ঢাকা
সোমবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৫, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
ই-পেপার

হাতিয়া পৌর ইঞ্জিনিয়ার সেলিমের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ

আপডেট : ২৫ জুলাই ২০২৫, ০২:১৩ পিএম

নিজেই ঠিকাদার বনে গিয়ে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা কামানো, সিএস-অফিস খরচ ও ল্যাব টেস্টের নামে ঠিকাদারদের কাজ থেকে লাখলাখ টাকা নেওয়া, চাহিদামতো ঘুষ নিয়ে এস্টিমেট ব্যতিরেকে অতিনিম্নমানের কাজ করানো, ভূতুড়ে প্রকল্পের নামে বরাদ্দ আত্মসাৎ, রোলার চার্জ, প্লান অনুমোদনের নামে পৌরবাসী থেকে ইচ্ছেমতো টাকা নেওয়া এবং মনমতো বিল ভাউচার তৈরিসহ নানা দুর্নীতি-অনিয়মের মাধ্যমে হাতিয়া পৌরসভা অফিসে এক লুটপাটের রাজত্ব কায়েম করেছে উপ-সহকারী প্রকৌশলী (এসএই) মো. সেলিম উদ্দিন। 

একাধিক স্টাফ আক্ষেপ করে জানান, দপ্তরে যিনি যে পদে নিয়োগ পেয়েছেন তাদের গুরুত্বহীন করে বহিরাগতদের এনে ইঞ্জিনিয়ার সেকশন থেকে শুরু করে সব গোপনীয় কাজ সেরে নিচ্ছেন তিনি। কর্মস্থলে প্রায়ই অনুপস্থিত থেকে নাগরিক ভোগান্তি সৃষ্টিসহ পাহাড়সম অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। যদিও প্রশাসকের দায়িত্বে রয়েছেন উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি)। 

সেলিমের বিরুদ্ধে এসব অনিয়ম, দুর্নীতির খবর পেয়ে প্রতিবেদক সম্প্রতি পৌরসভা অফিস ও সরেজমিন অনুসন্ধানে নামেন। এতে লোকাল গর্ভমেন্ট কোভিড-১৯ রেসপন্স ও রিকভারি (এলজিসিআরআরপি) এবং গুরুত্বপূর্ণ নগর অবকাঠামো উন্নয়নসহ (আইইউআইডিপি) এডিপি, টিআর- প্রকল্পে চরম অনিয়ম-দুর্নীতির সত্যতা পাওয়া যায়। 

জানা যায়, প্রায় ৫ বছর আগে নোয়াখালীর হাতিয়া পৌরসভা অফিসে উপ-সহকারী প্রকৌশলীপদে নিয়োগ পাওয়ার পর সাবেক মেয়র কেএম ওবায়দুল্লা বিপ্লবের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তোলে নিজেকে বড় আওয়ামীলীগার বানিয়ে নেন তিনি। এ সময় নিয়মবহির্ভূত বহু সুবিধাও নিয়েছেন বলে জানান পৌর অফিসের একাধিক স্টাফ ও ভুক্তভোগীরা। 

গত বছরের ৫ আগস্ট পটপরিবর্তনে নতুন সুরে পথ চলেন তিনি। ইচ্ছে হলে অফিস করেন, নচেৎ না। ভাতাভোগীদের কার্ডে ভুয়া মোবাইল নম্বর ব্যবহার করে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে চাকরিচ্যুত পরিচ্ছন্নতাকর্মী রাশেদ উদ্দিন, সুইপার আর বহিরাগতদের সঙ্গে রেখে দাম্ভিক ও ক্যাডার স্টাইলে চালান অফিস। যদিও পৌর প্রশাসকের দায়িত্বে আছেন সহকারী কমিশনার (ভূমি)। 

