কখনও কখনও মানুষের প্রকৃতিকে জয় করার প্রচেষ্টা অপ্রত্যাশিত পরিণতি বয়ে আনে। বৃহৎ বাঁধ নির্মাণ, তেল-গ্যাস উত্তোলন, এমনকি পারমাণবিক পরীক্ষা এসব মানবিক কর্মকাণ্ড কি সত্যিই ভূমিকম্পের জন্ম দিতে পারে। এই প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে হ্যাঁ এবং এর পেছনে রয়েছে চাঞ্চল্যকর বৈজ্ঞানিক সত্য।
ভূবিজ্ঞানীরা এই ঘটনাকে 'ইনডিউসড সিসমিসিটি' বা মানবসৃষ্ট ভূকম্পন নামে চিহ্নিত করেছেন। প্রাকৃতিক ভূমিকম্প যেমন টেকটনিক প্লেটের সংঘর্ষে ঘটে, মানুষের কর্মকাণ্ডও পৃথিবীর ভূ-ত্বকে চাপ সৃষ্টি করে এবং বিদ্যমান ফাটলরেখা বা ফল্টগুলোকে সক্রিয় করে তুলতে পারে।
বিজ্ঞানীদের মতে, মানবসৃষ্ট ভূমিকম্পের প্রধান কারণগুলো হলো-
বর্জ্য পানি ইনজেকশন: তেল ও গ্যাস উত্তোলন শিল্পে উৎপাদিত লবণাক্ত পানি পৃথিবীর গভীরে ইনজেকশন দেওয়া হয়। এই পানি শিলাস্তরের ফাটলে প্রবেশ করে চাপ বৃদ্ধি করে এবং ফল্ট লাইনে পিচ্ছিলকারক হিসেবে কাজ করে, যার ফলে ভূমিকম্প সংঘটিত হয়।
জলাধার-প্ররোচিত ভূকম্পন: বৃহৎ বাঁধের পেছনে বিশাল জলাধার সৃষ্টি হলে পানির ওজন এবং চাপ ভূ-ত্বকের ওপর প্রভাব ফেলে। পানি ভূগর্ভে প্রবেশ করে ছিদ্রের চাপ বৃদ্ধি করে, যা বিদ্যমান ফল্টরেখাগুলোকে সক্রিয় করে তোলে।
হাইড্রোলিক ফ্র্যাকচারিং: শেল গ্যাস উত্তোলনের জন্য ব্যবহৃত ফ্র্যাকিং প্রক্রিয়া সাধারণত ছোট ভূকম্পন সৃষ্টি করে, তবে এটি সরাসরি বড় ভূমিকম্পের কারণ নয়। বরং ফ্র্যাকিং থেকে উৎপন্ন বর্জ্য পানির নিষ্কাশনই প্রধান সমস্যা।
পারমাণবিক বিস্ফোরণ: ভূগর্ভস্থ পারমাণবিক পরীক্ষা তাৎক্ষণিক ভূকম্পন সৃষ্টি করে এবং কখনও কখনও আফটারশক তৈরি করতে পারে, তবে এর প্রভাব সীমিত এলাকায় সীমাবদ্ধ থাকে।
আমেরিকার ওকলাহোমা: একটি বাস্তব উদাহরণ
মধ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভূমিকম্পের হার নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৭৩-২০০৮ সালের মধ্যে ওকলাহোমায় বছরে গড়ে ২৪টি ভূমিকম্প রেকর্ড করা হতো। কিন্তু ২০০৯-২০১৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় বছরে গড়ে ১৯৩টিতে, এবং শুধুমাত্র ২০১৪ সালেই ঘটে ৬৮৮টি ভূমিকম্প।
আমেরিকান ভূতাত্ত্বিক সমীক্ষা (ইউএসজিএস) নিশ্চিত করেছে যে তেল ও গ্যাস উৎপাদনের উপজাত হিসেবে সৃষ্ট বর্জ্য পানির নিষ্কাশনই এই বৃদ্ধির প্রধান কারণ। গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১৪-২০১৭ সাল পর্যন্ত ওকলাহোমায় ভূমিকম্পের হার ক্যালিফোর্নিয়াকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল।
মজার ব্যাপার হলো, ফ্র্যাকিং প্রক্রিয়া নিজে সরাসরি এই ভূমিকম্পের জন্য দায়ী নয়। ওকলাহোমায় মাত্র ২ শতাংশ ভূমিকম্প ফ্র্যাকিংয়ের সাথে সম্পর্কিত। বাকি ৯৮ শতাংশই ঘটেছে বর্জ্য পানি নিষ্কাশন কূপের কারণে।
বাঁধ এবং ভূমিকম্প: ভারতের কোয়না দুর্ঘটনা
১৯৬৭ সালের ১১ ডিসেম্বর মহারাষ্ট্রের কোয়না নগরে সংঘটিত হয় ৬.৩ মাত্রার এক ভয়াবহ ভূমিকম্প। প্রায় ২০০ জন মারা যায় এবং ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এই ঘটনা ছিল বাঁধ-প্ররোচিত ভূমিকম্পের অন্যতম প্রমাণিত উদাহরণ।
