বাংলাদেশ ব্যাংক তিন মাস পরপর খেলাপি ঋণের হিসাব দেয়। সেই অনুযায়ী চলতি বছরের জুন শেষে ব্যাংক খাতে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের প্রায় ৩০ শতাংশ। কিন্তু ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের এই হিসাব যথাযথ নয়। ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী হিসাব করলে দেশে প্রকৃত খেলাপি ঋণ এখন প্রায় ৭ লাখ কোটি টাকা। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরও খেলাপি ঋণের অঙ্ক লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে দেখা যায়।
বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, গত সরকারের সময় লুকানো খেলাপি ঋণ এখন বেরিয়ে আসায় ব্যাংক খাতে সার্বিকভাবে এর পরিমাণ তাদের হিসাবে সোয়া পাঁচ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন শেষে ব্যাংক খাতে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৫ লাখ ৩০ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা। তিন মাস আগে মার্চ শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৪ লাখ ২০ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা; যা ছিল মোট বিতরণ করা ঋণের ২৪ দশমিক ১৩ শতাংশ। ছয় মাস আগে গত বছরের ডিসেম্বরের শেষে ছিল ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা, যা ছিল মোট ঋণের ২০ দশমিক ২০ শতাংশ। এছাড়াও গত বছরের সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের অঙ্ক ছিল ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা। এক বছর আগে জুন শেষে ছিল ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা।
এই হিসাবে দেখা যাচ্ছে, তিন মাসের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১ লাখ ১০ হাজার ৯৪ কোটি টাকা। ছয় মাসে বেড়েছে ১ লাখ ৮৪ হাজার ৬৬৩ কোটি টাকা। নয় মাসে বেড়েছে ২ লাখ ৪৫ হাজার ৪৫১ কোটি টাকা। আর এক বছরে বেড়েছে ৩ লাখ ১৯ হাজার ৩৭ কোটি টাকা।
কিন্তু এর বাইরেও উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশের কারণে খেলাপি ঋণ দেখানো যাচ্ছে না আরও এক লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা।
বিভিন্ন ব্যাংকের এক হাজার ৮৬ জন ঋণগ্রহীতার ২৭ হাজার ৩০২টি ঋণের বিপরীতে বিপুল অঙ্কের এসব অনাদায়ী ঋণ নিয়মিত দেখাতে হচ্ছে। এসব ঋণগ্রহীতা নিয়মিত গ্রাহকদের মতো সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুরও বলেন, আদালতে মামলার কারণে আটকে থাকা ১ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা ঋণও খেলাপি ঋণ। এটাকে কোনোভাবেই নিয়মিত ঋণ বলা যায় না।
তিনি আরও বলেন, খেলাপিকে খেলাপিই বলা উচিত। কেউ আদালত থেকে স্থগিতাদেশ আনলেও তাকে খেলাপি দেখানো উচিত। আর এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংক, সরকার এবং বিচার বিভাগকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। তা না হলে আর্থিক খাত ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না।
ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী, কোনও ঋণ ছয় মাস মেয়াদোত্তীর্ণ হলে তা খেলাপি হিসেবে বিবেচিত হয়।
এক ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে খেলাপি হলে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নতুন ঋণ নিতে পারে না। খেলাপি থাকা অবস্থায় আমদানি-রফতানির জন্য এলসি খুলতে পারে না। ঋণখেলাপি ব্যক্তি ব্যাংকের পরিচালকও থাকতে পারেন না। এমনকি কোনো ধরনের নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন না।
এজন্য যেকোনো ঋণ বিতরণের আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঋণ তথ্য ব্যুরো (সিআইবি) থেকে যাচাই করতে হয়। তবে অনেকেই উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ নেওয়ার কারণে সিআইবিতে খেলাপি দেখানো হয় না। ফলে ঋণ পরিশোধ না করেও সব ধরনের সুবিধা পাচ্ছেন তারা।
বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঋণখেলাপিদের ঢালাও আইনি সুরক্ষা বন্ধের জন্য ব্যাংক কোম্পানি আইন এবং অর্থ ঋণ আদালত আইন সংশোধনের মাধ্যমে আরও কঠোর বিধান যুক্ত করার প্রস্তাব নিয়ে কাজ করছেন তারা। এজন্য বিভিন্ন ব্যাংকে উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশে কী পরিমাণ ঋণ আটকে আছে এবং ব্যাংকের রিপোর্টে দেখানো হচ্ছে এমন খেলাপি ঋণের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে।
