ঢাকা
সোমবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৫, ২ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
ই-পেপার

আকবর হোসেনের উপন্যাসে সমাজচিত্র ॥ রকিবুল হাসান

আপডেট : ০৩ অক্টোবর ২০২৫, ০৩:৩৪ পিএম

ঔপন্যাসিক আকবর হোসেন (১৯১৭-১৯৮১) বর্তমানে বিস্মৃত এক কথাশিল্পী। অথচ গত শতকের পঞ্চাশ থেকে সত্তর তুমুল জনপ্রিয় কথাশিল্পী ছিলেন। তার প্রত্যেকটি উপন্যাস সেসময়ে পাঠকনন্দিত ছিল। তার ‘মেঘ বিজলী বাদল’ (১৯৬৮) তৃতীয় উপন্যাস। এ উপন্যাসের কাহিনির মধ্যে প্রেমের বিচিত্র আকৃতি সন্নিবিষ্ট। আধুনিক সমাজের কদর্যতার বহুমাত্রিকতার রূপায়ণ ঘটেছে। 

মূল কাহিনির পাশাপাশি বেশ কয়েকটি উপকাহিনি যুক্ত হয়েছে। ডাক্তার জামান সুন্দরী কুমারী সায়রার সঙ্গে প্রেমের খেলা খেলে ভোগ করেছেন তার সুঠাম সুন্দর কুমারী দেহলতা। যৌন জীবনাচরণে উদগ্র অস্থির জামান জীবন সঙ্গিনী করার লোভ দেখিয়ে তার দেহভোগ করে তাকে করেছে অন্তঃসত্ত্বা। অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার পর সামাজিক মর্যাদায় বাঁচার দাবি নিয়ে ছুটে আসে প্রেমিক জামানের কাছে। জামান তাকে প্রত্যাখ্যান এবং অস্বীকার করে নিজের সমস্ত কার্যকলাপ। দুর্ব্যবহারের শিকার হয় সায়রা। মান-সম্মান, লজ্জা এবং কলঙ্কিত হওয়ার ভয়ে সে আত্মহত্যা করে। মেডিক্যাল ছাত্রী রীনার সঙ্গেও রয়েছে ডাক্তার জামানের প্রেমের কাহিনি। বিয়ে করার আশ্বাস দিয়ে দীর্ঘদিন ভোগ করেছে তার কুমারী শরীর। একই ভাবে বিয়ে করার আশ্বাস দিয়ে ভোগ করেছেন নার্স মর্জিনার দেহ। মর্জিনা আপ্রাণ চেষ্টা করেও আটকাতে পারেননি তাকে সংসারে। মর্জিনার ভেতর অনেকটা সচেতনতা লক্ষ্য করা গেলেও নিজের দেহের শুচিতা রক্ষা করতে পারেনি নারীলোভী ডা. জামানের হাত থেকে। ফলে পরিস্থিতির কারণে ডা. জামানের ইচ্ছেমতো ভোগের সামগ্রীতে পরিণত হতে হয়েছে। অবশ্য শেষে জামানের বিশ্বাসঘাতকতা করা দেখে নিজেকে তার কাছ থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করেছে। দীপার স্বামী ফারুককে ডাক্তার জামান চিকিৎসা করার নামে হত্যা করে সবার চোখ ফাঁকি দিতে পারলেও মর্জিনার চোখকে ফাঁকি দিতে পারেনি। ডা. জামান দীপার প্রতি দুর্বল হলে মর্জিনা ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে পড়ে।

