তামাক ব্যবহারে প্রতিবছর বিশ্বের অন্তত ৮০ লাখ মানুষ প্রাণ হারায়। বিশ্বব্যাপী মৃত্যুঝুঁকির কারণ হিসেবে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে তামাক। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশে প্রায় ৪ কোটি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তামাক ব্যবহার করে। এ কারণে দেশে বছরে ১ লাখ ৬১ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। পঙ্গুত্ববরণ করে বছরে আরও প্রায় ৪ লাখ মানুষ। তামাক ব্যবহারের অর্থনৈতিক ক্ষতির (চিকিৎসা ব্যয় এবং উৎপাদনশীলতা হারানো) পরিমাণ বছরে ৩০ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা।
শনিবার (৩১ মে) বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সমন্বয় করে বাংলাদেশেও দিবসটি পালন করছে বিভিন্ন তামাকবিরোধী সংগঠন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে ‘আনমাস্কিং দি অ্যাপিল: এক্সপোজিং ইন্ডাস্ট্রি ট্যাকটিকস অন টোব্যাকো অ্যান্ড নিকোটিন প্রোডাক্টস’। বাংলাদেশে দিবসটি উদযাপিত হচ্ছে ‘তামাক কোম্পানির কূটকৌশল উন্মোচন করি, তামাক ও নিকোটিনমুক্ত বাংলাদেশ গড়ি’ এই শিরোনামে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশে বর্তমান মোট জনগোষ্ঠীর ৪৮ শতাংশই তরুণ-তরুণী। তামাক কোম্পানির মূল টার্গেট কীভাবে এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে তামাকে আসক্ত করে ব্যবসা বাড়ানো যায়। তামাক ব্যবহারজনিত মৃত্যু এবং অসুস্থতা এসডিজির তৃতীয় লক্ষ্যমাত্রা- সুস্বাস্থ্য অর্জনের একটি বড় বাধা। তামাক ও নিকোটিন পণ্যমুক্ত একটি সুস্থ, সুখী ও উদ্যমী প্রজন্ম গড়ে তুলতে পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
জানা গেছে, ২০২৩ সালের বৈশ্বিক তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপ সূচক প্রতিবেদনে ৭২ স্কোর নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে একেবারে তলানিতে। ২০১৮ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত প্রণীত তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপ সূচক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এই সময়কালে বাংলাদেশের স্কোর প্রায় একই অবস্থানে স্থবির রয়েছে, যার অর্থ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রণীত ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোলের (এফসিটিসি) অনুস্বাক্ষরকারী দেশ হওয়া সত্ত্বেও জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় এফসিটিসি আর্টিকেল ৫ দশমিক ৩ বাস্তবায়নে প্রকৃত কোনও অগ্রগতির মুখ দেখেনি দেশ। সাম্প্রতিক সময়ে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের চলমান সংশোধনী প্রক্রিয়াকে বিলম্বিত ও বাধাগ্রস্ত করতে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে হস্তক্ষেপ জোরদার করেছে তামাক কোম্পানিগুলো।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বে ১৩-১৫ বছর বয়সী অন্তত ৩ কোটি ৭০ লাখ কিশোর-কিশোরী নিয়মিত তামাক ব্যবহার করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিস কন্ট্রোলের (সিডিসি) এক গবেষণায় দেখা গেছে, ২১ বছর বয়সের আগেই যারা তামাকে আসক্ত হয়ে পড়েছেন তাদের মধ্যে নিকোটিন নির্ভরতা এবং আমৃত্যু তামাক ব্যবহারের প্রবণতা সবচেয়ে বেশি।
