চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর ওপর ১৯৩১ সালে নির্মিত হয় কালুরঘাট রেলসেতুতে ১৯৬২ সালে যান চলাচল শুরু হয়। এ সেতুর বয়স এখন ৯৩ বছর। ঢাকা-কক্সবাজার রেলপথে ট্রেন চলাচলের জন্য সেতুতে বড় ধরনের সংস্কারকাজের উদ্যোগ নেয় রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল। কাজ শুরু হয় গত বছরের ১ আগস্ট।
এ জন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেডের সঙ্গে ৪৩ কোটি টাকার চুক্তি করে রেল। চুক্তি অনুযায়ী চলতি বছরের মার্চে কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু চুক্তির মেয়াদ শেষ হলেও সংস্কার কাজের (কার্পেটিং) এখনও ২৫ শতাংশ বাকি। এ ছাড়া ভারী যানবাহন চলাচল বন্ধে সেতুর দুই প্রান্তে উচ্চতা প্রতিবন্ধকতা বসানো হবে। এই কাজ করতে সময় লাগবে।
এদিকে সংস্কারকাজ শুরুর দিন থেকে পাশে যাতায়াতের বিকল্প হিসেবে ফেরি চালু করা হয়। সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের উদ্যোগে ফেরি চালু হয়। তবে শুরুর দিনই জোয়ারের পানিতে বেইলি সেতু ডুবে যায়। সাময়িকভাবে বন্ধ ছিল ফেরিও। শুরু থেকে ফেরি পারাপারে যে ভোগান্তি তা আর পুরোপুরি দূর হয়নি। প্রতিদিনই যাতায়াতে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে প্রায় অর্ধ লাখ মানুষের।
এসব বিষয়ে কথা হয় মাহমুদা বেগমের সঙ্গে। তিনি বোয়ালখালী উপজেলার করলডেঙ্গা ইউনিয়নের বাসিন্দা। সড়ক দুর্ঘটনায় স্বামীকে হারিয়েছেন দুই বছর আগে। একমাত্র মেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌস পড়েন চট্টগ্রাম নগরের সরকারি মহিলা কলেজে। জান্নাতুল প্রায় সময় বান্ধবীদের সঙ্গে কলেজে গেলেও পরিবারের ভয় এখন ফেরিতে কখন জানি দুর্ঘটনা ঘটে। তাই সাংসারিক সব ব্যস্ততা বাদ দিয়ে তাকে ফেরি পার করে দেন মা। এ দুশ্চিন্তা শুধু মাহমুদা বেগমের পরিবারের নয়, ফেরিতে স্কুল ও কলেজগামী প্রতিটি পরিবারের। দুশ্চিন্তা হবেই না কেন! সম্প্রতি ফেরিঘাটে ঘটেছে কলেজছাত্রীর র্মমান্তিক মৃত্যুর ঘটনা।
গেল ২৯ এপ্রিল ফেরিঘাটের বোয়ালখালী অংশে বেইলি ব্রিজে টেম্পোর ধাক্কায় ফাতেমা তুজ জোহরা নুপুর নামে এক কলেজ শিক্ষার্থী ব্রিজের সঙ্গে আটকে য়ায়। পরে তাকে সেখান থেকে উদ্ধার করে বোয়ালখালী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করে। এরপরেই পুরো এলাকাজুড়ে শিক্ষার্থীদের ফেরি পারাপার নিয়ে তৈরি হয় শঙ্কা ও সেই সঙ্গে ভয়।
শিক্ষার্থী নুপুরের মৃত্যুর দিন সকালে ফেরি পারাপার করতে গিয়ে অল্পের জন্য রক্ষা পান এক মোটরসাইকেল আরোহী। তবে পানিতে তলিয়ে গেছে তার যাতায়াতের একমাত্র বাহনটি। গত ৮ মে সকাল ৭টায় কালুরঘাটের পশ্চিম প্রান্তে (শহরের অংশ) ফেরিঘাটের বেইলি ব্রিজে টেম্পোর ধাক্কায় মো. গফুর (৫৫) নামে এক বৃদ্ধের পা ভাঙে। পরে তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়।