হাতিয়া পৌরসভা অফিসের তথ্য অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আওতায় হাতিয়া পৌরসভায় ১৮টি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। যার বরাদ্দ এক কোটি ৪৭ লাখ টাকা। সবকটি প্রকল্পে অ্যাস্টিমেটের তোয়াক্কা না করে চাহিদামতো পার্সেন্টেজ নিয়ে কাজের মনগড়া পরিসমাপ্তি দেখিয়ে বিলের ব্যবস্থা করেন সেলিম উদ্দিন। 

প্রকল্পগুলোর সরেজমিন অনুসন্ধানে গেলে, পৌরসভা ১ ওয়ার্ড রহমত আলী রোডের মাথা বক্সকালভার্টটির অ্যাস্টিমেটে- দুপাশের দেয়াল মাটি থেকে যথাক্রমে ২০ ইঞ্চি, ১৫ ইঞ্চি ও ১০ ইঞ্চি গাতনি দিয়ে করার কথা। কিন্তু সেক্ষেত্রে মাটি থেকে শুধু ১০ ইঞ্চি গাঁতনি দিয়ে কোনোপ্রকার ফিনিশিং ছাড়াই কাজটি শেষ করা হয়।

পুরাতন কোর্ট সংলগ্ন হুমায়ুন হোটেলের সামনের রাস্তাটির কাজ সমাপ্তির দেড় মাসের মাথায় পূর্বাংশটি ভেঙেচুরে একাকার হয়ে যায়। সেলিম উদ্দিন সবগুলো কাজে অতিরিক্ত হারে ঘুষ নেওয়ায় কাজের মান এমন বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। 

সেলিম এডিপি প্রকল্পের সবগুলো কাজে ঠিকাদারদের থেকে ল্যাব টেস্ট নামে ২ শতাংশ, সিএস খরচ নামে ২ শতাংশ এবং অফিস খরচ নামে পারসেন্ট ছাড়াও বিভিন্ন সময় নানা অজুহাতে মোট ১০ শতাংশ টাকা নিয়েছেন বলে জানান ঠিকাদারর। সে হিসাবে ১৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি। 

এছাড়া এডিপির এ প্রকল্পগুলোর অনেকগুলো কাজ অসমাপ্ত রেখে ঠিকাদারদের সঙ্গে যোগসাজশে সমপরিমাণ টাকা ভাগ নিয়েছেন বলে জানা যায়। ঠিকাদাররা জানান, ল্যাব টেস্টের প্রচলন এবারই প্রথম। সিএস এবং অফিস খরচ অতীতে আরও কম নিতো। সেলিম তাদের ওপর জুলুম করেছেন বলে জানান এসব ভুক্তভোগী। 

এডিপির এই কাজগুলো প্রকল্পভুক্তকরণ তথা প্রতিটি প্রকল্প পাসে সেলিম ১৫-২০ হাজার টাকা করে সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের পার্শ্ববর্তী সেবাগ্রহীতাদের থেকে নিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এ সম্পর্কে পৌরসভা ১ নম্বর ওয়ার্ড 'ছেরাজল হক রোড'-এর পার্শ্ববর্তী একাধিক সেবাগ্রহী বাসিন্দা জানান, সেলিমকে তারা ২০ হাজার টাকা দিয়ে অনেকদিনের প্রত্যাশিত রাস্তাটি প্রকল্পভুক্ত করেছেন।

পৌরসভা এলাকায় যে কয়টা ছোট-বড় মার্কেট হয়েছে এবং একতলা ছাদঢালাই কিংবা দ্বিতল ভবনের বাসা হয়েছে তাদের থেকে ল্যাব টেস্ট এবং প্লান অনুমোদনের কথা বলে ৭০ থেকে এক লাখ ৩০ হাজার টাকা করে নিয়েছেন সেলিম।

হাতিয়া প্রাইভেট হসপিটালের শেয়ারহোল্ডার সোহেল জানান, প্লান অনুমোদনে তার থেকে এক লাখ ২০ হাজার টাকা নিয়েছে  সেলিম। অতিরিক্ত টাকা নেওয়ার পাশাপাশি তাকে আড়াই মাস ধরে হয়রানি করায় সেলিমের বিচার দাবি করেন এ ভুক্তভোগী।

