ঢাকা
বুধবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৫, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
ই-পেপার

‘মা, তুমি কাইন্দো না’ 

স্বপ্নহারা মাকে শিশুর সান্ত্বনা, কড়াইল বস্তির আগুনে দগ্ধ মানবিকতা

আপডেট : ২৬ নভেম্বর ২০২৫, ০২:৪৫ এএম

রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ এলাকা বনানীর পাশে অবস্থিত কড়াইল বস্তিতে মঙ্গলবার (২৫ নভেম্বর) সন্ধ্যায় লাগা এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে শত শত বসতঘর পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। পাঁচ ঘণ্টা ধরে চলা এই বিধ্বংসী আগুনে বস্তির বউবাজার অংশের কুমিল্লা পট্টি, বরিশাল পট্টি ও ‘ক’ ব্লক এলাকার বিস্তীর্ণ অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের ১৯টি ইউনিটের নিরলস প্রচেষ্টায় অবশেষে আগুন নিয়ন্ত্রণে এলেও বস্তির খেটে-খাওয়া মানুষদের জীবনে নেমে এসেছে ঘোর অন্ধকার।

ঘটনাস্থল সরেজমিনে দেখা যায়, আগুনে দগ্ধ এলাকাটি এখন কেবলই ধ্বংসস্তূপ। ঘরের জিনিসপত্র তো দূরের কথা, সেখানে কোনো কিছুই অবশিষ্ট নেই। যদিও এখনো পর্যন্ত কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি, কিন্তু জীবন বাঁচলেও সহায়-সম্বল হারিয়ে বস্তির বাসিন্দারা এখন দিশেহারা। চারিদিকে কেবল আহাজারি আর কান্নার রোল। এই দরিদ্র মানুষেরা দিনের পর দিন কঠোর পরিশ্রম করে যে স্বপ্নগুলো বুনেছিলেন, তা আজ মুহূর্তের আগুনে পুড়ে ছাই।

নিজের ঘরের সর্বস্ব হারিয়ে রাস্তার পাশে বসে বিলাপ করছিলেন নীলুফা ইয়াসমিন। সাত বছর ধরে স্বামী ও আট বছরের সন্তানকে নিয়ে এই বস্তিতে তার সংসার। তিনি গার্মেন্টসে কাজ করেন আর তার স্বামী রিকশা চালান। কাঁদতে কাঁদতে তিনি জানান, কিস্তিতে কেনা একটি ফ্রিজ, টিভি, আলমারি—সব পুড়ে গেছে। ঘরে থাকা চাল, ডাল, কাপড়চোপড়, সামান্য সঞ্চয়, কোনো কিছুই বের করতে পারেননি। এই সময় তার আট বছরের ছেলে ইয়ামিন মাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলছে, "মা তুমি কাইন্দো না, আমাগো সব হবে, আমি চাকরি কইরা সব কিইনা দিমু।" এই দৃশ্য সেখানে উপস্থিত সকলের চোখ ভিজিয়ে তোলে।

আগুনে পুড়ে সব হারানো বস্তির বাসিন্দা আমিরুল ইসলাম বলেন, আগুনের খবর শুনে দৌড়ে এসে দেখেন তার সব শেষ। স্ত্রী ও দুই সন্তান নিরাপদে বের হতে পারলেও কোনো জিনিস বের করতে পারেননি। আরেকজন বস্তিবাসী জাকির জানান, আগুনে কয়েকশো ঘর পুড়ে গেছে এবং আগুন লাগা অংশে কিছুই অবশিষ্ট নেই।

ধ্বংসস্তূপের পাশে কান্নায় মূর্ছা যাচ্ছিলেন জমিরুন নেছা। তার পাশে দাঁড়িয়ে তার মেয়ে জিনিয়াও কাঁদছে। জমিরুন নেছার প্রশ্ন, "আমাগো এখন কী হবে কিছুই কইতে পারি না। কী খামু, কী পরুম তা তো জানি না। আমাগো শেষ সম্বলটুকু কেন পুড়ে গেলো।"
সবচেয়ে করুণ চিত্রটি ফুটে উঠেছে মাহবুব হোসেনের কথায়। জীবন নিয়ে বের হতে পারলেও পকেটে কোনো টাকা-পয়সা ছিল না। 
তিনি জানান, তার তিন বছরের ছেলে শীতে ও ক্ষুধায় কাঁদছে। পরিচিত সবার ঘর পুড়ে যাওয়ায় কোথাও আশ্রয়ও নেই। তিনি কড়াইল বস্তির চারপাশের "দেশের সবচেয়ে ধনী মানুষের" প্রতি সাহায্যের আবেদন জানিয়ে বলেন, "আগুন থেকে বাঁচলেও শীত ও ক্ষুধা থেকে বাঁচতে পারছি না।"

রিকশা গ্যারেজে কাজ করা জামাল হোসেনের গ্যারেজ ও বাসা, দুটিই পুড়ে গেছে। তার স্ত্রী দেড় বছরের বাচ্চাকে নিয়ে বনানীর একটি বাসায় গৃহকর্মীর কাজে যাওয়ায় ঘরের তালা ভেঙে আগুন লাগার সময় তিনি ঢুকতে পারেননি। এখন পরিবার নিয়ে রাস্তায় থাকা এই মানুষটিও তীব্র শীত ও খাদ্যের অভাবে কষ্ট পাচ্ছেন।

বর্তমানে গৃহহীন বস্তিবাসীরা বউবাজার এলাকার খামারবাড়ি মাঠে অবস্থান নিয়েছেন। আগুন লাগার পর পরই বিকেল ৫টা ২২ মিনিটে ফায়ার সার্ভিস কাজ শুরু করে এবং পরবর্তীতে মোট ১৯টি ইউনিটের সমন্বিত চেষ্টায় ৫ ঘণ্টা পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। আগুনে অক্ষত থাকা ঘরের বাসিন্দারা অনেকেই নিজেদের জিনিসপত্র দ্রুত সরিয়ে নিচ্ছেন।

 

HN
আরও পড়ুন