মর্জিনা ও জামানের কাহিনি বেশ সজীব। ডা. জামান-ডা. মিস মৌরির প্রেমের কাহিনিটিও বেশ চমৎকার। মৌরি দেহের পবিত্রতা ও সামাজিক রীতির প্রতি সচেতন। অসাধারণ সুন্দরী। তার অঙ্গসৌষ্ঠব যে কোনো পুরুষকে মুগ্ধ করার জন্য যথেষ্ট। ডাক্তার জামান উদগ্র কামনার যন্ত্রণায় অস্থির লালসা জিহ্বা তার দিকে প্রসার করে দেহ ভোগে ব্যর্থ হয়। কারণ মৌরি সামাজিক বন্ধনের প্রতি ছিলেন শ্রদ্ধাশীল। তাই সামাজিক রীতিবিরোধী অবৈধ দৈহিক মিলনে লিপ্ত হওয়ার নগ্ন চেষ্টা করলে তিনি জানিয়েছেন আগে বিয়েটা হোক। আর জামান ভেবেছিলেন সায়রা, রীনা, মর্জিনার মতোই হয়ত মৌরিও সহজলভ্যা। কিন্তু তার সে ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়। মৌরি জানতেন ডাক্তার জামান নারীলোভী। তবু তিনি তাকে ভালোবেসে আজন্ম কুমারী থেকেছেন। অর্থবিত্ত বিলিয়ে নিজ হাতে দরিদ্র ছেলেমেয়ের জন্য গড়ে তুলেছেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। মৌরি সামাজিক বন্ধনের ভেতর দিয়ে মর্যাদাপূর্ণ সম্পর্কের মাধ্যমে নিজেকে বিলিয়ে দিতে চেয়েছিলেন ডা. জামানের বাহুতলে এবং এ সিদ্ধান্তে শেষ অবধি তিনি অটল ছিলেন। নারীলোভী জামান বহু নারীর দেহভোগ করলেও মৌরির ক্ষেত্রে হয়েছেন দারুণভাবে ব্যর্থ। ডা. জামান-মিস মৌরির প্রেমের কাহিনিটিও বেশ রোমান্টিকতাপূর্ণ। তবে সেই রোমান্টিকতার ভেতরও মৌরি আত্মসচেতন এবং ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন একজন নারী। এই উপন্যাসের সবচেয়ে জটিল উপকাহিনি দীপা-ফারুক-জামানের কাহিনি। 