কোয়না বাঁধের জলাধার পূর্ণ হওয়ার পরই এই অঞ্চলে ভূকম্পন কার্যকলাপ শুরু হয়। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন যে জলাধারের পানির উচ্চতা এবং ভূমিকম্পের মধ্যে সুস্পষ্ট সম্পর্ক রয়েছে। পানির চাপ ভূগর্ভের ফাটলে প্রবেশ করে, ছিদ্র চাপ বৃদ্ধি করে এবং পূর্ব-বিদ্যমান ফল্টরেখায় চাপ সৃষ্টি করে।
আজও, ছয় দশক পরে, কোয়না-ওয়ার্না অঞ্চলে ভূকম্পন কার্যকলাপ অব্যাহত রয়েছে। এটি ভারত সরকারের জন্য গবেষণার একটি প্রধান কেন্দ্র হয়ে উঠেছে, যেখানে ৬-৮ কিলোমিটার গভীর তুরপুনের মাধ্যমে ভূমিকম্পের প্রকৃতি বোঝার চেষ্টা চলছে।
১৯৪৫ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী ২,০০০-এরও বেশি পারমাণবিক পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে, যার প্রায় ৭৫ শতাংশই ছিল ভূগর্ভস্থ। এই বিস্ফোরণগুলো তাৎক্ষণিক ভূকম্পন তরঙ্গ সৃষ্টি করে এবং কখনও কখনও আফটারশকও ঘটায়।
১৯৭১ সালে আলাস্কার অ্যালিউশিয়ান দ্বীপপুঞ্জে আমেরিকার পরিচালিত সবচেয়ে বড় ভূগর্ভস্থ পরমাণু পরীক্ষা ‘ক্যানিকিন’ কোড-নামে পরিচিত ছিল। এই ৫ মেগাটন শক্তির বিস্ফোরণ ৬.৯ মাত্রার ভূমিকম্পের সমতুল্য শক্তি নির্গত করেছিল।
তবে ইউএসজিএসের গবেষণা অনুযায়ী, পারমাণবিক পরীক্ষা বিস্ফোরণ স্থল থেকে কয়েক দশক কিলোমিটার দূরে বড় ভূমিকম্প সৃষ্টি করতে পারে না। ১৯৬৯ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে নেভাডা টেস্ট সাইটের বৃহৎ পরমাণু পরীক্ষা এবং ক্যালিফোর্নিয়ার ভূমিকম্পের মধ্যে কোনো কার্যকারণ সম্পর্ক নেই।
২০১৭ সালে উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক পরীক্ষা ৬.৩ মাত্রার ভূকম্পন সৃষ্টি করেছিল। আট মিনিট পরে ৪.১ মাত্রার আরেকটি ঘটনা রেকর্ড করা হয়, যা সম্ভবত টানেল ধসের সাথে সম্পর্কিত ছিল।
কত মাত্রার ভূমিকম্প সম্ভব?
একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো মানবসৃষ্ট ভূমিকম্প কতটা বড় হতে পারে। এমআইটি এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন যে ইনজেকশন-প্ররোচিত ভূমিকম্পের আকার শুধুমাত্র ইনজেকশন করা তরলের পরিমাণের ওপর নির্ভর করে না, বরং নিকটবর্তী ফল্টে সঞ্চিত টেকটনিক শক্তির ওপরও নির্ভরশীল।
ইতিহাসে উজবেকিস্তানে তেল উৎপাদনের ফলে ৭ মাত্রার বেশি ভূমিকম্প ঘটেছে বলে জানা গেছে। তবে বেশিরভাগ মানবসৃষ্ট ভূমিকম্প অপেক্ষাকৃত ছোট হয় সাধারণত ৩-৫ মাত্রার মধ্যে।
আমেরিকায় হাইড্রোলিক ফ্র্যাকচারিংয়ের মাধ্যমে সৃষ্ট সবচেয়ে বড় ভূমিকম্প ছিল ২০১৮ সালে টেক্সাসে ৪.০ মাত্রার। অন্যদিকে বর্জ্য পানি নিষ্কাশনের কারণে ওকলাহোমায় ২০১৬ সালে ৫.১ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল।
২০০৮ সালের সিচুয়ান ভূমিকম্প
চীনের সিচুয়ান প্রদেশে ২০০৮ সালে সংঘটিত ভয়াবহ ভূমিকম্পে প্রায় ৬৮,০০০ মানুষ মারা যায়। এই দুর্ঘটনার পর বিজ্ঞানীরা জিপিংপু বাঁধের সম্ভাব্য ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।
২০০৪ সালে জলাধার প্রথম পূর্ণ হওয়ার পর এক বছরের মধ্যে ৭৩০টি ছোট ভূমিকম্প রেকর্ড করা হয়েছিল। তবে বিজ্ঞানীদের মতে, বাঁধ এবং বড় ভূমিকম্পের মধ্যে নিশ্চিত সংযোগ প্রমাণ করতে আরও গবেষণা প্রয়োজন।
