের শ্রমবাজারে কিছু অগ্রগতি সাধিত হলেও দীর্ঘদিনের কোভিড-১৯ পরিস্থিতি এবং সাম্প্রতিক রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশে শ্রমিকদের ক্ষমতায়ন ক্রমশ  চ্যালেঞ্জিং হয়ে পড়ছে। শ্রমিকদের অবস্থা এখনও মহান মে ডে’র আদর্শ থেকে অনেক দূরে। 

বাংলাদেশের শ্রমিকরা, বিশেষ করে পোশাক শিল্পের সঙ্গে যারা সম্পৃক্ত, দীর্ঘ কর্মঘণ্টা, অপর্যাপ্ত মজুরি, অনিরাপদ কর্মপরিবেশ এবং সীমিত নিরাপত্তা ব্যবস্থার মতো বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। অনেক কর্মী অস্থায়ী ভিত্তিতে নিযুক্ত হওয়ায় স্বাস্থ্যবিমা, অসুস্থতাজনিত ছুটি এবং সবেতনের ছুটির মতো মৌলিক কর্মসংস্থান সুবিধার আওতার বাইরে থাকে। অনেকেই অনিরাপদ পরিস্থিতিতেই কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন বিভিন্ন ঝুঁকি মাথায় নিয়ে। তাছাড়া, শ্রম আইন ও প্রবিধান কার্যকর করার ক্ষেত্রেও স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাব পরিলক্ষিত হয়। তদুপরি, শ্রমিক অধিকারকর্মী এবং ইউনিয়ন নেতাদের অভ্যন্তরীণ কোন্দল, ক্ষুদ্র স্বার্থের রাজনীতি এবং অনেক ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষের হয়রানি বাংলাদেশে শ্রমিক শ্রেণির ক্ষমতায়নে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে চলেছে। 

অন্তবর্তী সরকার শ্রমিক বিভাগেও সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। শ্রমিকদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন বিষয়ে সংস্কারের প্রস্তাবনা দিয়েছে সরকারের কাছে। শ্রমিকের মজুরি নিয়মিত রাখতে নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় ক্যাশ ফ্লো ঠিক রাখার জন্য তিন মাসের মোট বেতন বা মজুরির সমপরিমাণ বাধ্যতামূলক আপদকালীন তহবিল গঠনের সুপারিশ করেছে শ্রম সংস্কার কমিশন। একই সঙ্গে মজুরির নিশ্চয়তায় বিমা স্কিম চালুর সুপারিশ করা হয়েছে। যাতে কোনো প্রতিষ্ঠান মজুরি দিতে ব্যর্থ হলে, কোনো শ্রমিক ছাঁটাই হলে, পুনরায় কম বেতনে নিযুক্ত হলে, এই বিমার আওতায় তা পরিশোধ করা যায়। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহম্মদের নেতৃত্বাধীন ১৮ সদস্যের শ্রম সংস্কার কমিশন এসব সুপারিশ করে। এ সংক্রান্ত ‘শ্রম জগতের রূপান্তর-রূপরেখা: শ্রমিক অধিকার, সুসমন্বিত শিল্প সম্পর্ক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রতিবেদন সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জমা দিয়েছে শ্রম সংস্কার কমিশন।

কমিশনের সুপারিশে বলা হয়েছে, মজুরি নিয়মিত রাখতে নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় ক্যাশ ফ্লো ঠিক রাখার জন্য ব্যবস্থাগুলো, যেমন, ব্যাংক ওভারড্রাফট, বাধ্যতামূলক আপদকালীন তহবিল (তিন মাসের মোট বেতন/মজুরির সমপরিমাণ) এবং অন্যান্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা। একই সঙ্গে দেউলিয়া আইনে সংশোধন করে শ্রমিকদের পাওনা প্রথমে পরিশোধের বিধান নিশ্চিত করতে হবে।

