দেশের তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্যে ভুল নগরদর্শনকে দায়ী করেছেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)।
মঙ্গলবার (৩০ এপ্রিল) ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনি মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্যে ভুল নগরদর্শনের বিষয়টি তুলে ধরে পরিবেশবাদী এ সংগঠন।
সংবাদ সম্মেলনে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সহ-সভাপতি স্থপতি ইকবাল হাবিব।
তিনি বলেন, বর্তমানে নগরীগুলোতে তাপমাত্রা অনুভবের তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে, অর্থাৎ তাপমাত্রা বৃদ্ধির চেয়ে অনুভবের মাত্রা বেড়েছে। পরিবেশ ও প্রতিবেশের সাথে সহনশীল সহমর্মিতায় সহাবস্থানের মানসিকতার প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ আচরণও তীব্রভাবে বেড়েছে।
পাশাপাশি, ধনী-দরিদ্র বা সামর্থ্যবান-অসামর্থ্যবানদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান ব্যবধানের তীব্রতার প্রতিফলনই হচ্ছে এই অনুভবের প্রখরতা বৃদ্ধি। ফলে জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশগত অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে, আর প্রকারান্তরে এভাবেই অর্ধবিকলাঙ্গ একটি প্রজন্ম তৈরির যন্ত্রে পরিণত হয়েছে আমাদের নগর ও নগরায়ণ।
স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, দেশের নগরীগুলোতে তাপপ্রবাহ অনুভবের এই তীব্রতা বৃদ্ধির অন্যতম মূল কারণ হলো ভুল নগরদর্শন (Urbanism)। ৯০' দশকের পর নগরীগুলোতে অপরিকল্পিত, মানববিচ্ছিন্ন এবং পরিবেশবৈরী কর্মধারার মধ্য দিয়ে দ্রুতগতির নগরায়ণের ধারার যে বিকাশ, আজকের এই নগরীগুলোর অভিঘাতসমূহ তারই প্রকাশ।
তিনি বলেন,জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশ বরাবরই সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ও ঝুঁকির তালিকায় অন্যতম। পাশাপাশি বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত 'এল নিনো'র প্রভাব, বাংলাদেশে চরমভাবাপন্ন পরিবেশ ও আবহাওয়ার সৃষ্টি করছে। এর ফলে ষড়ঋতুর এই দেশে ঋতু পরিবর্তনে অসঙ্গতি দেখা দিচ্ছে। ফলে দক্ষিণ দিকে থেকে আগত মৌসুমী বায়ুর দ্রুত আগমন ঘটছে আবার অপরদিকে উত্তর দিক থেকে আগত আন্তঃদেশীয় দূষিত ও উষ্ণ বায়ুর প্রবেশ ঘটছে দেশীয় আবহাওয়ায়।
এছাড়াও নদীর উপর বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ এবং নদী শাসন ও খনন ব্যবস্থাপনার অভাবে এই দেশের নদীগুলোও শুকিয়ে যাচ্ছে। এভাবে উত্তপ্তভার পরিধি বাড়ছে, তাপের মাত্রা সীমাহীন না হলেও তীব্র তাপপ্রবাহ অনুভূত হচ্ছে।
তিনি বলেন, ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা, পুঁজি প্রদর্শন মানসিকতা - পাশাপাশি বিদেশভাবাপন্নতা তথা অনুকরণপ্রিয়তার মাধ্যমে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থামুখিতা' এই অবস্থা সৃষ্টিতে কার্যত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
