প্রতিবছরই এডিপি বাস্তবায়ন কার্যক্রম জটিল ও ধীরগতির হয়ে পড়ে। বিগত সরকারের সময়ে এই সমস্যা প্রকট আকার ধারন করে। রাজস্ব ঘাটতি, বৈদেশিক সহায়তার অনিশ্চয়তা এবং অর্থছাড়ের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণের কারণে প্রকল্প বাস্তবায়ন কার্যক্রমও জটিল আকার ধারন করে।
নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর সময় যত গড়িয়েছে, ততই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে গত সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) পরিকল্পনা বাস্তবতা বিবর্জিত ছিল। গত জুলাই থেকে এপ্রিল পর্যন্ত সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ ব্যয় করেছে এডিপি বরাদ্দের মাত্র ৪১ দশমিক ৩১ শতাংশ, যা এই সময়ের হিসাবে গত ৫ অর্থবছরের মধ্যে সর্বনিম্ন এডিপি বাস্তবায়ন।
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ২৬ হাজার ১২৫ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। মূল বাজেটে এডিপির আকার ছিল ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ মূল বাজেটের তুলনায় এডিপির আকার ১৮ শতাংশ কমে গেছে, যা টাকার অঙ্কে ৩৮ হাজার ৮৭৫ কোটি টাকার সমান।
বিগত কয়েক বছরের তথ্য বলছে, মূল এডিপি থেকে সাধারণত আরএডিপিতে ৫ থেকে ১০ শতাংশ হারে বরাদ্দ কমানো হয়, তবে এবার পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বরাদ্দ কমানোর হার তুলনামূলক একটু বেশি হচ্ছে।
কমিশনের তৈরি চূড়ান্ত আরএডিপির খসড়া তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সাধারণত প্রতিবছর তিনটি ভাগে এডিপি বাস্তবায়িত হয়ে থাকে। আর এডিপির ক্ষেত্রেও একই নিয়মে তিন ভাগ থেকেই টাকার অঙ্ক কমানো হয়েছে। এর মধ্যে স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা ও করপোরেশন তাদের নিজস্ব অর্থ দিয়ে যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে, তার মোট পরিমাণ ১০ হাজার ১২৫ কোটি ৬৯ লাখ টাকা।
এরপর সরকার নিজেদের তহবিল থেকে ১ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকা দিয়ে প্রকল্পগুলো অর্থায়ন করবে। আর বিদেশি ঋণ বা অনুদান দিয়ে যেসব প্রকল্প বাস্তবায়িত হবে, তার জন্য ৮১ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। সব মিলিয়ে এই বছরে মোট আরএডিপির আকার দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা।
সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ পেয়েছে পরিবহন ও যোগাযোগ খাত, যার পরিমাণ ৪৮ হাজার ২৫৩ কোটি টাকা। এরপরেই রয়েছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত ৩১ হাজার ৮৯৭ কোটি টাকা নিয়ে। তৃতীয় স্থানে রয়েছে শিক্ষা খাত, যেখানে বরাদ্দ ২০ হাজার ৩৪৯ কোটি টাকা।
এছাড়া সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ পাওয়া মন্ত্রণালয় হলো স্থানীয় সরকার বিভাগ, যার জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে ৩৬ হাজার ১৯৫ কোটি টাকা। বিদ্যুৎ বিভাগের জন্য বরাদ্দ রয়েছে ২১ হাজার ৪৭৫ কোটি টাকা। সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের বরাদ্দ ১৮ হাজার ৬২৪ কোটি টাকা এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ ১২ হাজার ৭৬৪ কোটি টাকা। সংশোধিত উন্নয়ন কর্মসূচিতে বরাদ্দ বিবেচনায় অগ্রাধিকার পাওয়া অন্য খাতগুলোর মধ্যে রয়েছে,গৃহায়ণ ও কমিউনিটি সুবিধাবলি খাতে ১৯ হাজার ৬৪৫ কোটি টাকা। স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন খাতে ১৬ হাজার ৯৫৩ কোটি