রপ্তানিমুখী শিল্পের সব প্রতিষ্ঠানের জন্য সরকার একটি আপদকালীন তহবিল গঠন করবে, যেখানে নিয়োগকারী কারখানা বা প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের দুই মাসের মজুরি বা বেতনের সমপরিমাণ টাকা ওই তহবিলে জমা রাখবে বলে সুপারিশ করেছে কমিশন। এ তহবিল প্রতিষ্ঠানের নিয়োগকারী, সরকার ও ওই শিল্পের মালিকদের অ্যাসোসিয়েশনের (যদি থাকে) যৌথ ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হবে। তবে কোনো কারণে নিয়োগকারীর অবর্তমানে সরকার জরুরি পরিস্থিতিতে নিজস্বভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারবে।

আপদকালীন মজুরি বিমার বিষয়ে কমিশনের সুপারিশে বলা হয়েছে, জাতীয় মজুরি নিশ্চয়তা বিমা স্কিম চালু করা, যাতে করে কোন প্রতিষ্ঠান মজুরি প্রদানে ব্যর্থ হলে, কোনো শ্রমিক ছাঁটাই হলে, পুনরায় কম বেতনে নিযুক্ত হলে, এই বিমার আওতায় তা পরিশোধ করা যায়।

প্রাতিষ্ঠানিক, অপ্রাতিষ্ঠানিক, কৃষি, গৃহভিত্তিক, অভিবাসী, স্বনিয়োজিত শ্রমিকসহ সব শ্রমিকের জন্য রাষ্ট্র কর্তৃক শ্রম আইনের সুরক্ষা নিশ্চিত করার সুপারিশ করেছে কমিশন। এ লক্ষ্যে, কাজের স্বীকৃতি ও পরিচয়পত্র নিরবচ্ছিন্ন কাজ এবং আয়ের নিশ্চয়তা, মর্যাদাকর-শোভন কর্ম পরিবেশ, চাকরির অপ্রাতিষ্ঠানীকরণ, অস্থায়ী ও এজেন্সিনির্ভর নিয়োগের ক্রমবর্ধমান প্রবণতা রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে কয়েকটি পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে, নিজের ও পরিবারের মর্যাদাকর জীবনযাপন উপযোগী ন্যায্য মজুরি (লিভিং ওয়েজ), উন্নয়নে ন্যায্য অংশীদারত্ব ও হিস্যা প্রাপ্তির অধিকার। প্রত্যেকের জন্য নিরাপদ কাজ ও স্বাস্থ্যসম্মত কর্মপরিবেশ, দুর্ঘটনায় যথাযথ ক্ষতিপূরণ এবং নিজের ও পরিবারের সাধারণ স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার অধিকার। প্রত্যেকেরই অবসর, কর্মঅক্ষমতা, অসুস্থতা, মাতৃত্বকালীন সময় বা যে কোনো প্রতিকূল অবস্থায় সামাজিক নিরাপত্তা প্রাপ্তি এবং কোনো না কোনো সামাজিক নিরাপত্তা স্কিমে অন্তর্ভুক্তি। প্রত্যেকের অধিকার সুরক্ষা ও ন্যায্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করার জন্য সংগঠিত হওয়া, সমষ্টিগতভাবে প্রতিনিধিত্ব করা ও অধিকার লঙ্ঘনে অভিযোগ জানানো, প্রতিকার ও ন্যায়বিচার পাওয়ার নিশ্চয়তা। এসব সুপারিশের বাইরে শ্রম সংস্কার আরও বেশি কিছু সুপারিশ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে, শ্রমজগতের রূপান্তর-রূপরেখা: সরকার কর্তৃক দেশের সংবিধান, আইএলও কনভেনশন ও কর্মক্ষেত্রে মৌলিক নীতিমালা এবং অধিকার সংক্রান্ত ঘোষণা, শোভন কাজের মানদণ্ড এবং মানবাধিকার ও ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক দায়বদ্ধতার আলোকে, যথাযথ ত্রিপক্ষীয় পদ্ধতি অনুসরণ করে বর্তমান শ্রম আইনের প্রয়োজনীয় এবং মৌলিক সংস্কার অথবা একাধিক আইন প্রণয়ন করা এবং কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