উদ্ভূত তাপদাহ সমস্যা থেকে একটি বিশেষ সামর্থ্যবান গোষ্ঠীর নিজেদেরকে অবমুক্ত রাখার যে নগর মানসিকতা তৈরি, তারই ফল স্বরূপ যথেচ্ছভাবে শীতাতপ নিয়ন্ত্রন ব্যবস্থা নির্ভরতার মাধ্যমে জ্বালানী চাহিদার উপর প্রচণ্ড চাপও তৈরি করে চলেছে। ফলে, অভ্যন্তরীণ পরিবেশকে কাঙ্খিত নিয়ন্ত্রিত তাপমাত্রায় বজায় রাখার স্বার্থে 'অতিরিক্ত তাপমাত্রা" প্রতিবেশে ছড়িয়ে দেয়ার অবিরত অন্যায় কার্যক্রম চলছে।
পরিণামস্বরূপ, প্রতিবেশী হিসেবে বসবাসরত অসামর্থ্যবান বিশাল জনগোষ্ঠীর দিকে প্রায় ৬ থেকে ১০ ডিগ্রি অতিরিক্ত তাপ বহমান হওয়ার কারণে 'উত্তপ্ততার অনুভব' তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। সমাজের বিত্তশালী সামর্থ্যবান আর সাধারণ্যের মধ্যে দূরত্ব এবং অসমতা যত বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাপপ্রবাহের তীব্রতার অনুভবের পার্থক্যও তাই স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হচ্ছে।
তিনি বলেন, ঢাকা মহানগরীতে অনুমোদনহীন ভবনের সংখ্যাই ৯৪ শতাংশেরও বেশি, এর মধ্যে অনুমোদন নেয়ার পর ব্যত্যয়কারী বা পুরোপুরি আইন লঙ্ঘনকারীও রয়েছে। ফলে, বাতাসের আনুভূমিক চলাচল সড়ক করিডোরের বাইরে নেই বললেই চলে। এভাবে ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য নগরীগুলোতে বিভিন্ন এলাকাসমূহ উত্তপ্ত দ্বীপের মতো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দ্বীপ বা 'হিট আইল্যান্ড' এ রূপান্তরিত হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে তীব্র তাপপ্রবাহ সংক্রান্ত বিপর্যয় রোধ এবং নগরীর প্রাকৃতিক পরিবেশ ও প্রতিবেশ বজায় রাখার লক্ষে ৭ দফা দাবি তুলে ধরা হয়। দাবিগুলো হচ্ছে:
১. বন ও বনভূমি সুরক্ষায় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়/ অধিদপ্তর/ কর্তৃপক্ষের জবাবদিহিতামূলক ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি নিয়ন্ত্রণ, প্রণোদনা ও আইনভঙ্গকারীদের যথাযথ শাস্তির ব্যবস্থা করা।
২. সিটি কর্পোরেশন এবং সড়ক ব্যবস্থাপনার সাথে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো নির্বিচারে বৃক্ষ নিধনের মাধ্যমে পথভ্রষ্ট 'সম্প্রসারণ উন্নয়নে'র নামে বসবাসযোগ্য নগর পরিবেশ ধ্বংসে যেভাবে সচেষ্ট, তা থেকে তাদেরকে সম্পূর্ণ নিবৃত করে কার্যকর 'সবুজায়ন নীতিমালা'র ভিত্তিতে সংরক্ষণ নিশ্চিত করে ভারসাম্যপূর্ণ এবং দেশজ বৃক্ষ রোপন ও লালনের কর্মসূচি কার্যকর করার পাশাপাশি 'নগর বন' সৃষ্টির ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি ব্যক্তি ও কর্পোরেট ভিত্তিক সবুজায়ন ও বনায়ন উদ্যোগকে প্রণোদিত ও কখনও কখনও বিশেষভাবে উৎসাহিত করার প্রয়াস নিতে হবে।
৩. নগরব্যাপী বিদ্যমান পুকুর, খাল এবং অন্যান্য জলাশয় পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণপূর্বক নগরীর বাসযোগ্যতা উন্নয়নে সমন্বিতভাবে "নীল অন্তঃসংযোগ" গড়ে তোলার পাশাপাশি নদীর সাথে তাদের সংযোগ স্থাপনের প্রয়োজনীয় আশু উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি, নগরীতে বিদ্যমান পুকুর, জলাধার ও জল সংরক্ষণ উদ্যোগগুলোর ত্বরান্বিত বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।
