বিশ্বের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও শিল্পকলার সোনালি চিহ্ন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বেশ কিছু অনন্যসাধারণ জাদুঘর। এগুলোকে শুধু নিছক ভবন বলা যাবে না; বরং সভ্যতার স্মারক, সময়ের সাক্ষী ও মানুষের সৃষ্টিশীলতার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দেখা গেছে, বিশ্বজুড়ে জাদুঘরের প্রতি মানুষের আগ্রহ যেন বেড়েছে বহুগুণে। বিশেষ করে কোভিড মহামারি–পরবর্তী সময়ে মানুষ যেন আরও বেশি করে ফিরেছেন ইতিহাস, শিল্প ও সভ্যতার সংস্পর্শে। এর মধ্যেই বিশ্বের এমন কিছু জাদুঘর রয়েছে, যা পর্যটকদের কাছে প্রধান আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। চলুন, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের প্রতিবেদনে উঠে আসা বিশ্বের শীর্ষ ১০ জাদুঘর সম্পর্কে জেনে নিই, যেখানে সবচেয়ে বেশি দর্শনার্থী ভিড় করেন।
ল্যুভর জাদুঘর
বিশ্বে পর্যটকদের কাছে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় জাদুঘর ল্যুভর। এটি ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে অবস্থিত। প্রতিবছর প্রায় ৯০ লাখের বেশি দর্শনার্থী এই জাদুঘরে আসেন। প্রাচীন সভ্যতার শুরু থেকে আধুনিক সভ্যতার বর্তমান সময় পর্যন্ত ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ নিদর্শনগুলো রাখা আছে এই জাদুঘরে। এখানে সংরক্ষিত আছে লেওনার্দো দা ভিঞ্চির ঐতিহাসিক শিল্পকর্ম মোনালিসা। আরও আছে জনপ্রিয় প্রাচীন গ্রিক ভাস্কর্য ভেনাস দে মিলো ও উইংড ভিক্টরি অব সামোথ্রেস। তবে গত ১৬ জুন অতিরিক্ত দর্শনার্থীর চাপ ও কর্মীদের কর্মবিরতির কারণে জাদুঘরটি সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
ভ্যাটিকান জাদুঘর

ভ্যাটিকান জাদুঘর বিশ্বের নামকরা জাদুঘরের মধ্যে একটি। এটি ভ্যাটিকান সিটিতে অবস্থিত। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে পোপদের সংগ্রহ করা শিল্পকর্ম ও পুরাকীর্তি এখানে স্থান পেয়েছে। এখানে প্রাচীন রোমান ভাস্কর্য থেকে শুরু করে রেনেসাঁ যুগের বিখ্যাত চিত্রকর্ম দেখতে পাওয়া যায়। এখানে রয়েছে গ্রিক শিল্পকর্ম, মিসরীয় সংগ্রহশালা, আধুনিক ধর্মীয় শিল্পসহ আরও অনেক কিছু। প্রতিবছর ৬৮ লাখ দর্শনার্থী এই জাদুঘর দেখতে আসেন। প্রতি মাসের শেষ রোববার বিনা মূল্যে ভ্যাটিকান জাদুঘর পরিদর্শনের সুযোগ থাকে।
চীনের জাতীয় জাদুঘর

বেইজিংয়ের তিয়েনআনমেন স্কয়ারের পাশে অবস্থিত এই জাদুঘর বিশ্বের বৃহত্তম জাদুঘরগুলোর একটি। চীনের পাঁচ হাজার বছরের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও শিল্পকলার বিপুল সংগ্রহ এখানে স্থান পেয়েছে। হান রাজবংশের সোনার সুতা ও জেড পাথরের ছোট ফলক দিয়ে তৈরি সমাধি পোশাক ও সিমুউ ডিং (বিশ্বের সবচেয়ে ভারী প্রাচীন ব্রোঞ্জ নিদর্শন) এই জাদুঘরের অন্যতম আকর্ষণ। প্রতিবছর প্রায় ৬৭ লাখ দর্শনার্থী এই জাদুঘর ঘুরে দেখেন। এর আয়তন ৭০ হাজার বর্গমিটার। এখানে রয়েছে ৪৮টি গ্যালারি।
ব্রিটিশ জাদুঘর
লন্ডনে অবস্থিত ব্রিটিশ জাদুঘর ১৭৫৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ১৭৫৯ সালে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। এখানে ৮০ লাখের বেশি ঐতিহাসিক নিদর্শন সংগ্রহ করে রাখা হয়েছে। প্রধান আকর্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে রোসেটা স্টোন, পার্থেনন ভাস্কর্য ও স্ফেলোস ভাসের মতো বহু ঐতিহাসিক নিদর্শন। সম্প্রতি মুসলিম বিশ্বের শিল্প ও সংস্কৃতি প্রদর্শনের জন্য এই জাদুঘরে নতুন একটি গ্যালারি চালু করা হয়েছে, যা ইসলামের ভাবমূর্তি আরও ইতিবাচকভাবে তুলে ধরতে সহায়ক হবে। ২০২৪ সালে ৬৪ লাখ দর্শনার্থী জাদুঘরটি পরিদর্শন করেছেন।
ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম
লন্ডনের ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম একটি বিখ্যাত প্রাকৃতিক ইতিহাস ও বিজ্ঞান জাদুঘর। এটি দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত ও বিনা মূল্যে প্রবেশযোগ্য। এখানে একটি বিজ্ঞান গবেষণাকেন্দ্রও রয়েছে, যেখানে জীবন ও পৃথিবীর ইতিহাসবিষয়ক বিভিন্ন গবেষণা করা হয়। এই জাদুঘর ঘুরে দেখতে সাধারণত এক থেকে চার ঘণ্টা সময় লাগে। জাদুঘরে ডাইনোসরের কঙ্কাল, তিমি মাছের কঙ্কাল, বিভিন্ন প্রাণী, জীবাশ্ম ও খনিজ পদার্থের বিশাল সংগ্রহ রয়েছে। এখানে জীবনের বিভিন্ন দিক ও পৃথিবীর ইতিহাস সম্পর্কে জানার জন্য গ্যালারি রয়েছে। ২০২৪ সালে এখানে প্রায় ৬৩ লাখ দর্শনার্থী এসেছিলেন।