মর্যাদাপূর্ণ জাতীয় এবং খাতভিত্তিক মজুরি নিশ্চিতকরণ: শ্রমিক ও তার পরিবারের মর্যাদাকর জীবনযাপন উপযোগী মজুরির অধিকার নিশ্চিতে জাতীয় ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ মানদণ্ড স্থির করা এবং জাতীয় ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা করা হবে। একই সঙ্গে মজুরি নির্ধারণ পদ্ধতি উন্নয়ন, বোর্ডের সক্ষমতা বৃদ্ধি ও কাঠামোগত সংস্কারে স্থায়ী মজুরি কমিশন গঠন করা। জাতীয় ও খাতভিত্তিক মজুরি তিন বছর পর পর মূল্যায়নের মাধ্যমে বৃদ্ধি এবং মর্যাদাপূর্ণ মানদণ্ড নির্ধারণ।

শ্রমিকের নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত কর্মপরিবেশ, স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার আইনি অধিকার নিশ্চিত করবে। খাত ও পেশাভিত্তিক সুনির্দিষ্ট স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা পরিকল্পনা তৈরি করবে। দুর্ঘটনা বা অবহেলাজনিত কারণে হতাহত ও ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের জন্য ক্ষতিপূরণ মানদণ্ড পুনর্মূল্যায়ন করা। একই সঙ্গে মর্যাদাপূর্ণ ক্ষতিপূরণ নিশ্চিতে মানদণ্ড ও পরিমাণ নির্দিষ্ট করা।

শ্রমিকসহ শ্রমশক্তি নিবন্ধন ব্যবস্থা ও তথ্য ভান্ডার গঠন: অপ্রাতিষ্ঠানিকখাত, স্বনিয়োজিতসহ সব শ্রমিকদের পেশাগত ও আইনি সুরক্ষা এবং সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে রাষ্ট্র শ্রমিকের স্বীকৃতি, পরিচয়পত্র প্রদান ও নিবন্ধনের ব্যবস্থা নেওয়া। এ লক্ষ্যে সরকার জরুরিভিত্তিতে ‘জাতীয় শ্রমশক্তি নিবন্ধন ব্যবস্থা ও তথ্য ভান্ডার’ গড়ে তোলা।

সংগঠন, দর কষাকষি অধিকার: সংগঠিত হওয়ার অধিকার নিশ্চিতে রাষ্ট্র কর্তৃক মত প্রকাশের স্বাধীনতার সাংবিধানিক অঙ্গীকারকে কার্যকর করা। ট্রেড ইউনিয়ন শর্ত শিথিল করে সংগঠন করার অধিকার বিস্তৃত করা। দর কষাকষির ক্ষেত্রে অংশগ্রহণমূলক, স্বচ্ছ ও জবাদিহিমূলক কাঠামো নিশ্চিত করা।

জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা ও তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিত করা: শ্রম মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর ও প্রতিষ্ঠানসমূহের সক্ষমতা-সমন্বয় জোরদারে সরকারি (শ্রম অধিদপ্তর, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর, শ্রম কল্যাণ কেন্দ্র, শ্রম শিল্প সম্পর্ক শিক্ষায়তন আইআরআই, জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষসহ সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান) প্রতিষ্ঠানসহ সর্বত্র জবাবদিহিতা, গণতান্ত্রিক চর্চা, স্বচ্ছতা ও তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজনীয় রাষ্ট্রীয় সংস্কার করা।

স্থায়ী শ্রম কমিশন গঠন: জবাবদিহিমূলক শ্রম প্রশাসন ব্যবস্থা নিশ্চিতের লক্ষ্যে একটি সংবিধিবদ্ধ সংস্থা হিসেবে স্থায়ী শ্রম কমিশন গঠন প্রয়োজন। স্থায়ী শ্রম কমিশন গঠনের প্রাথমিক ধাপ হিসেবে অবিলম্বে শ্রম মন্ত্রালয়ের উদ্যোগে একটি ‘জাতীয় সামাজিক সংলাপ ফোরাম’ গঠনে উদ্যোগ গ্রহণ।

