আর ক’দিন পরই মুসলমানদের পবিত্র ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর। ঈদ উৎসবে প্রিয়জনের জন্য কেনাকাটা করতে গভীর রাত পর্যন্ত বিভিন্ন মার্কেটে ছুটছেন ক্রেতারা। পরিবারের সবাই অপেক্ষা করছেন সেই দিনটির জন্য। কিন্তু সোমালিয়ার জলসদ্যুদের হাতে জিম্মি নাবিক সিরাজগঞ্জের নাজমুল হকের মা-বাবা অপেক্ষায় আছেন কখন ফিরবে তাদের আদরের সন্তান।
শনিবার (৬ এপ্রিল) জিম্মি নাজমুল হকের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের পরিবারে এবার ঈদের কোনো ধরনের কেনাকাটা হয়নি। নেই ভালো কিছু রান্নার প্রস্তুতিও। অন্যবারের ঈদগুলোতে হাসি-খুশিতে মেতে থাকলেও এবারের ঈদ তাদের কাছে নীরব কান্নার। আদরের সন্তান জলদস্যুর বন্দিদশায় থাকায় পরিবারটিতে ঈদের আনন্দ যেন তলিয়ে গেছে মহাসাগরের অতলে। প্রধানমন্ত্রীর কাছে ঈদুল ফিতরের আগেই ২৩ নাবিকের মুক্তির আকুতি জানিয়েছেন নাজমুলের স্বজনেরা।

সিরাজগঞ্জের কামারখন্দ উপজেলার ভদ্রঘাট ইউনিয়নের প্রত্যন্ত চর-নূরনগর গ্রামের আবু শ্যামা ও নার্গিস দম্পতির একমাত্র ছেলে নাজমুল হক (২৩)।
প্রতিবেশী ও স্বজনেরা খবর সংযোগ ডটকমকে জানান, দুই ভাই-বোনের মধ্যে সে বড়। ছোটবেলাতেই মারা গেছে তার তিন ভাই-বোন। মাত্র ২০ বছর বয়সেই জাহাজে চাকরিতে যোগ দেন। গত ১২ মার্চ অপহৃত হওয়ার পর থেকেই ছেলের মুক্তির সংবাদের প্রতীক্ষায় সময় পার করছেন নাজমুলের মা-বাবাসহ পরিবারের সদস্যরা। সন্তান অপহৃতের খবর পাওয়ার পর থেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন বৃদ্ধ বাবা। কান্না ও আহাজারিতে রাত-দিন পার করছেন স্বজনেরা।
তারা জানান, প্রতিবছর ঈদের কেনাকাটা করলেও এবার কিছুই হয়নি তাদের। ছেলের সুস্থতা আর নিরাপদে ফিরে আসার অপেক্ষায় রয়েছেন তারা। প্রশাসনসহ অনেকেই তাদের খোঁজখবর নিতে আসে। শুধু সান্ত্বনা দিয়েই যায়। সন্তানের ভালো সংবাদের অপেক্ষা আর শেষ হয় না তাদের।
একই কোম্পানিতে নাবিক পদে চাকরি পাওয়া নাজমুলের ফুফাতো ভাই আল-মাহমুদ খবর সংযোগ ডটকমকে বলেন, এমভি আব্দুল্লাহ জাহাজটি জিম্মির বিষয়টি সবার আগে অফিসের গ্রুপের মাধ্যমে আমি জেনেছি। গ্রুপে আসা তাদের জাহাজের ভিডিও দেখেই বুঝতে পারি এটা নাজমুলদের জাহাজ। আমি জানলেও তার পরিবারকে বিষয়টি আগেই জানাইনি। পরের দিন রাত সাড়ে ১১টার দিকে নাজমুলের সঙ্গে আমার সর্বশেষ যোগাযোগ হয়। তখন পর্যন্ত বলেছে যে ভালো আছে ও খাবারদাবার ঠিকমতো দিয়েছে। তবে গত ২৩ দিন বন্দিদশায় বদলে গেছে নাজমুলের পরিবারের চিত্র। ঈদের আগেই যেন আমার ভাইসহ সকল নাবিকদের মুক্তির ব্যবস্থা করে সরকার। তারা যেন সবাই ভালোভাবে ফিরে আসুক পরিবারের কাছে। এই দোয়াই করি সব সময়।