যুক্তরাজ্যের দ্বিতীয় সর্বাধিক দর্শনীয় স্থান এই প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্যভিত্তিক জাদুঘর। এটি দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত ও বিনা মূল্যে প্রবেশযোগ্য। জাদুঘরের ডাইনোসর গ্যালারি ও ‘ডিপি’ নামে পরিচিত বিশাল ডিপ্লোডোকাস কঙ্কাল ছোট–বড় সবার কাছে সমান জনপ্রিয়। ২০২৪ সালে দর্শনার্থীর সংখ্যা ছিল প্রায় ৬৩ লাখ।
মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম অব আর্ট (দ্য মেট)
নিউইয়র্ক নগরে অবস্থিত বিখ্যাত শিল্প জাদুঘর মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম অব আর্ট সংক্ষেপে দ্য মেট নামে পরিচিত। এটি ১৮৭০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রাচীন মিসরীয় শিল্প থেকে শুরু করে আধুনিক আমেরিকান শিল্পকর্ম পর্যন্ত বিভিন্ন যুগের ও সংস্কৃতির ২০ লাখের বেশি বিশাল সংগ্রহ রয়েছে এখানে। প্রতিবছর মে মাসের প্রথম সোমবার এ জাদুঘরে বিখ্যাত ফ্যাশন ইভেন্ট ‘মেট গালা’ আয়োজন করা হয়। প্রতিবছর এই জাদুঘর দেখতে আসেন প্রায় ৫৩ লাখ মানুষ।
আমেরিকান মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিস্ট্রি
যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের ম্যানহাটানে আমেরিকান মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিস্ট্রি অবস্থিত। ১৮৬৯ সালে জাদুঘরটির যাত্রা শুরু। বিভিন্ন প্রাণীর জীবাশ্ম, খনিজ পদার্থ, শিলা, উল্কাপিণ্ড ও মানবসভ্যতার নিদর্শনসহ নানা জিনিস দেখতে প্রতিবছর এখানে প্রায় ৫০ লাখ দর্শনার্থী আসেন। গবেষণার কাজেও আসেন অনেকে। ২১টি আন্তসংযুক্ত ভবন নিয়ে গঠিত এই জাদুঘরে আছে ৩০ লাখের বেশি নিদর্শন।
টেট মডার্ন

পুরোনো একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভবনে তৈরি এই আধুনিক ও সমকালীন শিল্পকেন্দ্রটি লন্ডনের টেমস নদীর তীরে অবস্থিত। দর্শনার্থীরা এখানে এলে আন্তর্জাতিক ও ব্রিটিশ শিল্পকলার অনন্য সংগ্রহশালা দেখতে পাবেন। বিশেষ করে এখানকার টারবাইন হল বিশাল শিল্প প্রদর্শনীর জন্য বিখ্যাত। ২০২৩ সালে এখানে প্রায় ৪৭ লাখ দর্শনার্থী এসেছিলেন।
ন্যাশনাল মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিস্ট্রি
ন্যাশনাল মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিস্ট্রি ১৯১০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি বিশ্বের বৃহত্তম প্রাকৃতিক ইতিহাসভিত্তিক জাদুঘর। এর আয়তন প্রায় ১৮টি ফুটবল মাঠের সমান। এখানে সংরক্ষিত আছে প্রায় ১৪ কোটি ৬০ লাখ নিদর্শন। এখানে ডাইনোসরের কঙ্কাল, হোপ ডায়মন্ড ও মিসরীয় মমিসহ আরও অনেক বিখ্যাত নিদর্শন আছে। ২০২৩ সালে প্রায় ৪৪ লাখ দর্শনার্থী এ জাদুঘর দেখতে এসেছিলেন।
গুয়াংডং জাদুঘর
গুয়াংডং জাদুঘর চীনের গুয়াংজু শহরে অবস্থিত। এটি চীনের লিংনান অঞ্চলের সংস্কৃতি ও ইতিহাসের এক অসাধারণ সংরক্ষণাগার। চীনা চিত্রকলা, ক্যালিগ্রাফি, ভাস্কর্য, কাঠ খোদাই করে তৈরি শিল্পকর্ম, রত্ন পাথরসহ ১ লাখ ৬৬ হাজারের বেশি নিদর্শন রয়েছে। ২০২৩ সালে জাদুঘরটি দেখতে এসেছিলেন ৪০ লাখ মানুষ।
মধুচন্দ্রিমা মধুর হোক এই ছয় গন্তব্যে
ম্যানহাটান থেকে মধ্যরাতে বাসযাত্রা, গন্তব্য নায়াগ্রা ফলস