কর্মসংস্থান ও দক্ষতাবৃদ্ধিতে উদ্যোগ গ্রহণ: দেশে বিরাজমান বেকারত্ব রোধ, দেশে-বিদেশে কর্মসংস্থানের প্রসারে কার্যকরী উদ্যোগ রাষ্ট্র গ্রহণ করবে। একই সঙ্গে অটোমেশন ও চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এবং উদ্ভূত সুযোগ কাজে লাগাতে দক্ষ জনগোষ্ঠী তৈরির স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পথনকশা তৈরি করার উদ্যোগ নেবে। এক্ষেত্রে শ্রমের যথাযথ ব্যবহার, উৎপাদনশীল যুব শ্রমশক্তি ও উদ্যোক্তা তৈরিতে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া। শ্রমিকের বাধ্যতামূলক তহবিল-আপদকালীন মজুরি বিমা চালুর সুপারিশ করা হয়।

সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা: সব শ্রমিকের সর্বজনীন সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার প্রাপ্তির (কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা, মৃত্যু, কর্মঅক্ষমতা, অসুস্থতা-অবসর, মাতৃত্বকালীন সুবিধা বা যে কোনো প্রতিকূল অবস্থা) সুযোগ নিশ্চিত করতে উদ্যোগ গ্রহণ। শ্রমিকদের সমস্যার ভিন্নতা ভিত্তিতে কোনো না কোনো নিরাপত্তা স্কিমে অন্তর্ভুক্ত করা এবং এক্ষেত্রে আইএলও এর জীবন-চক্রভিত্তিক সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির প্রবর্তন, সামাজিক বিমা ব্যবস্থা প্রবর্তনে পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

সম-অধিকার নিশ্চিত, সহিংসতা ও বৈষম্য দূরীকরণ: নারী-পুরুষ, অন্যান্য লিঙ্গ, জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠী ভেদে মজুরি, ট্রেড ইউনিয়ন, সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়াসহ শ্রমখাতের সর্বত্র বৈষম্য নয় সম-অধিকার নিশ্চিতে কার্যক্রম গ্রহণ করবে রাষ্ট্র। আর, পাহাড়-সমতলে আদিবাসী ও বহুজাতির জনগোষ্ঠীর শ্রমিকদের নিরাপত্তা এবং কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা হবে।

যৌন হয়রানিসহ সব ধরনের হয়রানি ও সহিংসতা প্রতিরোধ: যৌন হয়রানিসহ সব ধরনের হয়রানি ও সহিংসতা থেকে সুরক্ষা পাওয়ার অধিকার নিশ্চিতে রাষ্ট্র বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। ২০০৯ সালে হাইকোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী সব কল কারখানা ও প্রতিষ্ঠানে যৌন নিপীড়ন এবং সহিংসতাবিরোধী নীতিমালা প্রণয়ন করা হবে। একই সঙ্গে অভিযোগ সেল ও নিষ্পত্তি কমিটি গঠন করা জরুরি। আইএলও ১৯০ কনভেনশন অনুসমর্থন করা।

সর্বজনীন মাতৃত্বকালীন সুরক্ষা: নারী শ্রমিকের মাতৃত্বকালীন ছুটি সবেতনে ছয় মাস করার উদ্যোগ গ্রহণ করবে রাষ্ট্র। এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি সরকারের সহায়তা প্রদান ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের জন্য বিশেষ স্কিম প্রণয়ন করা।

শিশু-কিশোর ও জবরদস্তিমূলক শ্রম বন্ধ ও নিরাপত্তা: শিশু-কিশোর ও জবরদস্তিমূলক শ্রম বন্ধে সরকার যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। আগাম দাদন দেওয়াসহ বিভিন্ন পদ্ধতিতে জবরদস্তিমূলক সব পথ বন্ধ করায় কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া।

সুসমন্বিত শিল্প সম্পর্ক ও সামাজিক সংলাপ চর্চা: সুসমন্বিত-সৌহার্দ্যপূর্ণ কর্মপরিবেশ নিশ্চিতে শ্রমিক-নিয়োগকারীসহ সব পক্ষের দায়িত্বশীল আচরণ এবং কার্যকর সংলাপের কাঠামো ও প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা।