এদিকে এলজিসিআরআরপি এবং আইইউআইডিপির আওতায় হাতিয়া পৌরসভায় প্রায় ৭ কোটি টাকার প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। এসব প্রকল্পের কাজেও চাহিদামতো ঘুষ নিয়ে অ্যাস্টিমেট ব্যতিরেকে সেলিম তার মনগড়াকাজ করিয়েছেন। প্রকল্পগুলোর ৬ জন ঠিকাদারের সঙ্গে প্রতিবেদকের কথা হয়। 

তারা জানান, ৫ শতাংশ ছাড়াও ওয়ার্ক অর্ডার, সিএস-অফিস খরচ মিলে ১০ শতাংশ হারে এলজিসিআরআরপি এবং আইইউআইডিপি প্রকল্পগুলো সবার থেকে ৫০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন সেলিম। সাইড ভিজিটেও যার থেকে যেভাবে পেরেছেন টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। 

তারা আরও জানান, একদিনে রোলার খরচ ৮ হাজার এবং জ্বালানি-ড্রাইভার খরচ আরও দেড় হাজার টাকা করে নেন সেলিম। অথচ রাজস্ব মাত্র ৫০০-১০০০ টাকা জমা দেওয়ার খবর পাওয়া যায়। 

ঠিকাদারদের থেকে আনডকুমেন্টারি কয়েক লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার কিছু তথ্য-প্রমাণও পাওয়া যায় পৌর অফিস অনুসন্ধানে।চাকরিচ্যুত রাশেদের মাধ্যমে একাধিক প্রকল্পের ঘুষ ও পার্সেন্টেজ আদায় করতেন সেলিম। এ ক্ষেত্রে রাশেদও তার বাড়ির ৩/৪ জন আত্মীয়কে সেলিমের দুর্নীতির কাজে সাপোর্ট ও সাহস জোগাতেন রাশেদ। যা ইতোপূর্বে কয়েকটি প্রতিবেদনেও প্রকাশ পায়। 

উল্লেখিত প্রকল্পগুলো কেউ কাজ কিনে নিয়েছেন আবার কেউ অন্যের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানে নিয়েছেন। চলমান কিছু বিল আটকে থাকায় তারা আপাতত নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এসবের তদন্তে আসলে তারা আলাদাভাবে সব অনিয়ম প্রকাশ করে দেবে। 

লোকাল গভর্মেন্ট কোভিড-১৯ রেসপন্স ও রিকভারি (এলজিসিআরআরপি) প্রকল্পের আওতায় এম আলী রোডের(ফজলি বাড়ি) কার্যাদেশ পাওয়ার আগে ঠিকাদার মৃত্যুবরণ করেন। ঠিকাদার বা তার অন্য কোনো প্রতিনিধি ছাড়া সেলিম উদ্দিন নিজেই ঠিকাদার সেজে চলতি বিল উত্তোলন করেন। 

বিভিন্ন ভূতুড়ে প্রকল্পের নাম দিয়ে বাকি প্রকল্পগুলোর মাত্র ছয়টিতে যৎসামান্য কাজ করিয়ে টিআর প্রকল্পে বরাদ্দকৃত ২০ লাখ টাকাসেলিম আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

পৌরসভা অফিসের কার্যসহকারী রেজাউল হাসান বলেন, প্রকল্পের কোনো কাজ সম্পর্কে তাকে জানানো হয়নি ইঞ্জিনিয়ার সেকশন থেকে।
প্রকল্পগুলোর কাজসহ বিভিন্ন অনিয়ম, দুর্নীতি সম্পর্কে সেলিম উদ্দিনের সঙ্গে মোবাইল ফোনে খবর সংযোগের সঙ্গে কথা হলে তিনি দায় অস্বীকার বলেন, 'এসব বিষয়ে আমোবাইল ফোনে কথা বলতে রাজি না, সরাসরি অফিসে আসলে কথা হবে। '

হাতিয়া উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি)ও পৌর প্রশাসক এছেন জানান, অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

NJ
আরও পড়ুন