সূত্র জানিয়েছে, তামাকই পৃথিবীর একমাত্র বৈধ পণ্য, যা অবধারিতভাবে তার ভোক্তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। এক প্রজন্মের তামাকসেবী যখন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে কিংবা ঘাতক ব্যাধির প্রকোপে তামাক সেবন ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়, ব্যবসা টিকিয়ে রাখতেই কোম্পানির জন্য তখন নতুন প্রজন্মের তামাকসেবী তৈরি অপরিহার্য হয়ে পড়ে। তাই সর্বদা চলে নতুন ভোক্তা তৈরির কাজ। নতুন প্রজন্মই এ ক্ষেত্রে তামাক কোম্পানির প্রধান লক্ষ্য। মোহনীয় বিজ্ঞাপনের ফাঁদে পড়ে যে শিশু বা কিশোর-কিশোরী আজ ঠোঁটে তামাকপণ্য তুলে নিচ্ছে, কাল সে-ই পরিণত হচ্ছে তামাক কোম্পানির আমৃত্যু ভোক্তায়।
সূত্র জানায়, নিকোটিনযুক্ত প্রাণঘাতী পণ্যে আকৃষ্ট করতে ইচ্ছাকৃতভাবে নানা কারসাজির আশ্রয় নেয় কোম্পানিগুলো। বিশেষ করে তারুণ্যকে লক্ষ্য করে উদ্ভাবনী বিজ্ঞাপন এবং আকর্ষণীয় ডিজাইনে নিত্যনতুন পণ্য বাজারজাত করাসহ নানা কৌশল অবলম্বন করে থাকে এই মৃত্যু বণিকেরা। উদাহরণস্বরূপ, ২০১৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ই-সিগারেটর বিজ্ঞাপনে মোট ব্যয় হয় ৪৮ মিলিয়ন ডলার, যা ২০১৮ সালে বেড়ে ১১০ মিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায়। গবেষণায় দেখা গেছে, ওই সময়ে মাত্র এক বছরের ব্যবধানে দেশটিতে স্কুল পড়ুয়াদের মধ্যে ই-সিগারেট ব্যবহার ৭৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২২ সালের তথ্য অনুযায়ী, ইউরোপীয় অঞ্চলে কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে ই-সিগারেট ব্যবহারের হার ১২ দশমিক ৫ শতাংশ, অথচ প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে এই হার মাত্র ২ শতাংশ।
কারসাজির মাধ্যমে জীবনক্ষয়ী পণ্য ব্যবহারে শিশু-কিশোরদের আকৃষ্ট করাই তামাক কোম্পানির একমাত্র হাতিয়ার। বাজারে ১৬ হাজারের বেশি সুগন্ধযুক্ত তামাকপণ্য (ই-সিগারেট, সিসা এবং ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্য) রয়েছে। স্কুলপড়ুয়া শিশুদের আকৃষ্ট করতে বাবলগাম, চেরি, চকলেট ইত্যাদি সুগন্ধীর তামাকপণ্য বাজারজাত করা হচ্ছে। ফলে শিশুখাদ্য আর তামাকের ফারাক করতে পারছে না অনেক শিশু, সুগন্ধীর লোভে পড়ে স্বাস্থ্য ক্ষতিকে অগ্রাহ্য করে হাতে তুলে নিচ্ছে এসব বিষপণ্য। ইউএসবি স্টিক, ক্যান্ডি, কলমসহ বিভিন্ন পণ্যের আদলে আকর্ষণীয় ডিজাইনে বাজারজাত করা হচ্ছে এসব পণ্য। চলচ্চিত্র, টিভি প্রোগ্রাম, সোশ্যাল মিডিয়া ও অনলাইন স্ট্রিমিং প্রোগ্রামগুলোতে এগুলোর চিত্রায়ণ বাড়িয়ে দিয়ে তারুণ্যকে প্রলুব্ধ করছে কোম্পানিগুলো। এছাড়া শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পার্শ্ববর্তী দোকানগুলোতে তামাকপণ্য সহজলভ্য করে তোলা হচ্ছে। বিশেষত করে শিশুদের পছন্দের খাবার, যেমন- ক্যান্ডি, চিপস ইত্যাদির পাশে তামাকপণ্য এবং বিজ্ঞাপনী সরঞ্জামগুলো রাখা হচ্ছে সুকৌশলে। মিডিয়া আইকন ও ইনফ্লুয়েন্সারদের ব্যবহার করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ই-সিগারেট এবং ভ্যাপিংয়ের বিজ্ঞাপন চালানো হচ্ছে।