মূল কাহিনি ও মূল কাহিনিকে ঘিরে যে সব উপকাহিনি নির্মিত হয়েছে তার মূলে প্রধান চরিত্র জামান। একজন উচ্চ শিক্ষিত মানুষ যে কত অসভ্য, কত বড় জানোয়ার, নারীলোভী এবং কত নিষ্ঠুর হলে খুন করতে পারে পবিত্র চিকিৎসার নামে ফারুকের মতো একজন প্রতিভাবান শিল্পী এবং সাহিত্যিককে। তিনি কত সহজ ও স্বাভাবিকভাবে ভুলে যেতে পারেন বিবাহিতা স্ত্রী এবং ঔরসজাত সন্তানদের। সেই সঙ্গে কী নির্মমভাবে আঘাত করতে পারেন পিতৃতুল্য বৃদ্ধ খলিল সাহেবকে—যিনি জমি-জমা বিক্রি করে পুত্র আমজাদের বিরোধিতা সত্ত্বেও তাকে লেখাপড়া শিখিয়েছিলেন। কী অভিনয় কৌশলে মিথ্যা আশ্বাসের বাণী ছড়িয়ে সায়রা, রীনা, মর্জিনাসহ বিদেশি অনেক নারীর দেহ সুধা পান করেছিলেন। ডা. জামান নামক এই মানুষটিকে লম্পট বললেও খুব বেশি বলা হয় না। মূল কাহিনির প্রয়োজনেই উপকাহিনিগুলি জন্মলাভ করেছে। ভালোবাসার নামে সমাজের উচ্চশিক্ষিত মানুষগুলো কিভাবে নারীদের ব্যবহার করে ঠেলে দেয় মৃত্যুর মুখে এবং মিস মৌরি সেই নারীলোভী ডাক্তারকে ভালোবেসে ব্যর্থতায় কীভাবে বেছে নেয় একাকী জীবন আর সে জীবন কীভাবে বিলিয়ে দেয় পথে পড়ে থাকা দরিদ্র সন্তানদের জন্যে, তারই এক মধুর কাহিনি মেঘ বিজলী বাদল। মেঘ বিজলী বাদলকে এক কথায় প্রেমের উপন্যাস বলে আখ্যায়িত করা যায়। কাহিনির ওপর ভিত্তি করে গ্রন্থটির নামকরণ যথার্থ হয়েছে কি না সে বিষয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে, দুর্যোগের মেঘ উঠেছিল খলিল সাহেবের পরিবারে দুঃখিনী রাবেয়ার জীবনে আর সে জীবনে যে বিজলী চমকাচ্ছিল তা ছিল খুবই ভয়ঙ্কর। চিরকালের কান্নার প্রতীক রাবেয়ার জীবনে দুর্যোগের যে মেঘ উঠেছিল আর সে মেঘে রোষের বহিঃপ্রকাশ স্বরূপ যে বিজলী চমকাচ্ছিল সে বিজলী ছিল ডাক্তার জামানের জীবনে সায়রা, রীনা, মর্জিনা, মৌরি আর দীপাসহ বিদেশি অনেক নারী। যাদের সঙ্গে ছিল ডা. জামানের যৌনাক্ষিপ্ত সম্পর্ক- যাদের মোহে তিনি ভুলে গিয়েছিলেন স্ত্রী রাবেয়া আর ঔরসজাত সন্তান দুটিকে পর্যন্ত। একদিন রাবেয়ার জীবন থেকে সে দুর্যোগের মেঘ কেটে যায়। দীপার কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়ে জামানের মন থেকে বিরূপ ভাবনার জন্ম নেয় সুন্দরী নারীদের দেহ ভোগের তৃষ্ণা। নারী বিমুখ হয়ে পড়েন তিনি। কেটে যায় ভয়ঙ্কর বিজলী স্বরূপ নারী মোহ। ঘটনাক্রমে জীবনের মেঘ বিজলী শেষে নেমে আসে শান্তির সুধাস্বরূপ বাদল বর্ষিত হওয়ার মতো রাবেয়া-জামান দুজন দুজনের জীবনে, ফিরে পায় তারা সন্তানদের। জীবনের কষ্টি-পাথরে যাচাই হয়ে জীবনের অহমিকা দূর হয়ে যায়। যবনিকাপাত ঘটে সমস্ত অসুন্দরের আর এ ছিল রাবেয়ার জীবনে অনেক ভয়ঙ্কর আর দুর্যোগের মেঘ আর বিজলী চমকানো শেষে শান্তি ও কল্যাণময় বৃষ্টির মতো। সুতরাং উপরিউক্ত আলোচনা থেকে গ্রন্থটির নাম ‘মেঘ বিজলী বাদল’ যে অর্থময় এবং যথার্থ তা প্রতীয়মান হয়। 