শুধু কলেজ শিক্ষার্থী কিংবা মোটরসাইকেল আরোহীই নয়, ফেরি পারাপারের করতে গিয়ে প্রতিনিয়তই ঘটছে ছোটবড় দুর্ঘটনা। এসব দুর্ঘটনা ঘটনা রোধে এখান পর্যন্ত কোন কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি কেউ-ই। এরমধ্যে কালুরঘাট সেতুর মেরামত কাজ কয়েক দফা পিছিয়ে যাওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন স্থানীয়রা।
তারা বলছেন, এ অঞ্চলের মানুষ সব সময় অবহেলিত। আমাদের কোন অভিভাবক নেই। এত বড় বড় দুর্ঘটনা ঘটে যাচ্ছে কেউ কোন প্রতিবাদ করছে না। এলাকার মানুষের পাশে দাড়িঁয়ে কেউ কোন কথা বলে না। কালুরঘাট সেতু সংস্কার করার কথা তিন মাসে। এখন হয়ে গেছে নয় মাস। কেউ কি কোন কথা বলছে আমাদের দুঃখের।
বোয়ালখালী উপজেলা থেকে চট্টগ্রাম নগরের কাজীর দেউড়ির আসকার দিঘির পাড়স্থ মিডিয়া টাওয়ারে চাকরি করেন নিজাম উদ্দিন। তিনি প্রতিদিনের দুর্ভোগের কথা জানান দৈনিক খবর সংযোগকে। নিজাম উদ্দিন ক্ষোভ ঝেড়ে বলেন, কালুরঘাট সেতু আমাদের দীর্ঘদিনের প্রাণের দাবি। প্রতি বছর নির্বাচন এলে জনপ্রতিনিরা এ সেতু নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু নির্বাচন গেলে কেউ কথা রাখে না। পুরাতন সেতু সংস্কারের করা হচ্ছে। সেটিও নির্ধারিত সময়ে শেষ করতে পারছে না। এ অঞ্চলের মানুষের দুর্ভোগ দিনদিন বাড়ছে।
নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সংস্কার কাজ শেষ করে গাড়ি ও পথচারী পারাপারের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার কথা থাকলেও নানা অজুহাতে এখনো কালুরঘাট সেতুর সংস্কারকাজ এখনো শেষ করতে পারেনি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
চট্টগ্রাম নাগরিক ফোরামের মহাসচিব মো. কামাল উদ্দিন বলেন, সেতুটি নির্মাণ হলে শহরের যানজট কমবে এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। চট্টগ্রামের জনগণ এই সেতুর জন্য বহুদিন ধরে অপেক্ষা করছে এবং সরকারকে দ্রুত এই প্রকল্প বাস্তবায়নে উদ্যোগ নিতে হবে। কালুরঘাট সেতু নির্মাণ না হওয়ায় নগরবাসীকে প্রতিনিয়ত দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। এটি কেবল পরিবহন ও যোগাযোগের সমস্যা নয়, বরং নগরীর সামগ্রিক উন্নয়নের সাথে সম্পর্কিত। এখন যে সেতু রয়েছে সেটির সংস্কার কাজেও ধীরগতি। এটি খুবই দুঃখজনক। আমরা সেতুর সংস্কার কাজ দ্রুত শেষ করে গাড়ি চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করার জোর দাবি জানাচ্ছি।
কালুরঘাট সেতু সংস্কার কাজে নিয়োজিত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেডের প্রকল্প ব্যবস্থাপক মেহেদী হাসান বলেন, বিল ঠিকভাবে পাওয়া গেলে কাজ আরও আগে শেষ করা যেত। সেতুর সংস্কারকাজ আমরা দ্রুত শেষ করতে চাই। এরপর যান চলাচলের উপযোগী হয়েছে কি না, তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পরামর্শক দল।
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের সেতু প্রকৌশলী জিসান দত্ত বলেন, কালুরঘাট সেতুর পিচঢালার কাজ হয়েছে ৭৫ শতাংশ। আগামী সপ্তাহে বাকি কাজ শুরু হবে। তা শেষ করতে ১৫ দিন সময় লাগবে।