নাজমুলের প্রতিবেশী শাকিল শেখ ও আমিরুল ইসলাম খবর সংযোগ ডটকমকে বলেন, নাজমুল খুবই ভদ্র ও ভালো ছেলে। এখানে পড়াশোনা করা অবস্থাতেই চাকরি হয়ে গেছে। নাজমুল ছাড়া ওদের পরিবারকে দেখার আর কেউ নেই। এর আগে ছোটবেলাতেই নাজমুলের আরও তিন ভাই-বোন মারা গেছে। এখন তার একটা বোন আছে, তারও বিয়ে হয়ে গিয়েছে।
স্থানীয় ইউপি সদস্য আব্দুস সাত্তার খবর সংযোগ ডটকমকে বলেন, দরিদ্র পরিবারের সন্তান জাহাজে চাকরি পাওয়ায় আমরা অনেক খুশি হয়েছিলাম। কিন্তু জলসদস্যুদের হাতে নাজমুলের জিম্মি হওয়ার খবর শুনে আমরাও খুব ভেঙে পড়েছি ও কষ্ট পেয়েছে। সুস্থতার সঙ্গে দ্রুত নাজমুলসহ সকলকে তাদের মা-বাবার বুকে ফিরিয়ে আনার জোর দাবি জানাচ্ছি।
নাজমুলের মা নার্গিস বেগম খবর সংযোগ ডটকমকে বলেন, নাজমুলের আয়েই আমাদের সংসার চলে। মাসে ৯০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা পাঠাতো। জিম্মি হওয়ার আগের মাসে ৯১ হাজার টাকা দিয়েছে। আমার ছেলেটা এখনও বিয়ে করেনি। অনার্সে ভর্তির পরেই তার চাকরি হয়েছে। চাকরি হওয়ার পরে প্রথমে গিয়ে ৩ বছর ছিল। এরপর এসে আবার মাস তিনেক হলো গেছে। ঢাকা থেকে বিমানে দক্ষিণ কোরিয়া গিয়ে ওখান থেকে জাহাজে উঠেছে নাজমুল।
নার্গিস আরও বলেন, যখন তারা জলদস্যুদের হাতে জিম্মি হয় তখন আমার বুকের মানিক বলেছিল, 'মা ২০ থেকে ২৫ দিনের খাবার আছে, আর ২০০ মেট্রিক টন পানি আছে। দস্যুরা কথায় কথায় মাথায় বন্দুক ধরে রাখে, জাহাজে খাবার সংকট, পানি সংকট এমন নানা দুশ্চিন্তায় আমার ঘুম আসে না'।
ছেলেকে ঈদের আগেই ফিরে পেতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপও কামনা করেন হতভাগ্য এই মা।
কামারখন্দ উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) শাহীন সুলতানা খবর সংযোগ ডটকমকে বলেন, জলদস্যুদের হাতে জিম্মি হওয়ার পর থেকেই জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে তাদের পরিবারের সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছি। অপহৃত নাবিকদের উদ্ধারের বিষয়টি নিয়ে সরকার ও জাহাজ মালিকের পক্ষ থেকে সব ধরনের চেষ্টা চলছে। পরিবারের একমাত্র ছেলে নিখোঁজ থাকলে তাদের তো আসলে ঈদ বলতে কিছুই থাকে না। তারপরও আমরা তাদের পাশে আছি। নাজমুলের পরিবারকে আমরা সকল প্রকার সহযোগিতা করব।