‘মেঘ বিজলী বাদল’ উপন্যাসে প্রধান পুরুষ চরিত্র ডা. জামান। ডা. জামান উচ্চশিক্ষিত। পদবিতে প্রফেসর, পেশায় ডাক্তার। অসহায় দরিদ্র্য এবং মাতৃহীন জামান শ্বশুর খলিল সাহেবের অর্থ এবং প্রচেষ্টায় উচ্চ শিক্ষা লাভ করেন। প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর বদলে যায় চরিত্রের ধারা। বিদেশে অধ্যয়নরত অবস্থায় মিস পামেলা নর্ডান, নীনাসুশান, মারলিটা প্যাটেল প্রমুখ সুন্দরী নারীর একান্ত সান্নিধ্য লাভের পর তার চিন্তার মাঝে ঘটে বিরাট পরিবর্তন। নারীদের ইচ্ছেমতো ভোগ করার এক অতৃপ্ত উন্মত্ত কামনা তার ভেতর বিবেক বর্জিত হিংস্র পশুর মতো উপস্থিত। ছাত্রী, নার্স, মহিলা ডাক্তার এমনকি পরস্ত্রীও তার কামনার বাহুতলে হয়েছে পিষ্টিত। নারী মোহে ডাক্তার অন্ধ। ভদ্রতার মুখোশের আড়ালে কামনাক্ষিপ্ত এক নগ্ন পুরুষ তিনি। মানবিকতা এবং সভ্যতার পরিচয় বলে কোনো বোধ তার ভেতর আছে বলে মনে হয় না। শহরের অসংখ্য সুন্দরীর দেহ সৌন্দর্যে মোহাবিষ্ট তিনি। রীনা ছিল তারই ছাত্রী অথচ তাকেও তিনি নির্লজ্জভাবে তার চেম্বারে দীর্ঘদিন ভোগ করেছেন— আর দুচার পয়সা দিয়ে হাতে রেখেছেন দারোয়ানদের। নার্স মর্জিনাকেও তিনি বাদ দেননি। আয়ত্তে আনতে পারেননি মৌরিকে। কামনাক্ষিপ্ততার কারণে চরমভাবে অপমানিত এবং প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন দীপার কাছে। মানুষ কতটা নিষ্ঠুর, কতটা বিবেক বর্জিত হলে একটা সুন্দর জীবনে দুঃখের কালো মেঘ সৃষ্টি করতে পারে— খুন করতে পারে পবিত্র চিকিৎসার নামে একজন প্রকৃত মানুষকে যিনি একজন সত্যিকার শিল্পী এবং সাহিত্যিক। ডাক্তার জামান ছিলেন তাই-ই যিনি দীপাকে পাওয়ার আশায় খুন করেছিলেন ফারুকের মতো একজন প্রকৃত শিল্পী এবং সাহিত্যিক-জাতির এক শ্রেষ্ঠ প্রতিভাকে আর দুঃখের কালো মেঘ সৃষ্টি করেছিলেন দীপার জীবনে। ‘সহস্র কুসুমের মধুলোভী মৌমাছি’ জামানের পক্ষে এটাই স্বাভাবিক। 

ডা. জামান ছিলেন অকৃতজ্ঞ। খলিল সাহেব তার কাছে গেলে তিনি যে দুর্ব্যবহার করেছেন তা কোনো সভ্য মানুষ করতে পারে না। তার এ চরম প্রতিষ্ঠার মূলে সমস্ত দান নিঃসন্দেহে এই খলিল সাহেবেরই। অথচ তিনি ভুলে গেলেন সেই অতীত—অত্যন্ত অমানবিক ব্যবহার করে কুকুরের মতো তাড়িয়ে দিলেন পিতৃতুল্য মহানুভব এই বৃদ্ধ মানুষটিকে। যে মানুষটি সেই আঘাত সহ্য করতে না পেরে মারা গেছেন গাড়ি চাপায় সেই শহরেই। এই হচ্ছে প্রফেসর জামানের ব্যবহার। তারই গাড়িতে দুর্ঘটনা কবলিত স্ত্রী রাবেয়াকে হাসপাতালে চিনতে পেরে চিকিৎসার সুব্যবস্থা করে সমস্ত অহমিকা চুরমার করে সমস্ত অসুন্দরের যবনিকাপাত ঘটিয়ে গ্রহণ করেন তাকে— সেই সঙ্গে পুত্র আমীন আর শামীমকে। জামান চরিত্র অঙ্কনের ভেতর দিয়ে মুখোশধারী শিক্ষিত ভদ্র মানুষদের ভেতরের হিংস্র কুকুরটাকে বের করে সবার সম্মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। এখানে লেখকের এ প্রচেষ্টা সফলতা লাভ করেছে জামান চরিত্রকে অত্যন্ত বাস্তব সম্মত ভাবে অঙ্কনের ফলে। নষ্ট মানুষের চিত্র হিসেবে প্রফেসর জামান আকবর হোসেনের এক দুর্লভ এবং সাহসী সৃষ্টি। 

কাহিনির পরিণতিতে লেখকের কৃতিত্ব আরো বেশি উজ্জ্বল হতো যদি তিনি ডা. জামানকে আরো আগ থেকেই সংশোধন করিয়ে আনতে পারতেন। তবু উপন্যাসটি সার্থকতার পর্যায়ে উন্নীত না হলেও একটি চমৎকার উপন্যাসে পরিণত হয়েছে ভাষার কাব্যময়তায়, যা পাঠকের দৃষ্টি কেড়ে নেওয়ার জন্যে যথেষ্ট।

 

আরও পড়ুন