ঢাকা
সোমবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৫, ২ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
ই-পেপার

জেলে থেকেও কেটু মিজানের ত্রাসের রাজত্ব!

আপডেট : ২১ আগস্ট ২০২৫, ০৩:৩৩ পিএম

গাজীপুরে “কেটু মিজান” নামটি উচ্চারণ করলেই আতঙ্কে কেঁপে ওঠে অনেক পরিবার। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে একাধিকবার গ্রেপ্তার হলেও তার দাপট যেন কমেই না। জেলের ভেতর থেকেও অদৃশ্য শক্তির বলয়ে নিয়ন্ত্রণ করে যাচ্ছে বাহিনীকে।

ভুক্তভোগীদের দাবি, প্রকাশ্যে হামলা, চাঁদাবাজি, ছিনতাই থেকে শুরু করে হত্যার মতো ভয়ঙ্কর কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে এ কুখ্যাত সন্ত্রাসী চক্র। 

সরকারি নথি অনুযায়ী, কেটু মিজানের বিরুদ্ধে বর্তমানে ১৫-১৭টি মামলা রয়েছে। কিন্তু ভুক্তভোগীদের দাবি, প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে বহুগুণ বেশি। এক নারী ভুক্তভোগী কেঁদে কেঁদে বলেন, আমার স্বামীকে দিনের বেলায় কবরস্থানের সামনে ফালায় কুপিয়েছে। আশপাশে শত মানুষ ছিল, কিন্তু ভয়ে কেউ এগিয়ে আসেনি। আমি নিজেও থানায় মামলা করতে সাহস পাইনি।

আরেকজন বলেন, আমার ছোট ভাইকে কুপিয়েছে, আমাকেও হুমকি দিয়েছে। জীবনের ভয়েই থানায় যেতে পারিনি।

ভুক্তভোগীদের অনেকে মনে করেন, মামলা করলে প্রাণহানির ঝুঁকি আরও বেড়ে যায়। তাই নীরব থেকে দিন গুনছে তারা।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, কেটু মিজান তার অপরাধ সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখতে কিশোরদের ব্যবহার করে। তাদের হাতে ও শরীরে ট্যাটু করা থাকে ৭ অক্ষরের বিশেষ প্রতীক “ডেঞ্জার গ্রুপ”, যে প্রতীকের মানে সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে না। কিন্তু ভয়ের প্রতীক হিসেবে এলাকাজুড়ে পরিচিত।

তাদের কার্যপদ্ধতি ভয়ঙ্কর। প্রকাশ্যে দিবালোকে মানুষকে কুপিয়ে জখম করা কিংবা খুন করা তাদের কাছে নতুন কিছু নয়। অনেক সময় স্কুল ব্যাগে অস্ত্র লুকিয়ে রাস্তায় ঘোরে।

স্থানীয়দের অভিযোগ, এখনো ৫০-৬০ জন সদস্য সক্রিয় আছে, যাদের নিয়ন্ত্রণ করছে জেল থেকে কেটু মিজান নিজেই।

অটোরিকশা চালকদের টার্গেট করে কেটু মিজান বাহিনী ব্যবহার করে অভিনব কৌশল। গর্ভবতী নারী সাজিয়ে যাত্রী বেশে ওঠানো হয়। এরপর চালককে নির্জন স্থানে নিয়ে মারধর করে অটো, মোবাইল, মানিব্যাগসহ সব ছিনিয়ে নেয়। শুধু অটো চুরি করেই অন্তত ২ শতাধিক চালককে সর্বস্বান্ত করেছে বলে অভিযোগ।

এক ভুক্তভোগী অটোরিকশাচালক বলেন, যাত্রী নিয়া বিলাসপুরে গেলাম। নামার সময় কয় আমার অটোটা রাইখা যাইতে হবে। রাজি না হওয়ায় তারা কুপিয়ে জখম করে পালায়। পরে স্থানীয়রা আমাকে হাসপাতালে ভর্তি করে।