সুষ্ঠু শ্রম আদালত, ন্যায়বিচার ও বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির ব্যবস্থা: শ্রমিকের ন্যায়বিচার প্রাপ্তির জন্য শ্রম আদালতের সংখ্যা বৃদ্ধি, মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি ও অযথা হয়রানি বন্ধে সরকারের উদ্যোগ নেওয়া। আইনের অধিকার লঙ্ঘন প্রতিকারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা ও কাঠামো নিশ্চিত করা। বিরোধ নিষ্পত্তি ও আইনানুগ প্রাপ্য অর্জনের লক্ষ্যে পরিচালিত কোনো কার্যক্রমের ক্ষেত্রে ফৌজদারি ব্যবস্থা গ্রহণ ও বলপ্রয়োগ বন্ধ করা। বিভিন্ন সময়ে শ্রমিক আন্দোলনে অংশগ্রহণের অভিযোগে যে সব ট্রেড ইউনিয়ন কর্মী ও শ্রমিকের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করা হয়েছে তা দ্রুত পর্যালোচনা সাপেক্ষে বাতিল করা।

মর্যাদাপূর্ণ-হয়রানিমুক্ত কর্মপরিবেশ ও আদালতে বাংলাভাষার প্রচলন: মর্যাদাপূর্ণ শ্রমপরিবেশের সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে শ্রেণি, লিঙ্গ, বর্ণ, জাতি ভেদে অবমাননাকর ও অমর্যাদাকার ক্ষমতাকেন্দ্রিক ভাষার ব্যবহার রোধ করা। শ্রম আইনে ‘মহিলা’ শব্দের পরিবর্তে নারী ব্যবহার করা। কর্মপরিবেশে শ্রেণিক্ষমতায় তুই-তুমি সম্বোধন চর্চা বন্ধ করা। শ্রম আদালতের শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনাল থেকে হাইকোর্ট ও অ্যাপিলেড ডিভিশন পর্যন্ত সর্বত্র বাংলা ভাষার প্রচলন করা।

সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও প্রতিনিধিত্বে নারী-পুরুষ শ্রমিকের অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণ: শ্রমসংশ্লিষ্ট নীতি, বাৎসরিক বাজেট এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা-২০৩০ অর্জনসহ বিভিন্ন জাতীয় পরিকল্পনা গ্রহণ-বাস্তবায়নে নারী-পুরুষ উভয় শ্রমিক ও তার প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা এবং জাতীয় সংসদসহ সব প্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠানে কিংবা ফোরামে সংঘবদ্ধ শ্রমিক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিতে সরকারের নীতি প্রণয়ন।

আপদকালীন তহবিল গড়ে তোলা ও বিদ্যমান তহবিলের স্বচ্ছতা: দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সংকট, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মহামারি, ব্যবসায় আকস্মিক সংকটের কারণে শ্রমিকের মজুরি ও অন্যান্য প্রাপ্তি লাভ এবং উৎপাদন অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে সরকারের জরুরি ও আপদকালীন তহবিল গঠন করা। এছাড়া শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন, কেন্দ্রীয় তহবিলের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা।

শ্রমিক ইতিহাস-ঐতিহাসিক স্থান সুরক্ষা ও স্মৃতিসৌধ গঠন: শ্রমিক ইতিহাস ও ঐতিহাসিক স্থান সুরক্ষা, স্মৃতিসৌধ ও যাদুঘর গঠনে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ গ্রহণ। পাঠ্যপুস্তক, পাঠ্যক্রম, শিক্ষা কোর্স ও মিডিয়ায় শ্রমের মর্যাদা, নিরাপত্তা ও শ্রমিকের জীবন গাঁথা মর্যাদাপূর্ণভাবে উত্থাপন।

