ঈমান শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো ‘বিশ্বাস স্থাপন করা’। তবে ইসলামি পরিভাষায় ঈমান মানে অন্তরে বিশ্বাস, মুখে স্বীকৃতি এবং কর্মে বাস্তবায়নের সমন্বিত রূপ। কেবল মুখে বিশ্বাস প্রকাশ করলেই কেউ প্রকৃত মুমিন হয়ে যায় না, বরং অন্তরের গুণাবলী ও বাহ্যিক আচার-আচরণের মাধ্যমেই ঈমানের পূর্ণতা অর্জিত হয়। হাদিসে নবীজি (স.) প্রকৃত মুমিনের যেসব বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছেন, সেগুলোর আলোকে নিচে ছয়টি মৌলিক গুণ উপস্থাপন করা হলো-
১. অন্যের কল্যাণ কামনা
নবীজি (স.) বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত প্রকৃত মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না সে নিজের জন্য যা পছন্দ করে, তা তার ভাইয়ের জন্যও পছন্দ না করে।’ (বুখারি ১৩)
এই হাদিসটি ঈমানের এক গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভের দিকে ইঙ্গিত করে। একজন প্রকৃত মুমিন নিঃস্বার্থ ও মানবিক হয়। সে অন্যের কল্যাণে আনন্দ খুঁজে পায়। এটি এমন এক নৈতিকতার চূড়ান্ত পর্যায়, যা সমাজের ভিত্তি মজবুত করে।
২. প্রতিবেশীর প্রতি সুনজর রাখা
প্রতিবেশীর অধিকার ইসলামের একটি মৌলিক বিষয়। নবীজি (স.) এই অধিকারের গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে বলেন, ‘সে মুমিন নয়, যে নিজে তৃপ্তিভরে আহার করে আর তার প্রতিবেশী থাকে অনাহারে বা অর্ধাহারে।’ (আল-আদাবুল মুফরাদ: ১১২)
এই হাদিসটি পারস্পরিক সহমর্মিতা ও সংহতির এক শক্তিশালী বন্ধন তৈরি করে। প্রকৃত ঈমানদার সে-ই, যে নিজের আশপাশের মানুষের প্রয়োজনকে গুরুত্ব দেয়।
৩. আমানতদারি ও প্রতিশ্রুতি রক্ষা
নেতা থেকে শুরু করে একজন সাধারণ মানুষ পর্যন্ত একজন প্রকৃত মুমিনের বৈশিষ্ট্য হলো কথা ও কাজে বিশ্বস্ত হওয়া। নবীজি (স.) তাঁর প্রতিটি খুতবায় বলতেন, ‘তার ঈমান নেই, যার মধ্যে আমানতদারি নেই এবং যার প্রতিশ্রুতি রক্ষা নেই, তার দ্বীন নেই।’ (মুসনাদে আহমদ: ১২৩৮৩)। এই হাদিস থেকে বোঝা যায়, আমানতদারি ও প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা একজন মুমিনের ঈমানের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
৪. প্রতিবেশীকে অনিষ্ট থেকে নিরাপদ রাখা
রাসুল (স.) এই গুণটির ওপর এতটাই গুরুত্ব দিয়েছেন যে তিনি তিনবার শপথ করে বলেছেন, ‘আল্লাহর কসম, সে মুমিন নয়! আল্লাহর কসম, সে মুমিন নয়! আল্লাহর কসম, সে মুমিন নয়!’ সাহাবিরা জিজ্ঞেস করলেন, ‘সে কে, হে আল্লাহর রাসুল?’ তিনি বললেন, ‘যার অনিষ্ট থেকে তার প্রতিবেশী নিরাপদ নয়।’ (বুখারি: ৬০১৬)
এই হাদিসটি একজন মুমিনের আচরণের সর্বোচ্চ মানদণ্ড নির্ধারণ করে। তার আচরণ এমন হওয়া উচিত, যাতে তার দ্বারা কেউ ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, বিশেষ করে প্রতিবেশীরা।
৫. ভদ্রতা ও শালীনতা বজায় রাখা
একজন প্রকৃত মুমিন সর্বদা বিনয়ী, ভদ্র এবং মার্জিত ভাষায় কথা বলে। রাসুল (স.) বলেন, ‘মুমিন কখনো গালি-গালাজ করে না, অভিশাপ দেয় না, অশ্লীল কথাবার্তা বলে না এবং কটুভাষী হয় না।’ (তিরমিজি: ১৯৭৭)। এটি মানুষের সম্মান রক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। একজন মুমিন তার কথাবার্তার মাধ্যমে অন্যদের সম্মান করে এবং নিজের ব্যক্তিত্বের পরিচয় দেয়।
৬. আল্লাহ ও তাঁর রাসুলকে সর্বাধিক ভালোবাসা
ঈমানের মূল ভিত্তি হলো আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের প্রতি নিঃশর্ত প্রেম ও আনুগত্য। রাসুল (স.) বলেন, ‘সেই সত্তার কসম, যার হাতে আমার জীবন! তোমাদের কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত পূর্ণ মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত আমি তার কাছে তার পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি সবার চেয়ে অধিক প্রিয় না হই।’ (বুখারি: ১৪)। এই ভালোবাসা সব পার্থিব সম্পর্ক ও অনুভূতির ঊর্ধ্বে। এটিই একজন মুমিনকে আল্লাহর পথে চলতে এবং রাসুলের আদর্শ অনুসরণ করতে উদ্বুদ্ধ করে।
উল্লেখিত গুণাবলীগুলো থেকে এটি সুস্পষ্ট যে, ঈমান শুধু মুখের কথা নয়, বরং এটি আত্মিক বিশ্বাস, বুদ্ধিবৃত্তিক উপলব্ধি ও দৈনন্দিন আচরণের বাস্তব প্রতিফলন।