৪. সমীক্ষানির্ভর নীতিমালা প্রণয়ন এবং প্রণোদনা ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে সাম্যতার ভিত্তিতে অন্তর্ভুক্তিতার নগরদর্শন নিশ্চিতে সংশ্লিষ্ট পেশাজীবী ও সংস্থাগুলোকে নিয়ে আরও উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। ব্যক্তি পর্যয়ে এ বিষয়ে সচেতনতা তৈরি এবং জনমানুষকে নিয়ে প্রতিটি বাড়িতে তাপপ্রবাহের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার সামর্থ্যের জায়গাটি কাজে লাগানো প্রয়োজন।
৫. শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে এ বিষয়ক সচেতনতা বৃদ্ধি এবং বৃক্ষরোপণ কর্মসূচির উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। এক্ষেত্রে সঠিক বিনিয়োগের প্রয়োজন রয়েছে বিধায় এ বিষয়ে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।
৬. যত্রতত্র নিয়ন্ত্রিত কাচের ভবনের 'আত্মঘাতী সংস্কৃতি'র বিপরীতে প্রকৃতির নির্ভরতায় জীবন আচরণ নিশ্চিতের 'নগর দর্শন' ভিত্তিক বিনির্মাণ নিশ্চিতে অনতিবিলম্বে 'ইমারত নির্মাণ বিধিমালায় যথোপযুক্ত শুদ্ধিকরণের উদ্যোগ প্রয়োজন। যদিও রাজউক তাড়াহুড়া করে সংশ্লিষ্ট পেশাজীবী এবং অংশিজনদের সাথে পরামর্শ গ্রহণ ব্যতিরেকে পাশ কাটানোর চেষ্টা মাধ্যমে সেই সুযোগকেও হত্যা করার চেষ্টা করছে। আশু উদ্যোগের মাধ্যমে তা প্রতিহত ও যথাযথ করা প্রয়োজন।
৭. নগরীতে বায়ু ও গ্যাসীয় দূষণের প্রধান প্রধান নিয়ামকসমূহ যেমন, অনুপোযোগী যানবাহন চলাচল, নির্মাণ কার্যক্রম ও মালামালের পরিবহন ও প্রক্রিয়াকরণ জনিত দূষণ, ইটভাটাজনিত দূষণ, ময়লার ভাগাড়, কারখানার নির্গত ধোঁয়াসহ অন্যান্য বায়ু দূষণকারী কার্যক্রম রোধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কর্তৃক কার্যকরী ও দৃষ্টান্তমূলক দৃশ্যমান পদক্ষেপ গ্রহণ। সরকারি-বেসরকারি স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা এবং কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান দ্বারা গৃহীত প্রকল্পের আওতায় নগর বায়ু ও বর্জ্য দূষণ এবং বৈশ্বিক উষ্ণতার অভিঘাতের বিরুদ্ধে অভিযোজন ও ভারসাম্য নিশ্চিতের কর্মসূচিগুলোকে সুবিন্যস্ত ও সুপরিকল্পিতকরণের মাধ্যমে আরও শক্তিশালী করে তোলা জরুরী বিবেচনায় অন্যতম দাবী।
৮. সামগ্রিক অব্যবস্থার বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে পরিবেশবাদী, পেশাজীবীসহ সকলের সম্মিলিত ও স্বতঃস্ফূর্ত প্রচেষ্টায় ২০২৩ সালে উত্তর সিটি কর্পোরেশনের জন্য একটি সবুজায়ন নীতিমালা তৈরি করা হয়েছে। ইউএসএইড, বন অধিদপ্তর এবং অন্যান্য সংস্থাগুলো মিলে বৃক্ষশুমারি করেছে। সেই আলোকে দেশব্যাপী সুপরিকল্পিত নগর সবুজায়ন নীতিমালা ভিত্তিক বাস্তবায়ন কর্মসূচির উদ্যোগ গ্রহণ করাই সমীচিন।
বাপা সভাপতি অধ্যাপক ড. নুর মোহাম্মদ তালুকদারের সভাপতিত্বে এবং সাধারণ সম্পাদক আলমগীর কবিরের সঞ্চালনায় সংবাদ সম্মেলনে আরও বক্তব্য রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শহীদুল ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড.আব্দুস সালাম প্রমুখ।