২০১৬ সালে ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় অবস্থিত মোট ১১০টি স্কুলের পারিপার্শ্বিক এলাকার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত গবেষণায় দেখা যায়, বিদ্যালয়ের ১০০ মিটার ব্যাসার্ধ এলাকার মধ্যে অবস্থিত মোট ৫০৭টি মুদি দোকানের ৪৮৭টিতেই চকলেট, ক্যান্ডি, কোমল পানীয় ইত্যাদির পাশেই তামাকপণ্য প্রদর্শন করা হয়, যা শিশুদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ২০১৩ সালে পরিচালিত গ্লোবাল ইউথ টোব্যাকো সার্ভের ফলাফলে দেখা যায়, ৫২ দশমিক ৩ শতাংশ শিক্ষার্থী বিক্রয়কেন্দ্রে তামাকপণ্যের বিজ্ঞাপন দেখেছেন বলে জানান। ৬ দশমিক ৩ শতাংশ শিক্ষার্থী জানান, তাদের তামাক কোম্পানির প্রতিনিধির পক্ষ থেকে প্রচারণার স্বার্থে বিনামূল্যে তামাকপণ্য সরবরাহ করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশে বর্তমান মোট জনগোষ্ঠীর ৪৮ শতাংশই তরুণ-তরুণী। তামাক কোম্পানির মূল টার্গেট কীভাবে এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে তামাকে আসক্ত করে ব্যবসা বাড়ানো যায়। বাংলাদেশে প্রায় ৪ কোটি (৩৫ শতাংশ) প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তামাক ব্যবহার করে। তামাক ও নিকোটিন পণ্যমুক্ত একটি সুস্থ, সুখী ও উদ্যমী প্রজন্ম গড়ে তুলতে পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি বলে মনে করেন তারা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা নুরজাহান বেগম বলেন, বাংলাদেশের বিদ্যমান তামাকবিরোধী আইনটিকে যুগোপযোগী করতে এর সংশোধনীর কাজ চলছে। দেশের মানুষকে তামাকের কারণে সৃষ্ট বিভিন্ন রোগ থেকে দূরে রাখার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে নানামুখী ক্যাম্পেইন চলছে।
ক্যাম্পেইন ফর টোব্যাকো ফ্রি কিডসের (সিটিএফকে) বাংলাদেশ কর্মকর্তা আব্দুস সালাম মিয়া জানিয়েছেন, বাংলাদেশের আগামীর ভবিষ্যৎ তরুণ প্রজন্মকে রক্ষার জন্য বিদ্যমান তামাকবিরোধী আইনটিকে আধুনিকায়নের প্রয়োজনে সংশোধনের পাশাপাশি কার্যকর করা খুবই সময় উপযোগী হয়ে উঠেছে। একইসঙ্গে তামাকের ব্যবহার কমানোর লক্ষ্যে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসতে হবে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান প্রগতির জন্য জ্ঞানের (প্রজ্ঞা) নির্বাহী পরিচালক এবিএম জুবায়ের জানান, কোম্পানির হস্তক্ষেপমুক্ত থেকে যথাসম্ভব দ্রুত তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের সংশোধনী চূড়ান্ত করার মাধ্যমে বিক্রয়স্থলে তামাকপণ্য প্রদর্শন নিষিদ্ধ, ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান বিলুপ্ত, ই-সিগারেটসহ সব ভ্যাপিং পণ্য নিষিদ্ধ এবং তামাক কোম্পানির করপোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটির (সিএসআর) কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে। সিগারেটের সহজলভ্যতা কমাতে নিম্ন স্তর এবং মধ্যম স্তরকে একত্রিত করে মূল্যস্তরের সংখ্যা চারটি থেকে তিনটিতে নামিয়ে আনা প্রয়োজন। একইসঙ্গে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এফসিটিসি আর্টিকেল ৫ দশমিক ৩-এর সুষ্ঠু বাস্তবায়নের মাধ্যমে তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপ মোকাবিলা করতে হবে।
