বর্ষা মৌসুমে গ্রামের ধানক্ষেতে, খালে-বিলে ও নালায় চিংড়িসহ দেশীয় প্রজাতির মাছ ধরার জন্য জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে ‘চাক জাল’। বাঁশের তৈরি চাঁইয়ের বিকল্প হিসেবে সুতার তৈরি এক ধরনের মাছ ধরার ফাঁদ হলো ‘চাক জাল’। সুতা আর বাঁশের শলা দিয়ে তৈরি এই জাল চাকার মতো ঘোরানো যায় বলে এটির নাম হয়েছে চাক জাল। তবে দেখতে বুচনা চাঁইয়ের মতো হওয়ায় এটি বুচনা জাল নামেও পরিচিত।
পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলার দীঘিরজান বাজারে সপ্তাহের দুইদিন শনি ও মঙ্গলবার চাক জালের হাট বসে। এ ছাড়া বর্ষা মৌসুমে বিভিন্ন হাটবাজারে চাক জালের কেনা-বেচা হয়।

চাক জালের ব্যবসায়ী জেলার সদর উপজেলার সিকদার মল্লিক গ্রামের মো. বেলায়েত মোল্লা বলেন, প্রতি হাটে ৪০ থেকে ৫০টি চাক জাল বিক্রি করি। তিনি আরও জানান, পার্শ্ববর্তী বাগেরহাট জেলার মোড়লগঞ্জ উপজেলার বাধাল বাজার থেকে এ চাক জাল পাইকারি কিনে এনে খুচরা বিক্রি করেন।
চাক জালের কারিগররা জানান, বৈশাখ মাস থেকে ভাদ্র মাস পর্যন্ত গ্রামাঞ্চলে ধানক্ষেত ও নালায় চিংড়িসহ নানা প্রজাতির মাছ শিকার করেন জেলে ও কৃষকরা। একসময় বাঁশের তৈরি চাঁই দিয়ে মাছ ধরা হতো। দুই দশক ধরে এলাকায় বাঁশের দাম বেড়ে যাওয়ায় চাঁইয়ের উৎপাদন ব্যয় কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। তা ছাড়া বাঁশের সংকটও রয়েছে। তাই জাল ও বাঁশের কঞ্চি দিয়ে চাঁইয়ের বিকল্প হিসেবে চাক জাল তৈরি শুরু করেন। চাক জাল তৈরিতে খরচ কম। বাঁশও কম লাগে। জাল তৈরির সুতা সহজলভ্য। তাই বাঁশের তৈরি চাঁইয়ের বিকল্প হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে চাক জাল। হুবহু বুচনা চাঁইয়ের মতো। শুধু বাঁশের পরিবর্তে সুতার জাল ব্যবহার করে এই জাল তৈরি করা হয়। স্থানীয় কৃষকদের নিজস্ব মেধা ও শ্রম দিয়ে উদ্ভাবিত এ জালের উৎপাদন খরচ ও দাম কম হওয়ায় চাক জালের চাহিদা বেড়েছে।

জেলার বিভিন্ন গ্রামের দৃই শতাধিক পরিবার চাক জাল তৈরি করে থাকে। এসব জাল গৃহস্থদের কাছ থেকে কিনে স্থানীয় হাটবাজারে বিক্রি করেন ব্যবসায়ীরা।
গত শনিবার বিকেলে নাজিরপুর উপজেলার দীঘিরজান হাটে গিয়ে দেখা যায়, কয়েকজন জাল ব্যবসায়ী চাক জাল বিক্রি করছেন। কেউ কেউ জালগুলো ঝুলিয়ে বিক্রির জন্য বসে আছেন। পানি নাই স্থানীয় ধানক্ষেতগুলোতে তাই মাছ ধরা পড়ছে কম। তাই বাজারে চাহিদা কম চাক জালের। বেচাকেনাও তাই কম।
উপজেলার ছোট বুইচাকাঠী গ্রামের কামাল শেখ বলেন, মাঝারি আকারের একটি চাক জাল ৫৫০ টাকায় কিনেছেন। এ জাল দিয়ে চিংড়িসহ দেশীয় প্রজাতির মাছ ধরা সহজ।
কয়েকজন চাক জাল বিক্রেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বড় চাক জাল ১৫ থেকে ২০ হাত পর্যন্ত লম্বা হয়। বড় একটি জাল দেড় হাজার থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকায় বিক্রি হয়ে থাকে। পাঁচ থেকে ছয় হাত জালের দাম ৫০০ থেকে ৬৫০ টাকা। তিন থেকে চার হাত জালের দাম ৩৫০ থেকে ৪৫০ টাকা।
গৃহস্থ পরিবারের লোকজন অবসরে বাড়িতে চাক জাল তৈরি করেন। এ জাল তৈরি খুব সহজ। সময় কম লাগে। বাঁশ কেটে শলা তৈরি করা হয়। এরপর শলাটি গোল করে বেঁধে পরিমাণমতো সুতা দিয়ে তৈরি হয় চাক জাল। মাঝারি ও ছোট চাক জালের বিক্রি বেশি।
চাক জাল বিক্রেতা মো. আলাউদ্দিন বলেন, বর্ষা মৌসুমে গ্রামের মানুষ ধানক্ষেতে চিংড়ি খালবিলে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ধরে থাকেন। সারা বছর ধরে চাক জাল বিক্রি হলেও বর্ষা মৌসুমে এর বেচাকেনা বেশি হয়। পুকুর ও নালায় মাছ ধরার জন্যও চাক জাল ফাঁদ হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
স্থানীয় বয়স্করা জানান, আমরা আগে কখনো মাছ নির্মূল করার এই ফাঁদেও ব্যবহার দেখি নাই। কয়েক বছর ধরে এটা দেখে আসছি। এতে মাসহ বাচ্চা মাছও মারা পড়ে। আর এর জন্য এক প্রকার বিলুপ্তের পথে দেশীয় প্রজাতির মাছ।