জামালপুরের মেলানদহ উপজেলার সিরিঘাট এলাকায় জন্ম মিজানের। বাবা মোবারক হোসেন ছিলেন ছোটখাটো ব্যবসায়ী। দারিদ্র্যের কারণে পরিবার ঢাকায় আসে। গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় এসে ধীরে ধীরে গড়ে তোলে অপরাধ সাম্রাজ্য। প্রথমে অটোরিকশা চুরি, পরে চাঁদাবাজি, ছিনতাই থেকে শুরু করে কিশোর বাহিনী গঠন— ধাপে ধাপে হয়ে ওঠে কুখ্যাত কেটু মিজান।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জানিয়েছে, মিজানের বিরুদ্ধে চলমান মামলাগুলো তদন্তাধীন।

তবে স্থানীয়রা প্রশ্ন তুলছেন— “শতাধিক অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকা সত্ত্বেও কীভাবে সে আড়াল থেকে এত শক্তিশালী রয়ে গেছে?

অপরাধের শিকার পরিবারগুলো এখনো নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। অনেকেই ঘরবন্দি জীবন কাটাচ্ছেন। এক নারী বলেন, যেদিন স্বামীকে মারল, সেদিন আমিও পাশের বাড়িতে লুকিয়ে ছিলাম। দরজায় আঘাত করে হুমকি দিয়েছিল। এখনও ভয় কাটেনি।

গাজীপুরবাসীর মনে এখনো হাজারো প্রশ্ন, কে বা কারা জেল থেকেও মিজানকে শক্তি জোগাচ্ছে? আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ এড়িয়ে কীভাবে সক্রিয় থাকছে তার বাহিনী? এতগুলো অপরাধের পরও কেন শেষ হচ্ছে না তার দাপট? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর এখনো অজানা।

ভুক্তভোগী পরিবারগুলো দাবি করেছে, নিরপেক্ষ তদন্ত ও কঠোর আইনি পদক্ষেপ ছাড়া গাজীপুরে শান্তি ফিরবে না। তাদের আশা, কেটু মিজানকে আইনের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে চিরতরে বন্ধ হোক সন্ত্রাসের রাজত্ব।

মানবাধিকারকর্মীরা বলেন, একজন ব্যক্তির নামে যদি ডজনের বেশি মামলা থেকেও সে দাপটের সঙ্গে অপরাধ চালিয়ে যেতে পারে, তাহলে সাধারণ মানুষ কোথায় যাবে? ভয়ে মামলা করতে না পারা মানে ন্যায়বিচারের পথ রুদ্ধ হয়ে যাওয়া। এতে অপরাধীরা আরও উৎসাহিত হয়। তাই ভুক্তভোগীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে দ্রুত বিচার প্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়া জরুরি। এ ধরনের পরিস্থিতি রাষ্ট্র ও সমাজের জন্য চরম অশনিসংকেত।

এদিকে সচেতন মহল বলছে, শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা নয়, সমাজের প্রতিটি স্তরে সহযোগিতা জরুরি। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, সুশীল সমাজ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও পরিবার- সবাইকে একসাথে দাঁড়াতে হবে। না হলে কিশোরদের ব্যবহার করে গড়ে ওঠা এ ধরনের সন্ত্রাসী বাহিনী ভবিষ্যতে আরও ভয়ঙ্কর রূপ নেবে।

এসব বিষয়ে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (অপরাধ উত্তর) মো. রবিউল ইসলাম বলেন, আমরা সর্বদা অপরাধ দমনে কাজ করে যাচ্ছি। যেকোনো অপরাধীকে আইনের আওতায় আনতে আমাদের থানা পুলিশ সর্বাত্মকভাবে কাজ করছে। কেটু মিজানের সঙ্গে জড়িত অন্য অপরাধীদের গ্রেপ্তার জন্যও অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এ বিষয়ে থানার পুলিশও কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
 
গাজীপুর জেলা কারাগারের জেল সুপার মোহাম্মদ রফিকুল কাদেরের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ না করায় তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
NJ
আরও পড়ুন