ঢাকা
মঙ্গলবার, ১৮ নভেম্বর ২০২৫, ২ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
ই-পেপার

৫৪ বছরেও মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাননি ইউসুফ আলী

‘আমি একাধিকবার বিভিন্ন জায়গায় গিয়েছি সনদের জন্য, কিন্তু সুফল মেলেনি। বরং মোজাম্মেল হক বলেছিলেন, বিএনপি ছেড়ে আসেন, শেখ মুজিবের মার্কা লাগিয়ে আসেন, তাহলে আপনার সার্টিফিকেট দিয়ে দেব।‘

আপডেট : ১৯ মার্চ ২০২৫, ০৮:১২ পিএম

১৯৭১ সালের ১৯ মার্চ গাজীপুরের জয়দেবপুরে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে ওঠে, যা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। সেদিনের লড়াইয়ে পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে আহত হন গাজীপুরের সিটি কর্পোরেশনের ২৪ নং ওয়ার্ড পাজুলিয়া গ্রামের আব্দুল আলী সরকার এর ছেলে ইউসুফ আলী সরকার। কিন্তু ৫৪ বছর পরও তিনি পাননি মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি। অভিযোগ রয়েছে, সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের দলীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট কারণে তার মুক্তিযোদ্ধার সনদ আটকে রাখা হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৯৭১ সালের ১৯ মার্চ  পূর্ব পাকিস্তানে উত্তেজনা ছিল চরমে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাঙালি সৈন্যদের নিরস্ত্র করার পরিকল্পনা নেয়। ১৯ মার্চ সকালে ব্রিগেডিয়ার জাহানজেবের নেতৃত্বে জয়দেবপুরের দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে নিরস্ত্র করতে আসে পাকিস্তানি বাহিনী। এই সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে স্থানীয় জনতা লাঠিসোঁটা, তীর-ধনুক নিয়ে রেলগেট এলাকায় ব্যারিকেড দেয়। সেনারা ব্যারিকেড সরাতে বললে জনতা তা প্রত্যাখ্যান করে। এরপর পাকিস্তানি সেনারা গুলি চালায় এতে শহীদ হন মনু খলিফা, লিয়াকত, ফুলমত, কানু মুন্সী। আহত হন সন্তোষ কুমার মজুমদার, শাজাহানসহ অনেকে।

ইউসুফ আলী জানান, ‘সকাল ১০টার দিকে জানতে পারি, পাকিস্তানি বাহিনী জয়দেবপুরের সমরাস্ত্র কারখানার মালামাল ঢাকায় নিয়ে যাচ্ছে। তখন আমরা অস্ত্র কারখানার শ্রমিক ও বিএমটিএফ-এর শ্রমিকরা মিছিল নিয়ে রেলগেট এলাকায় যাই। সেখানে রেলগাড়ি ও গাছপালা দিয়ে অবরোধ করি। পাকিস্তানি সেনারা রাস্তা ছাড়ার নির্দেশ দিলেও আমরা অনড় থাকি। এরপর ক্যাপ্টেন রিয়াজ ঘোষণা দেয়, ২১ বার মাটিতে আঘাতের পরও রাস্তা না ছাড়লে গুলি চালানো হবে। আমরা রাস্তা না ছাড়ায় গুলি শুরু হয়, প্রথম গুলিটিই আমার গায়ে লাগে। পরে বিএনপির নেতা নুরুল ইসলাম খান আমাকে হাসপাতালে নিতে অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করেন। আমার চাচাতো ভাই ও ভাগিনা জীবন বাজি রেখে আমাকে মির্জাপুর হাসপাতালে নিয়ে যায়।’

গাজীপুরের প্রথম প্রতিরোধে সাবেক মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের ভূমিকা জানতে চাইলে ইউসুফ আলী জানায়,  ‘১৯ মার্চের প্রতিরোধের সময় আ ক ম মোজাম্মেল হক সেখানে ছিলেন না। বরং তার বাবা তাকে সংগ্রামে যেতে বাধা দিয়েছিলেন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের বলেছিলেন,আমার ছেলে আন্দোলনে যাবে না, তোমরা তোমাদের মতো করো।’

তিনি জানান, পরবর্তীতে শোনা যায়, ‘মোজাম্মেল হক স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিপ্লবে অংশ নিয়েছিলেন। কিন্তু আমি সেই দাবির বিরোধিতা করায় এবং বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকায় আমার মুক্তিযোদ্ধার সনদ আটকে দেওয়া হয়। তবে গাজীপুরে প্রথম প্রতিরোধ মোজাম্মেল অংশগ্রহণ না করলেও শোনা গেছে পরবর্তী সময় ভারতের কমরেড ভবনে তিনি যুদ্ধ প্রশিক্ষণ নিতে গিয়েছিল।’ 

ইউসুফ আলী জানান, ’১৯ মার্চের ঘটনার পর ২৭ দিন মির্জাপুর হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম। পরে ভারতে গিয়ে অস্ত্র প্রশিক্ষণ নিই এবং যুদ্ধ করি। যুদ্ধের ৮ বছর পরও আমার কাছে থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল ছিল। আমার ফুপাতো ভাই আমাদের সেক্টর কমান্ডার ছিলেন। কিন্তু তারপরও আমার মুক্তিযোদ্ধার সনদ হয়নি, কারণ আমি বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত।’

তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘আমি একাধিকবার বিভিন্ন জায়গায় গিয়েছি সনদের জন্য, কিন্তু সুফল মেলেনি। বরং মোজাম্মেল হক বলেছিলেন, বিএনপি ছেড়ে আসেন, শেখ মুজিবের মার্কা লাগিয়ে আসেন, তাহলে আপনার সার্টিফিকেট দিয়ে দেব।‘

৫৪ বছর ধরে যুদ্ধের স্বীকৃতির অপেক্ষায় থাকা ইউসুফ আলী শেষ বয়সে একটাই দাবি করছেন ‘আমি শুধু চাই আমার মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি। যারা সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, তারা যেন রাজনীতির ঊর্ধ্বে গিয়ে তাদের প্রাপ্য সম্মান পান।’

ইউসুফ আলীর মতো অনেক মুক্তিযোদ্ধাই আজও স্বীকৃতি পাননি। রাজনীতির সংকীর্ণতা উপেক্ষা করে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের যথাযথ সম্মান প্রদানের দাবি জানিয়েছে সচেতন মহল।

Fj/br
আরও পড়ুন