শহীদ স্বীকৃতি, পুনর্বাসন, চিকিৎসা ও ন্যায়বিচার: চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান ও শ্রমিক আন্দোলনে নিহত সব শ্রমিককে রাষ্ট্র কর্তৃক শহীদের স্বীকৃতি প্রদান। এছাড়া শ্রমখাতে দুর্ঘটনা বা অবহেলাজনিত কারণে নিহতদের ক্ষতিপূরণ ও আহতদের পুনর্বাসন, চিকিৎসার জন্য রাষ্ট্রীয় যথাযথ নীতি গ্রহণ। একই সঙ্গে রানাপ্লাজা, তাজরীন গার্মেন্টস এবং হাসেম ফুডসহ উল্লেখযোগ্য কর্মক্ষেত্র দুর্ঘটনাসমূহের ক্ষেত্রে দায়ীদের দ্রুত বিচার ও শাস্তির আওতায় আনা।

টেকসই শিল্পায়ন, উৎপাদনশীলতা ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন: জাতীয় শিল্পের বিকাশ, শিল্পায়ন ও টেকসই এবং শ্রমঘন শিল্প প্রতিষ্ঠা, উদ্যোক্তা গড়ে তোলার জন্য ব্যাপক ও পরিকল্পিত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ এবং সামাজিক ব্যবসার প্রতিষ্ঠাকে উৎসাহিত করবে রাষ্ট্র। এ লক্ষ্য আন্তঃমন্ত্রণালয় টাস্কফোর্স গঠন এবং শিল্প, দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সংশ্লিষ্ট জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে নিয়মিত সমন্বয় কার্যক্রম প্রতিষ্ঠা করা জরুরি।

শিল্পাঞ্চল ও শ্রমঘন এলাকায় নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করা: শ্রমিক ও তার পরিবারের জন্য শিল্পাঞ্চলে নাগরিক সুবিধা ও সেবা নিশ্চিত করা। বিশেষ করে এই সুবিধা (শিক্ষা, চিকিৎসা, স্বাস্থ্যবিমা, সেবামূলক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ, রাস্তাঘাটের উন্নয়ন, গ্যাস বিদ্যুৎ-পানির যথাযথ সরবরাহ ও অন্যান্য) যাতে শ্রমজীবী মানুষের জন্য পরিচালিত হয় তার উদ্যোগ গ্রহণ, যা সার্বিকভাবে একটি কল্যাণ রাষ্ট্র ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখতে পারে।

জলবায়ু ও বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বিবেচনায় কর্মপরিবেশ গঠন: জলবায়ু ও বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বিবেচনায় শ্রম পরিবেশ গড়ে তোলায় সরকার ভূমিকা নেবে। এ সংক্রান্ত দেশীয় পরিবেশ বাস্তবতা এবং আন্তর্জাতিক দায়বদ্ধতা পরিপালনে মনোযোগী হওয়া।

অভিবাসী শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও অধিকার নিশ্চিত করা: অভিবাসী শ্রমিকের কল্যাণ নিশ্চিত ও অভিবাসন ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী করতে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা করা। এ লক্ষ্যে অভিবাসী শ্রমিকের স্বীকৃতি, সংগঠিত হওয়া এবং প্রতিনিধিত্বের অধিকার নিশ্চিত করা। একইসঙ্গে দেশীয়-আন্তর্জাতিক সম্পর্ক জোরদার করা। শ্রমবিষয়ক গবেষণা ও জরিপ: শ্রম শক্তি জরিপ, শ্রম সংক্রান্ত গবেষণা ও শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনায় সরকার কর্তৃক আলাদা বিভাগ গঠন করা।

প্রতি বছর শ্রমজীবী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার বার্তা নিয়ে আসে মে দিবস। এ বার্তা শুধু জানিয়ে দেওয়ার বিষয় নয়। শ্রমিকদের ন্যায্যমজুরি ও অধিকার নিশ্চিত করেই মহান মে দিবসের প্রতি সম্মান জানাতে হবে। একজন শ্রমিকের স্বাস্থ্যসম্মত কর্মপরিবেশ ও কর্মস্থলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। শ্রমিকদের প্রতি মানবিক আচরণ করতে হবে।

FJ
আরও পড়ুন