বাঁধ কি সরাসরি ভূমিকম্প সৃষ্টি করে
একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বুঝতে হবে, বাঁধ বা তেল-গ্যাস কার্যক্রম সম্পূর্ণ নতুন ভূমিকম্প ‘সৃষ্টি’ করে না বরং এগুলো এমন এলাকায় ভূকম্পন ত্বরান্বিত করে যেখানে ইতিমধ্যে টেকটনিক চাপ জমা রয়েছে। অর্থাৎ যে ভূমিকম্প হয়তো স্বাভাবিকভাবে ভবিষ্যতে কোনো এক সময় ঘটত, সেটি মানুষের কর্মকাণ্ডের ফলে আগে ঘটে যাচ্ছে।
গবেষকরা বলছেন, ১০০ মিটারের বেশি উচ্চতার বাঁধগুলোতে জলাধার-প্ররোচিত ভূকম্পনের ঝুঁকি বিবেচনা করা উচিত। তবে সব বড় বাঁধে এই সমস্যা দেখা যায় না। ভারতের ভাকরা, বিয়াস, পং, রামগঙ্গা এবং পাকিস্তানের তারবেলা বাঁধে উল্লেখযোগ্য জলাধার-প্ররোচিত ভূকম্পন রেকর্ড করা হয়নি।
কীভাবে ঝুঁকি কমানো যায়
মানবসৃষ্ট ভূমিকম্পের ঝুঁকি কমাতে বিজ্ঞানীরা নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন করছেন। এমআইটির গবেষকরা একটি মডেল তৈরি
করেছেন যা বর্জ্য পানি ইনজেকশনের হার নিয়ন্ত্রণ করে ভূমিকম্পের ঝুঁকি কমাতে পারে।
তাদের গবেষণা ইতালির দক্ষিণাঞ্চলীয় তেলক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়েছে, যেখানে ইঞ্জেকশন কূপ ছোট ভূকম্পন সৃষ্টি করছিল। সঠিক পরিচালনার মাধ্যমে ভূকম্পনের সংখ্যা এবং মাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো সম্ভব বলে প্রমাণিত হয়েছে।
আমেরিকায় ৪০,০০০ তেল ও গ্যাস বর্জ্য নিষ্কাশন কূপের মধ্যে মাত্র একটি ছোট অংশই উদ্বেগজনক ভূমিকম্প সৃষ্টি করে। যথাযথ পর্যবেক্ষণ এবং নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে এই ঝুঁকি আরও কমানো সম্ভব।
কার্বন সিকোয়েস্ট্রেশন
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় কার্বন ডাই অক্সাইড ভূগর্ভে সংরক্ষণের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। কিন্তু এই প্রক্রিয়াও সম্ভাব্যভাবে ভূমিকম্প সৃষ্টি করতে পারে। তাই গবেষকরা বলছেন, কার্বন সিকোয়েস্ট্রেশন নিরাপদে সম্পন্ন করতে হলে ভূতাত্ত্বিক জরিপ এবং সতর্ক পরিচালনা অপরিহার্য।
মানুষ যে ভূমিকম্প সৃষ্টি করতে পারে তা এখন প্রমাণিত সত্য। তবে এটি কোনো ষড়যন্ত্র তত্ত্ব নয়, বরং ভূবিজ্ঞানের জটিল সত্য। মানুষের কর্মকাণ্ড পৃথিবীর ভূ-ত্বকে বিদ্যমান চাপকে মুক্ত করে দেয়, যার ফলে ভূমিকম্প ঘটে।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এই সমস্যা সম্পর্কে সচেতন হওয়া এবং প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ নেওয়া। বাঁধ নির্মাণের আগে ভূতাত্ত্বিক সমীক্ষা, তেল-গ্যাস শিল্পে বর্জ্য পানি নিষ্কাশনের সতর্ক পরিচালনা এবং নিয়মিত পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে ঝুঁকি কমানো সম্ভব।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে আমরা এখন ভালোভাবে বুঝতে পারছি কীভাবে মানুষের কর্মকাণ্ড পৃথিবীকে প্রভাবিত করে। এই জ্ঞান ব্যবহার করে আমাদের উচিত আরও দায়িত্বশীল এবং টেকসই উন্নয়ন পথ বেছে নেওয়া।
মাধবদী কীভাবে শক্তিশালী ভূমিকম্পের কেন্দ্রে পরিণত হলো
দিনে ১৬০০ ভূমিকম্প, ভয়ংকর কোন সেই দেশ
কেন কিছু মানুষ ভূমিকম্প টের পান না
ভূমিকম্প নিয়ে ১০টি বিস্ময়কর তথ্য