সব মিলিয়ে গত জুন মাস পর্যন্ত ব্যাংক খাতে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৯৩ হাজার ৫৭৭ কোটি টাকা, যা ব্যাংক খাতের মোট বিতরণ করা ঋণের ৩৯ শতাংশের বেশি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশের কারণে ১ হাজার ৮৬ জনের ১ লাখ ৬৩ হাজার ১৫০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ নিয়মিত দেখানো হচ্ছে। এই তালিকায় থাকা প্রতিজনের কাছে গড় পাওনা ১৫০ কোটি টাকা। এর বাইরে দৃশ্যমান খেলাপি ঋণ ৫ লাখ ৩০ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংক তিন মাস পরপর খেলাপি ঋণের যে হিসাব দেয়, তা যথাযথ নয় বলে মন্তব্য করেছেন একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ মইনুল ইসলাম।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক এই অধ্যাপক বলেন, যারা আদালতে গেছে, তাদের অনেকেই ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারা অর্থ পাচার করে বিদেশে নিয়ে গেছে। ফলে শুধু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোরতায় কাজ হবে না। খেলাপিরা জানে, মামলাগুলো বছরের পর বছর ঝুলিয়ে রাখা যাবে। ঋণখেলাপির এই চক্র থেকে বের হতে হলে খেলাপি ঋণ ট্রাইব্যুনাল করতে হবে কিংবা সুপ্রিম কোর্টের সুনির্দিষ্ট বেঞ্চ গঠন করে এদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে।
ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের (এমটিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, উচ্চ আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নিয়ে নিয়মিত দেখানো আগের তুলনায় এখন কঠিন করা হয়েছে। আগের স্থগিতাদেশসহ হয়ত এই ধরনের ঋণের পরিমাণ বেড়েছে। এখন আর আগের মতো অনেক বেশি সময়ও দিচ্ছেন না আদালত। অনেক ক্ষেত্রে কিছু ডাউনপেমেন্টের শর্ত জুড়ে দেওয়া হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, আবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলোকে স্থগিতাদেশের কারণে নিয়মিত দেখানো ঋণের তথ্য জানানো হচ্ছে। এছাড়া অর্থ ঋণ আদালতের মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এখন ব্যাংকগুলোর জন্য বেঞ্চ ভাগ করে দেওয়া হচ্ছে। এভাবে চললে খেলাপি ঋণ সমস্যার সমাধান হবে।
উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশের জন্য আবেদন করতে হলে বকেয়া স্থিতির অন্তত ১০ শতাংশ দেওয়ার বিধান করা উচিত বলে মনে করেন এই ব্যাংকার।
ব্যাংকাররা বলছেন, ঋণখেলাপিদের অনেকেই সামান্য কিছু টাকা খরচ করে আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নিয়ে আসছে। বিশেষ করে বড় ঋণগ্রহীতারা এক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে। নিয়মিত দেখানো হলেও এসব ঋণের বিপরীতে ব্যাংকগুলোর আয় নেই। এরপরও আয় দেখিয়ে ব্যাংকগুলো লভ্যাংশ দিয়ে দিচ্ছে। আবার নিয়মিত দেখানোর সুযোগের কারণে অন্য ব্যাংক থেকে ঋণসহ বিভিন্ন সুবিধা নিতে খেলাপিদের বাধা নেই। ফলে স্থগিতাদেশ দিলেও এমন কোনো বিধান যুক্ত করতে হবে, যেন ব্যাংক ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।
আওয়ামী লীগ সরকারের সময় নীতি সহায়তার আড়ালে খেলাপি ঋণের তথ্য গোপন করার সুযোগ দিয়ে আসছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আবার বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বড় ঋণগ্রহীতারা ঋণসীমা বাড়িয়ে কিংবা আরেক নামে ঋণ সৃষ্টি করে দায় সমন্বয় দেখাত। সরকার পতনের পর এ ধরনের সুযোগ বন্ধ হয়েছে।
আগে মেয়াদি ঋণ অনাদায়ী থাকার ছয় মাস পর থেকে মেয়াদোত্তীর্ণ ধরা হতো। তবে গত মার্চ থেকে ঋণ পরিশোধের মেয়াদ পার হওয়ার পরদিন থেকেই মেয়াদোত্তীর্ণ ধরা হচ্ছে।
এছাড়া অনেক খাতের ব্যবসা-বাণিজ্য ভালো যাচ্ছে না। আবার অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠানের কর্ণধাররা জেলে বা পলাতক। ফলে কিছু প্রতিষ্ঠান এখন বন্ধ আছে, লোকসানে পড়েছে অনেকে। সব মিলিয়ে প্রত্যাশিতভাবে ব্যাংকগুলোর ঋণ আদায় হচ্ছে না। এসব কারণে খেলাপি ঋণ লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে বলে জানান ব্যাংকাররা।
গণঅভ্যুত্থানের পর গভর্নরের দায়িত্বে আসা আহসান মনসুর গত জুন মাসে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, খেলাপি ঋণের কোনো তথ্য আমরা লুকিয়ে রাখব না। সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছানোর পর এটা আদায় জোরদারের মাধ্যমে কমানো হবে।
খেলাপি ঋণের অঙ্ক বেড়ে যাওয়া নিয়ে তিনি বলেছিলেন, খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ করা হয়েছে। যে কারণে তা বাড়ছে। নতুন বিতরণ করা ঋণ যেন খেলাপি না হয় সেজন্য বিভিন্ন আইনি কঠোরতা আনার কথাও বলেছিলেন তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, সরকার পতনের আগেই আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণের শর্ত মানতে গিয়ে গত বছরের মার্চ থেকে কৌশলে খেলাপি ঋণ কম দেখানোর সুযোগ কমে এসেছে।