টাকা। পরিবেশ, জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ খাতে ১১ হাজার ৬৪৯ কোটি টাকা। কৃষি খাতে ৯ হাজার ৬৩১ কোটি টাকা, স্বাস্থ্য খাতে ৮ হাজার ৪৬৩ কোটি টাকা। শিল্প ও অর্থনৈতিক সেবা খাতে ৪ হাজার ৪৪১ কোটি টাকা এবং বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৪ হাজার ৩২৭ কোটি টাকা। আর মন্ত্রণালয়ভিত্তিক বিবেচনায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ ১২ হাজার ১২৯ কোটি টাকা। রেল মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ ১০ হাজার ২২৭ কোটি টাকা।
পানিসম্পদের বরাদ্দ ১০ হাজার ২১১ কোটি টাকা, নৌ পরিবহনে বরাদ্দ ৭ হাজার ১৫৩ কোটি টাকা, সেতু বিভাগের বরাদ্দ ৫ হাজার ৮৪৮ কোটি টাকা এবং স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ রয়েছে ৫ হাজার ৬৬৮ কোটি টাকা।
পরিকল্পনা উপদেষ্টা আরএডিপি বিষয়ে বলেন, ‘প্রতি বছর মার্চে উন্নয়ন বাজেট সংশোধন করা হয়। আমরা এটি আরও এগিয়ে আনার চেষ্টা করছি। আমাদের লক্ষ্য হলো কর্মসংস্থান বৃদ্ধি এবং জনগণের উপকার করা। এই সংশোধনীতে অবকাঠামোর চেয়ে মানবসম্পদ উন্নয়ন খাতের ব্যয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে বেশি।
ধীরগতির বিষয়ে পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন বলেন, এডিপি বাস্তবায়ন হার কম হওয়ার পেছনে অনেকগুলো কারণ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো ঠিকমতো অর্থছাড় না হওয়া। কারণ, বর্তমান অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে অর্থছাড় কমিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। পাশাপাশি জনগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাস্তবায়নে জোর দেওয়া হচ্ছে।এতে ফলাফল প্রত্যাশিতই অর্থবছরের ১০ মাস অতিক্রান্ত হলেও সংশোধিত এডিপির লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে এখন পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়েছে মাত্র ৪১ শতাংশ, অর্থাৎ প্রায় ৫৯ শতাংশই রয়ে গেছে বাস্তবায়নের বাইরে। এডিপি বাস্তবায়নে এই মারাত্মক পশ্চাদপসরণ অর্থনীতির গতি শ্লথ করে দেওয়ার পাশাপাশি বাজেটকাঠামোর ওপরও চাপ সৃষ্টি করেছে। যে কারণে আসন্ন বাজেটে অন্তর্বর্তী সরকারকে সংযত এডিপি প্রণয়ন করতে হচ্ছে।
গত সোমবার আইএমইডি প্রকাশিত তথ্যে দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) এডিপি বাস্তবায়নের হার ছিল মাত্র ৪১.৩১ শতাংশ, যা ২০১৮-১৯ সালের পর সর্বনিম্ন। এ সময়ে অর্থছাড় হয়েছে ৯৩ হাজার ৪২৪ কোটি টাকা, যেখানে গত অর্থবছরের একই সময়ে ছাড় হয়েছিল ১ লাখ ২৫ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা। শুধু এপ্রিল মাসেই অর্থছাড় কমে দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৫৩০ কোটি টাকায়, আগের বছরের এপ্রিলের তুলনায় যা প্রায় ৪০ শতাংশ কম। এই তথ্যে এডিপি বাস্তবায়নের গতি ও অর্থছাড়ে স্পষ্ট স্থবিরতার চিত্র উঠে এসেছে।
পরিকল্পনা বিভাগের সাবেক সচিব মামুন আল রশিদের কাছে এই অচলাবস্থা সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়। তিনি জানান, অনেক প্রকল্পে কাজ শেষ হলেও বিল পরিশোধ আটকে আছে, কারণ সরকার এখন বিলগুলো যাচাই-বাছাই করে তবেই অর্থ ছাড় দিচ্ছে, যার ফলে ব্যয়ের গতি কম।
তিনি বলেন, কোনো বছরই বাজেটের পুরো অর্থ খরচ হয় না, তবে শেষ সময়ে তাড়াহুড়ো করে অর্থ ব্যয় করলে অপচয়, দুর্নীতি এবং গুণগত মানহানির ঝুঁকি বাড়ে। তাই তিনি মনে করেন, বিল যাচাই করে ধাপে ধাপে অর্থছাড় করাই হবে সুশাসনের দৃষ্টিকোণ থেকে সঠিক পথ।
